ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অংশুমান ভৌমিক

‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’ এক উত্তর-ঔপনিবেশিক পাল্লা

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৩ এপ্রিল ২০১৮

‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’ এক উত্তর-ঔপনিবেশিক পাল্লা

থিয়েটার অলিম্পিক্সের কলকাতা পর্বে একটি অদ্ভুত নাটকের দল একটি অদ্ভুত নাটক করে গেল। ১০ মার্চ সন্ধ্যা বেলায় পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে। ইংল্যান্ড থেকে আসা এই দলের নাম ‘মুকুল এ্যান্ড ঘেটো টাইগার্স’। দলের যিনি মাথা সেই মুকুল আহমেদ আদতে বাংলাদেশের। বেশ কিছুকাল লন্ডনে থিতু হয়েছেন। দলের আট আনা লন্ডন থেকে এসেছেন, বাদবাকি জুটেছেন কলকাতা থেকে। এমন জোড়কলম নাটকের দল দিল্লীর ভারত রঙ্গ মহোৎসবে মাঝেসাঝে আসে। এবারে কলকাতায় এলো। তাদের নামধাম শুনে, তাদের নাটকের ছবিছাবা দেখে কলকাতার খানিক কৌতূহল হলো। তাদের নাটকের নামের মধ্যে অবিশ্য অদ্ভুত কিছু ছিল না। ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’। হ্যাঁ, এটি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের সেই রোমান্টিক ট্র্যাজেডি। কিন্তু খালি ইংরেজীতে নয়। ২০১৩ সালে তৈরি হওয়া এই ত্রিভাষিক নাটকে নাকি ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা-হিন্দীও ইস্তেমাল করা হবে। সওয়া চারশ’ বছর আগেকার একটি বিয়োগান্ত প্রণয়নাট্য নিয়ে কোন বহুভাষিক বহুস্তরী নির্মাণ করেছেন মুকুল আহমেদ তা নিয়ে আমাদের কৌতূহল তুঙ্গে উঠল। সরস্বতী বন্দনা দিয়ে নাটক শুরু হতেই বোঝা গেল এটি কেতাবি ঢঙের নাটক নয়। এর উপস্থাপনায় একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক মেজাজ আছে। তুরীয় আন্দাজ আছে। যেন পালাগানের আসরে ঢুকে পড়েছি আমরা। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক বয়াতি (দেলোয়ার হোসেন দিলু) পালা বাঁধতে লেগেছেন। বাজনদারের দল তাঁকে ঘিরে মাটিতে বসে ঢোল, ডুগি-তবলা, হারমোনিয়াম, খঞ্জনি নিয়ে সঙ্গ দিচ্ছেন। আরও আছেন কয়েক জন। পেছন দিকে। মহানন্দে তাল ঠুকছেন তাঁরা। দোহারকি দিচ্ছেন। এতে করে বেশ হুলুস্থূল পড়ে গেছে। একটু বাদেই পালার মোদ্দা কথা বাখান করতে লাগলেন বয়াতি। বুঝলাম কোন এদেশী কিসসা নয়। ভেরোনার কথাই হচ্ছে। বাংলায়। প্রমিত বাংলা নয়, ময়মনসিংহের মিঠে বাংলার চালে। খানিক বাদে জবান পালটাল। শুধু বাংলায় নয়। বয়াতির পেছন থেকে খাঁটি কুইনস ইংলিশে পাশাপাশি বুলি ফোটালেন এক মেমসাহেব। সুজান কেন্ডেল। এক ইংরেজ আর এক বাঙালীকে এভাবে ভাষাভিত্তিক পাল্লা দিতে শুনে মনে হচ্ছিল উত্তর-ঔপনিবেশিক ছোটি সি মুলাকাতের এও এক রকম বটে! যারা বছর ছয়েক আগে নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটারের ‘টেমপেস্ট’ দেখেছিলাম তারা বুঝেছিলাম যে গ্রামবাংলার বুকে বয়ে চলা পালাগানের নানান আঙ্গিককে বিলেতি থিয়েটারের দেহে ঢুকিয়ে দিলে জমকালো এক কালচারাল এনকাউন্টার হয়। দুই পৃিথবীর নাট্যশৈলীর মধ্যে মিল-বেমিলের জায়গা নিয়ে মজাদার কাণ্ডকারখানা হয়। মুকুল আহমেদ আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা এই কালচারাল এনকাউন্টারকে আরও জবরদস্ত করে তুললেন। দেলোয়ার হোসেন দিলুর কলজেয় জোর আছে। সম্প্রীতি সেন, অঙ্কুশ গৌতম ঘোষ কিছু কম যান না। মেম সাহেবদের মধ্যে সুজানের অভিনয়ে বেশ পাক ধরেছে। তাঁর জুড়িদার আনিসা বাট খুব চনমনে। তালবাদ্যে স্বাগত বিশ্বাসও তথৈবচ। