যে ভাষণ মুহূর্তেই মানুষকে নিয়ে যায় ভয়ভীতিমুক্ত অনন্য উচ্চতায়

মোরসালিন মিজান ॥ লক্ষ কোটি জনতার সমাবেশ। কানায় কানায় পূর্ণ রেসকোর্স ময়দান। মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন বাঙালীর বিস্ময়পুরুষ ‘তোমার নেতা আমার নেতা/শেখ মুজিব শেখ মুজিব’! মুহূর্তেই উত্তাল হয়ে উঠল জনসমুদ্র। ঢেউ খেলে গেল। আর তার পর ঐতিহাসিক ভাষণ। মাত্র ১৭ মিনিটের একটি ভাষণ রচনা করল নতুন ইতিহাস। অমর কবিতা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। স্বাধীনতার গোলাপ হয়ে ফুটল। ১৯৭১ সালে দেয়া এ ভাষণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক বিশ্বখ্যাত জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ এবং আগামীর বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোর প্রধান ভিত্তি ৭ মার্চের ভাষণ। আজকের সংবিধান ও সংসদের ভিত্তি। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়ায় ভাষণটি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো ভাষণটিকে বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। বলা বাহুল্য, গোটা ভাষণটি ছিল অলিখিত। বুকে জমা কথাগুলোই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ ক্ষেত্রে তাঁকে নিজের ওপর ভরসা রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রিয়তম পতœী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একটি লেখা থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়। অশান্ত মুজিবকে ফজিলাতুন্নেসা বলেছিলেন, ‘তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত, তাই তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটাই ঠিক হবে। দেশের মানুষ তোমাকে ভালবাসে, ভরসা করে।’ বলা বাহুল্য, তা-ই করেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। নিজের বিবেচনায় যা বলা দরকার, বলেছিলেন। যেটুকু বলার তার বাইরে তিনি যাননি। এ কারণেই হয়ত ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অংশ হয়েছে ভাষণটি। দীর্ঘকাল পার হলেও, এ নিয়ে চলছে গবেষণা। বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ নতুন করে বুঝতে সাহায্য করে ৭ মার্চের ভাষণের মাহাত্ম্য। স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ হলেও, বাঙালী এই ভাষণটিকে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কৌঁসুলী শেখ মুজিব এদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, বলার খুব কিছু বাদ রাখেননি। আরও অনেকের জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ৭ মার্চকে স্বাধীনতা ঘোষণার দিন বলেই মানেন। এ সংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, একাত্তরের প্রবাসী সরকার বিভিন্ন বিবেচনায় ছাব্বিশে মার্চকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এতে করে ৭ মার্চের গুরুত্ব হারায়নি। বরং গুরুত্বের ভিত্তি মজবুত হয়েছে। নিজ কানে ভাষণ শোনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এক নিবন্ধে দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘আমার অবয়বকে আমি যথার্থই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। দেহ আমার দীর্ঘ হচ্ছিল। শরীরে আমার রোমাঞ্চ জাগছিল। সাহস বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর তাই পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে সগর্জনে যখন যাওয়া-আসা করছিল এবং সে বিমান থেকে যে কোন মুহূর্তে যে মৃত্যুর বান আমার বুকে এসে বিঁধতে পারে, সে কথা জেনেও আমার পা একটুও কাঁপছিল না।’ ৭ মার্চের জনসমুদ্রে উত্তাল ঢেউ হয়ে এসেছিলেন শেখ মুজিব। সেখানে তিনি ছিলেন মহানায়ক। গাজী আজিজুর রহমানের বর্ণনায়, ‘সেদিনের ১৯ মিনিটের বিকেলটা ছিল শুধু তাঁর। সেদিন আর কোন দৃশ্য ছিল না তাঁর দৃশ্য ছাড়া। সেদিন আর কোন কণ্ঠস্বর ছিল না তাঁর কণ্ঠস্বর ছাড়া। সেদিন একটিমাত্র নদী কলস্বরিত ছিল বাঙলায়। সেদিন তিনিই ছিলেন বাঙলার দিনমণি-অংশুমলী। সেদিন সবাই দেখল এক প্রমিথিউসকে, এক হারকিউলিসকেÑ দেখল স্পার্টাকাসরূপী এক অবিসংবাদিত ত্রাতাকে।’ ভাষণটিকে অতি বাস্তব, ইতিহাসনিষ্ঠ, ঐশ্বর্যম-িত বলিষ্ঠ, কবিত্বময়, নাটকীয় এবং একটি নিষ্পেষিত জাতির মুক্তির দলিল হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। লিখেছেন, ‘কথোপকথনের ভঙ্গিতে সাবলীল ভাষায় বর্ণিত এর আবেগ, সজীবতা, নাটকীয়তা, দিকনির্দেশনা, প্রমিত আঞ্চলিক বিদেশী ভাষার মিথস্ক্রিয়া, আপনি তুমি সর্বনামের সম্ভ্রমমূলক ব্যবহার, বজ্রকণ্ঠের বাগবৈদগ্ধ, সম্মোহিত করার জাদুকরি আকর্ষণ, মন্ত্রমুগ্ধতা, যুদ্ধ ঘোষণা করেও যুদ্ধে অবতীর্ণ না হওয়ার কৌশলÑ সব মিলে একই অঙ্গে এত রূপের প্রাচুর্যের কারণেই এই ভাষণের শ্রেষ্ঠত্ব।’ একই রকম আবেগ নিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করেছেন ড. আবুল হাসান চৌধুরী। তাঁর মতে, ‘এক বিশাল জনগোষ্ঠীর হৃদয়স্পর্শী ৭ মার্চের ভাষণটি ১৯৭১ সালের মুক্তিকামী বাঙালীর আবেগ, উদ্দীপনা ও সংগ্রামী চেতনার দ্যোতনায় অসাধারণ কবিত্বময়Ñ এর ভাব, ভাষা, উপমা ও উচ্চারণ গণমানুষের উন্মুখ অন্তরকে স্পর্শ করতে সক্ষম। লোকসাহিত্যের প্রকাশে যে অকপট সারল্য ও সৌন্দর্য থাকে, থাকে সমবেত শ্রোতাসাধারণের মন জয় করার কিংবা তাদের সম্মোহিত করার জাদুকরি ক্ষমতা, বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটিরও সেই সরল সৌন্দর্য ও জাদুকরি ক্ষমতা ছিল এবং এখনও আছে।’ যোগাযোগ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হয়েছে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সেদিকটি নিয়ে গবেষণা করে লিখেছেন, ‘সম্প্রচারতত্ত্বে প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আদর্শ হিসাব। প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এ কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন। এক হাজার এক শত সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোন বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি নেই, কোন বাহুল্য নেইÑ আছে শুধু সারকথা, সারমর্ম। তবে দু-একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের অন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করেছে।’ শুধু বাংলাদেশের বিবেচনায় সেরা নয়, ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর অন্যতম। নানা বিবেচনায় এই ভাষণ আর সব ভাষণকে এমনকি পেছনে ফেলে দেয়। বিশ্বের সেরা ৩১টি ভাষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. জালাল ফিরোজ। সেখানে ৭ মার্চের ভাষণের অবস্থানটি কোথায়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেস’, উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস’, জওহর লাল নেহেরুর ‘ট্রাইস্ট ইউথ ডেস্টিনি’, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’Ñ বিখ্যাত এই চার ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেছেন শেখ মুজিবের ভাষণটিকে। তুলনামূলক আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার কাব্যিক এরকম ঘোষণা সত্যি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ও অতুলনীয়। অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অসাধারণ দিক হলো, এর নিখাদ মৌলিকত্ব। বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে তিনি বলেন, জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ৭ মার্চের ভাষণের প্রতি যে রকম বহুপাক্ষিক আগ্রহ ছিল তা বিশ্বের অন্য কোন ভাষণের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি জানান, ৭ মার্চের সভায় ১০ লাখের বেশি লোক হয়েছিল। ৪ জন বক্তার তুলনায় নয় শুধু মানব ইতিহাসের বড় রাজনৈতিক জনসভা। লিংকন চার্চিল কিংবা নেহেরুর ভাষণের খবর সংবাদপত্র ও অন্য মাধ্যমে প্রকাশিত প্রচারিত হলেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মতো এত গুরুত্ব পায়নি বলে জানান তিনি। বলেন, কেবল তাৎক্ষণিক প্রয়োজন নয়, ৭ মার্চের ভাষণের এমন অনেক উপাদান রয়েছে যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিক ঔধার্য্য, সামরিক কৌশল এবং রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠন ইত্যাদি ক্ষেত্রে চিরকালীন ও সার্বজনীন স্বীকৃতিও লাভ করতে পারে। এ সংক্রান্ত নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ভাষণ প্রদানের সময় বক্তার রাজনৈতিক/রাষ্ট্রীয় অবস্থান, ক্ষমতা কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর কর্তৃত্ব, জনসভা/অনুষ্ঠানে শ্রোতার সংখ্যা, শ্রোতার সঙ্গে বক্তার সম্মোহনী সম্পর্ক, ভাষণের যোগাযোগ ক্ষমতা, বিষয় উপস্থাপনা স্টাইলের মৌলিকত্ব, বক্তব্যের সুস্পষ্ট ও ইঙ্গিতময় প্রকাশ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ভাষণের তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারি প্রভাব এবং বক্তব্যের চিরকালীন সর্বজনীন আবেদন সব মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অন্য ভাষণের চেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং সকল বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ দাবিদার। ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ‘ভাষা জাদু : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, ‘একজন মানুষ এত সহজ ভাষায় মানুষের মনের ভেতরে, মাথার ভেতরে, রক্তের ভেতরে কিভাবে ঢুকে যেতে পারেন, তার প্রমাণ একাত্তরের ৭ মার্চ আমি পেয়েছিলাম। পরে তিনি লিখেছেন, হৃদবৃত্তিক ভাষা-নির্মিতির আবেগিক আবাহন সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে লৌকিক এবং শিক্ষা জাগতিক ভাষার এক ভাষিক ইফেক্টস ডেভোকেসন ডান মিলকু সৃষ্টি করেছেন, যা স্বভাবত অভিব্যক্তির বিষয়কেন্দ্রিক দার্শনিক সিদ্ধতা লাভ করেছেÑ আবার বাংলাদেশের ভূমি বিন্যাস অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তা বলয়ে মুক্তি সংগ্রামের আর স্বাধীনতার দৃঢ়প্রকাশ, যা হলোÑ আমাদের সংগ্রাম ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ আমাদের ‘এবারের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষণের বিশ্লেষণ করেছেন অনেকেই। তাঁদের একজন এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। ভাষণের শেষ অংশ বিশেষভাবে আকর্ষণ করে তাঁকে। সেখানে নেতা প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিচ্ছেন। জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু বন্ধ করে দিতে বলছেন। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তাঁর হুঁশিয়ারিÑ আমরা ভাতে মারব। পানিতে মারব। এমন আরও কিছু নির্দেশনা এক সূত্রে গেঁথে ভাষণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন তিনি। সদ্য প্রয়াত লেখক গবেষক ড. আবদুল ওয়াহাব ৭ মার্চের ভাষণে খুঁজে পেয়েছিলেন সমাজতত্ত্বের উপাদান। তাঁর মতে, ৭ মার্চের ভাষণের প্রথম প্যারায় একটি বাক্য এরকমÑ আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তাঁর অধিকার চায়। এই মুক্তি চাওয়া, বাঁচতে চাওয়া এবং অধিকার চাওয়ার প্রশ্নই সমাজতত্ত্বের মূল ভিত্তি। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন লেখায় গবেষণায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে ৭ মার্চ। ঐতিহাসিক এই ভাষণ নিয়ে আরও গবেষণা হবে। ভাষণের মাঝে বাঙালী নিজেকে আবিষ্কার করবে। বাঙালীর স্বরূপে উদ্ভাসনের দিন হয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে ৭ মার্চ।