ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের পাখাপল্লী

গ্রামীণ জীবনে অপরিহার্য, দাবদাহে স্বস্তি পেতে হাতপাখা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১২ এপ্রিল ২০১৮

গ্রামীণ জীবনে অপরিহার্য, দাবদাহে স্বস্তি পেতে হাতপাখা

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ তীব্র গরমে অসহনীয় দাবদাহে একটু স্বস্তি পেতে গ্রামীণ জনজীবনে প্রতিটি বাড়ির অপরিহার্য সরঞ্জামের নাম হাতপাখা। আর একদিন বাদেই পহেলা বৈশাখ। এই বৈশাখ মাসজুড়ে বরিশাল নগরীসহ জেলার দশ উপজেলার প্রায় দেড় শ’ স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা। গ্রামীণ জীবনের এ মেলার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ তালপাখা। তাই বর্ষবরণকে সামনে রেখে জেলার সর্ববৃহৎ পাখাপল্লী গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী ও উজিরপুর উপজেলার দক্ষিণ মোড়াকাঠি গ্রামের বাড়িতে গত একমাস ধরে তালপাখা তৈরির ধুম পড়েছে। এসব পল্লী ও গ্রামের নারী-পুরুষ সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে তালপাখা তৈরি করতে এখন মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। চাঁদশী গ্রামের পাখাপল্লীতে তৈরি পাখা স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে পাইকারদের মাধ্যমে চলে যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। পল্লীর প্রবীণরা জানায়, বিগত ৩১ বছর ধরে চাঁদশী গ্রামের প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবারের জীবন জীবিকা বাধা পড়েছে তালপাতার হাতপাখায়। গত একমাস ধরে ওই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চলছে পাখা তৈরির কাজ। পুরুষের পাশাপাশি বাড়ির গৃহবধূ থেকে শুরু করে ছেলে-মেয়েরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন পাখা তৈরির কাজে। পাখা তৈরি ও সুতা দিয়ে বাঁধার কাজটি মূলত বাড়ির গৃহবধূ ও মেয়েরাই করে থাকেন। পাখা তৈরির জন্য তালপাতা সংগ্রহ, পাতা ছাঁটাই ও তৈরি পাখা বিক্রির দায়িত্ব পালন করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। পাখাপল্লীর বাসিন্দা ও পাখার কারিগর নাজমুন নাহার, কাজল আক্তার, আসমা বেগম জানান, তাদের বাবা-মায়ের কাছে থেকেই তারা পাখা তৈরির কাজ শিখেছেন। তালের পাতা কাটা ও ছাঁটাই থেকে শুরু করে কয়েক ধাপে শেষ হয় পাখা তৈরির কাজ। পাখা তৈরির শেষধাপে রয়েছে সুতা দিয়ে বাঁধাই। কাজল আক্তার একাই প্রতিদিন একশ’ পাখা বাঁধাই করতে পারেন। এ থেকে প্রতিদিন তার প্রায় একশ’ টাকা আয় হয়। ওই পল্লীর হাসেম খলিফা (৬৭) জানান, গত ২৭ বছর ধরে তিনি পাখা বানানোর কাজ করছেন। তার পরিবারের সদস্যদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে তিনি এখনও এ পেশায় টিকে আছেন। বর্তমানে পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তাল পাতার তীব্র সঙ্কট চলছে। গৌরনদীসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অধিক মূল্যে তাদের তালপাতা ও বাঁশ ক্রয় করতে হচ্ছে। বছরের নয় মাসই তারা এ কাজ করে থাকেন। হাসেমের পরিবারের সাত সদস্য এ কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের পরিবারের সকলে মিলে একদিন দুই থেকে তিন শ’ পিস পাখা তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি পাখা তৈরিতে তাদের খরচ হয় চার টাকা আর পাইকারি হিসেবে তা বিক্রি করছেন ছয় টাকায়। যার খুচরা মূল্য প্রতিটি পাখা দশ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহে একদিন পাইকার এসে বাড়ি থেকে হাত পাখা ক্রয় করে নিয়ে যায়। ওই পাখাপল্লীর তৈরিকৃত হাতপাখা দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন বৈশাখী মেলা, হাট-বাজার, বাসস্ট্যান্ডসহ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে পাইকারদের মাধ্যমে চলে যায় রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। স্থানীয় ইউপি সদস্য বাদশা মিয়া জানান, সরকারী বা বেসরকারীভাবে সুদমুক্ত কিংবা সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হলে জীবন-জীবিকায় বাঁধা পাখাপল্লীর কারিগররা সঠিক মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে। ইউপি চেয়ারম্যান কৃষ্ণ কান্ত দে বলেন, উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির পর অর্থাভাবে এ পেশার সঙ্গে জড়িত আরও প্রায় পঞ্চাশটি পরিবার ইতোমধ্যে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। বাকি পরিবারগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে জরুরী ভিত্তিতে সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণ দেয়া না হলে অচিরেই এসব পরিবারের সদস্যরা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবেন। উজিরপুরের দক্ষিণ মোড়াকাঠি গ্রামে বংশ পরম্পরায় তালপাখা তৈরি করছেন ২০টি পরিবারের সদস্যরা। ওই গ্রামের বাসিন্দা ও নারী কারিগর মাসুমা বেগম জানান, তিনি ৩৫ বছর ধরে তালপাখা তৈরির কাজ করছেন। আগে তার শাশুড়ি, দাদি-শাশুড়িও একই কাজ করতেন। সে হিসেবে শত বছরেরও অধিক সময় ধরে এ গ্রামে পাখা তৈরির কাজ চলছে। আগে পুরো বছরজুড়ে পাখা তৈরির কাজ করা হলেও বর্তমান বাজারে প্লাস্টিকের পাখার একছত্র আধিপত্যে তালপাখার কদর অনেকটাই কমে গেছে। তাছাড়া কাঁচামাল সঙ্কট ও মুনাফা কম হওয়ায় অনেকেই পেশা পাল্টে ফেলছেন। যারা এখনও এ পেশায় নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন তারা বৈশাখী মেলাকে ঘিরে এখন মাত্র দুই মাস পাখা তৈরির কাজ করছেন। বাকি সময় কেউ বর্গাচাষী, কেউবা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। সুলতান আহমেদ নামের এক কারিগর বলেন, প্লাস্টিকের হাতপাখা বের হওয়ার পর তালপাতার হাতপাখার কদর অনেকটাই কমে গেছে। তবে তার চেয়েও বেশি সমস্যা হচ্ছে তাল গাছ কমে যাওয়ায় শুধু বৈশাখী মেলাকে ঘিরে যে পরিমাণ তালপাতার হাতপাখার চাহিদা রয়েছে সেই অনুসারে কাঁচামালের যোগান না থাকায় পর্যাপ্ত তালপাখা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।
×