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাষার যে কালচারাল রেজিস্ট্রার থাকে, তার গায়ে লেপটে থাকা কালচারাল কোড থাকে তাই নিয়ে সবাই মিলে এনতার লোফালুফি করা হলো। চাইলে দুই পৃথিবীর নীতিমালার তফাত চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারতেন মুকুল। রোমিওর মধ্যে ক্যালিবান আর জুলিয়েটের মধ্যে মিরান্ডার আদল খুঁজতে পারতেন। ঠোকাঠুকির সে পথ তিনি মাড়ালেন না। বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির চেনা ছক মেনে কুশীলবরা মাঝেমাঝেই ভোল পালটালেন। পরিচ্ছেদ আর অঙ্গভাষার সামান্য বদলে চরিত্র পালটে গেল। পারলে ভাষাও পালটালেন। অঙ্কুশ গৌতম তেজ জবানে উর্দু বলেন। তাঁর রোখা মেজাজ আর ঠোকা কপালকে এমনভাবে কাজে লাগানো হলো যে এক সময় মনে হচ্ছিল বুঝি উত্তর ভারতের মাফিয়া রাজত্বে এসে পড়েছি! তাছাড়া স্রেফ পালা নয়, তাঁরা বাংলার আরও ঐতিহ্যবাহী নাট্যের নকশা বুনে দিলেন ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’-এর গায়ে। বিরহের সুর বোনা হলো সিলেটের বিচ্ছেদী গানের আদলে। জুলিয়েটের ব্যালকনিতে খুব এক চোট ঝুলোঝুলি করে চলে যাওয়ার সময় রোমিও গেয়ে উঠলেন ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’। শিউরে উঠলাম। শুধু কুমার শচীন দেববর্মনের সুখস্মৃতি ভেসে এলো বলে নয়, কিভাবে প্রাচ্যের নাড়িছেঁড়া ধন পাশ্চাত্যের ভাবসম্পদে সাঁতার দিতে পারে তার হদিস নির্দেশক করালেন বলে। পরের দৃশ্যে আরও বড় বিস্ময় ছিল। গির্জার যাজকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে গেল প্রেমিক-প্রেমিকা। লোপামুদ্রা গুহনিয়োগির হারমোনিয়ামে বেজে উঠল ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’। লোপামুদ্রা আর তনুশ্রী গুহ গলা মিলিয়ে গেয়েও দিলেন সেই ব্রহ্মসঙ্গীতের দুই তুক। ভাবগম্ভীর মূর্ছনার এই আশ্চর্য প্রয়োগে গ্রেগোরিয়ান চান্টের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীতের অভেদ তৈরি হয়ে গেল। পাশাপাশি হাল আমলের চটুলের চলনের হালকা গান এলো। প্রেম অচরিতার্থ রইল। তবু মন খারাপের মাতন তুলে নাটক শেষ হলো না। শেষ হলো সুরমা উপত্যকার লোকসঙ্গীতের ভাঁড়ার থেকে তুলে আনা দোতারার তালে তালে সুন্দরী কমলার নাচের খেই ধরিয়ে। জুলিয়েটের সঙ্গে রোমিওর প্রণয় যেন শুধু মন্টেগু-ক্যাপুলেট নয়, দুই পৃথিবীর প্রণয়ের কীর্তিফলক হয়ে উঠল। দু’বাড়ির মারপিট সড়কি-তলোয়াল বা গোলাবারুদের বদলে হলো লাঠি দিয়ে। এক ঘণ্টার মধ্যে খেল খতম! তবে এই নাটকের তুরুপের তাস এল রোমিও-জুলিয়েটের বিদায়মুহূর্তে। জুলিয়েট বলল, ‘ফেয়ারওয়েল’। সনাতন খ্রিস্টান কায়দায়। রোমিও জবাব দিল, ‘খোদা হাফেজ’। চোস্ত ইসলামী তরিকায়। ঐ একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে সাতটি অমরাবতী ভর করে রইল। ইয়োরোপ-আরব এই দুই সভ্যতা-সংস্কৃতির সীমারেখায় রোমিও-জুলিয়েটের প্রেমাখ্যান প্রতিস্থাপিত হলো। কথা উঠতে পারে, এত শত করে এত কেটেছেঁটে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কি তেরোটা বাজিয়ে দেয়া হলো না? হলো। ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’-এর মেড ইজি হলো কি? অংশত হলো। অনেক মনে রাখার মতো সংলাপ, চিত্রকল্প রাখা হলো। অনেক হলো না। জুলিয়েটের গলায় ব্যক্তিনামের অনিত্যতা নিয়ে সেই প্রবাদপ্রতিম স্বগতোক্তি খাস বিলিতি জবানে শুনে আরাম হলো। গ্রহ নক্ষত্রের সুতোর টানে মনুষ্যজীবনের নশ্বরতা নিয়ে সংলাপ কানে এলো না বলে আক্ষেপ হলো। মূল রচনার অনেক অংশের সমান্তরাল নির্মাণের চেষ্টায় দুয়েক জায়গায় একটু জবরদস্তি হয়েছে মনে হলো। নাটক যত এগোল, বাংলা-উর্দুকে সরিয়ে ইংরেজির সরদারি বাড়তে থাকল। শেষ দিকে বাঙালীর জবানেও ইংরেজী শুনতে হলো। কানে লাগল। মনেও লাগল। এভাবে কি এ্যাংলোফোন সাম্রাজ্যবাদের সামনে মাথা নুইয়ে গড় করলেন বাঙালী নাট্যকার? হবেও বা! ভুললে চলে না যে ষোড়শ শতকের লন্ডনের সঙ্গে একুশ শতকের লন্ডনের ফারাক আসমান-জমিন। মাটি পালটে গেলে ফারাক আরও বেড়ে যায়। তবু এমন অনেক জায়গা আছে যা আমাদের সমান্তরাল জীবনযাত্রার সূচক। সেগুলোকে মন দিয়ে খুঁজেছেন মুকুল আহমেদ। তাকে সুরে ও বাণীর মালা পরিয়েছেন। তাই তুলনামূলক শেক্সপিয়ার পাঠের এই অভিজ্ঞতা আমাদের ছুঁয়ে গেল।
×