ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাল শহীদ মিনারে নাগরিক শ্রদ্ধা ॥ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৭ মার্চ ২০১৮

চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তাঁর হাতের স্পর্শে মৃত বৃক্ষও যেন পেয়েছে নতুন প্রাণ। অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি, ডালপালা কিংবা শিকড়ের আশ্রয়ে গড়েছেন শিল্পকর্ম। পরিত্যক্ত কাঠের টুকরোয় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পিত অবয়ব। একাত্তরে নির্যাতনের শিকার হওয়া এই তেজস্বী নারী অন্তরের জ্বলে ওঠা শক্তিতে সৃজন করেছেন চোখজুড়ানো ভাস্কর্য। চলে গেলেন প্রাণহীনতার ভেতর প্রাণজাগানো সেই মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলবার তাঁর প্রস্থান ঘটল। এদিন বেলা পৌনে একটায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কার্ডিয়াক এ্যারেস্টে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। রেখে গেছেন ছেলে স্বামী আহসানউল্লাহ, ছেলে কারু তিতাস, মেয়ে ফুলেশ্বরীসহ ছয় ছেলে-মেয়ে এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী। মঙ্গলবার ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বারিধারার পিংক সিটিতে। সেখানে গোসল সেরে শবদেহ রাখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) হিমাগারে। পরিবারের পক্ষ থেকে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ সামাদ জানান, কাল বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটা থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নাগরিক শ্রদ্ধা জানানো হবে। এরপর বাদ জোহর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে। এছাড়া শনিবার বিকেল চারটায় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় তার নাগরিক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রিয়ভাষিণীর প্রয়াণের খবরে শিল্প-সংস্কৃতি ও রাজনীতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অনেকেই ছুটে যান হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ছিলেন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান, গণজাগরণমঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার, প্রকাশক রবিন আহসান প্রমুখ। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোক জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। শোকবাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রিয়ভাষিণীর অবদান চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে জাতি। প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যুকে দেশের ভাস্কর্যশিল্পের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন শিল্পীর মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, আমার মা নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন এই দেশকে। মৃত্যুর আগেও তিনি দেশের কথা বলে গেছেন। এ দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা নিয়ে তিনি চলে গেলেন। শাহরিয়ার কবির বলেন, একাত্তরের পর সামাজিক নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অসম সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। তিনি আমাদের অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। মহান এই মুক্তিযোদ্ধা একসময় ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির কথা তুলে ধরেছেন। তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের সাহস যুগিয়েছেন। পরে আমরা একাত্তরের সেসব ঘটনার কথা ধারাবাহিকভাবে জানতে পারি। নীরবতার দেয়াল ভেঙ্গে তারা যে এগিয়ে এসেছেন, সেখানেও রয়েছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বড় অবদান। খুশী কবির বলেন, সারা জীবন তিনি শুধু বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। তিনি অসম সাহসিকতার সঙ্গে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তাতে আমাদের আরও অনেক কিছু শেখার আছে। তার আদর্শ ধারণ করে আমরা যদি সামনে এগিয়ে যেতে পারি, তবেই তার প্রতি আমাদের সম্মান জানানো হবে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মৃত্যুর বিষয়ে ছেলে কারু তিতাস বলেন, মা দীর্ঘদিন ধরেই নানা রোগে ভুগছিলেন। সর্বশেষ তিনি গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে মঙ্গলবার দুপুরে তার একটি ‘কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট’ হয়। এরপর পৌনে এক ঘণ্টা চিকিৎসকদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, আজ শুধু আমার মা মারা যাননি, আপনাদেরও মা মারা গেছেন। কারণ, আপনারা এমনই সম্মান করতেন। আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন জানিয়ে ল্যাবএইডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুর রহমান লেনিন বলেন, তিন দফায় তিনি ল্যাবএইডে ভর্তি ছিলেন। এছাড়াও তিনি (বিএসএমএমইউ-তে ভর্তি ছিলেন। সবশেষে তিনি ২৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এখানে ভর্তি হন। এ সময় তার কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ে। সে সময় তাকে অধ্যাপক ডাঃ রফিকুল আলমের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করা হয়। এছাড়াও তার পায়ে ছোট একটা ফ্র্যাকচার ছিল পায়ে। অধ্যাপক ডাঃ আমজাদ হোসেন তার পায়ে অস্ত্রোপচার করেন। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত তিনি কেবিনে ছিলেন। পরে বেলা বারোটায় তার কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়। পৌনে এক ঘণ্টা চিকিৎসকদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। গত বছর ৪ নবেম্বর নিজের বাসায় বাথরুমে পড়ে গোড়ালিতে আঘাত পান। তখন তার গোড়ালির একটি হাড় স্থানচ্যুত হয়। শিল্পীর জীবনকথন॥্ দেশের ভাস্কর্যশিল্পের অনন্য এক শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। মূলত ঘর সাজানোয় দামী জিনিসের পরিবর্তে সহজলভ্য জিনিস কিভাবে সাজানো যায় তার সন্ধান থেকেই শুরু হয় এই শিল্পীর শিল্পচর্চা। নিম্ন-আয়ের মানুষেরা কিভাবে অল্প খরচে সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে পারে সে বিষয়গুলো তিনি দেখিয়েছেন। সেই সুবাদে ঝরা পাতা, মরা ডাল, গাছের গুঁড়ি দিয়ে গড়েছেন অনন্য সব ভাস্কর্য। যার মাঝে উঠে এসেছে নদী, নৌকা, নারী, গ্রামীণ জীবনসহ এই জনপদের সৌন্দর্যস্নাত নানা বিষয়। খুলনার ডাকবাংলোর মোড়ে ‘ফেয়ারি কুইন’ নামের বাড়িতে ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন দেশবরেণ্য ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। সৈয়দ মাহবুবুল হক ও রওশন হাসিনা দম্পতির ১১ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার নানা যুক্তফ্রন্টের শাসনকালের স্পীকার এ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিমের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে (বর্তমানে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়) তার শিক্ষাজীবন শুরু। পরবর্তীতে তিনি খুলনার পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও খুলনা গার্লস স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রী পাস করেন। ১৯৬৩ সালে প্রথম বিয়ে করেন প্রিয়ভাষিণী। ১৯৭১ সালে তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে তিনি সন্তানদের নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেন। সেই অস্থির সময়ে তার ভাঙা সংসারের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। এরপর তাকে পার করতে হয়েছে দুঃসহ জীবন। সংস্কৃতিচর্চা করে আসা যে খালা-মামারা, পাক হানাদারদের নির্যাতনের পর তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ১৯৭২ সালে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তার দ্বিতীয় স্বামী আহসান উল্লাহ ছিলেন সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। প্রিয়ভাষিণীর তিন ছেলে কারু তিতাস, নাসের তাপস ও কাজী সাকের তূর্য এবং তিন মেয়ে ফুলেশ^রী প্রিয়নন্দিনী, রাজেশ^রী ও রতœশ^রী প্রিয়রঞ্জনি। এর মধ্যে মেজ মেয়ে রাজেশ^রী মারা গেছেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রিয়ভাষিণী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। টেলিফোন অপারেটর হিসেবে যেমন কারখানায় কাজ করেছেন, তেমনি ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, এফএও ও কানাডিয়ান দূতাবাসেও চাকরি করেন। প্রিয়ভাষিণীর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয় যশোরে শিল্পকলা একাডেমিতে। বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান সেই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। শিল্পকলায় অবদান রাখায় তিনি ২০১০ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। এছাড়াও তিনি চাদেরনাথ পদক, অনন্যা শীর্ষ দশ পদক, রৌপ্য জয়ন্তী পুরস্কার (ওয়াইডব্লিউসিএ)-সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ২০১৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘নিন্দিত নন্দন’।
×