ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানী এখন মশার দখলে

মশক নিধনের উদ্যোগ দুই সিটি কর্পোরেশনের

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৬ মার্চ ২০১৮

মশক নিধনের উদ্যোগ দুই সিটি কর্পোরেশনের

মশিউর রহমান খান ॥ ঘরে মশা বাইরে মশা, অফিস আদালতেও মশা, এমনকি পাবলিক যানবাহনের ভেতরেও মশা। রাতেরবেলায় তো বটেই দিনেরবেলায়ও মশার যন্ত্রণায় ঘরে বসে থাকতে পারছে না রাজধানীবাসী। মশার অত্যাচারে বাধ্য হয়ে দিনেরবেলায়ও কেউ কেউ মশারি টানিয়ে ঘুমাচ্ছেন। মশার যন্ত্রণায় এক প্রকারের অতীষ্ঠ রাজধানীর মানুষ। দিনেরবেলায় কয়েল জ্বালিয়েও মশক নিধন করছে সাধারণ মানুষ। বস্তি থেকে শুরু করে প্রাসাদসম অট্টালিকায়ও মশা ছড়িয়ে পড়েছে। এ যেন মশারা রাজধানীতে রামরাজত্ব কায়েম করেছে। ড্রেন, কালভার্ট, খোলা স্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও মশার প্রজনন ক্ষেত্রে ওষুধ ছিটিয়ে সময়মতো ধ্বংস না করায় মশার ভয়ানক অত্যাচার সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দুই সিটি কর্পোরেশন; যার কুফল ভোগ করছেন রাজধানীর বাসিন্দা। আশার কথা হলো, দেরিতে হলেও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মশক নিধনে নেমেছে। তবে এখনও অনেকটা মশাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে পুরো রাজধানী। পাশাপাশি মশার অত্যাচারের কথা স্বয়ং মেয়রও স্বীকার করছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে মশক নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ, হটলাইন বা হেল্পলাইন চালু, ওয়ার্ডভিত্তিক সকল জনবল নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়া নাগরিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে মশার উৎপাত বন্ধ করতে যে কোন এলাকায় মশার সমস্যা দেখলেই হটলাইন ও হেল্পলাইন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। মশক নিয়ন্ত্রণ ও মশার ওষুধ ছিটানোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা পালন করছে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরগণ সিটি কর্পোরেশন সূত্র জনায়, সংস্থাটির অন্যান্য বাজেটের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়েই মশা নিয়ন্ত্রণের বাজেট তৈরি করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে বাজেট ধরা হয় ১০ কোটি টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ২৪ কোটি, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ২৩ কোটি ২৫ লাখ ও ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে কিছুটা কমিয়ে ২০ কোটি করা হয়। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বাজেট করেছিল ১০ কোটি ৩০ লাখ, পরে সংশোধিত বাজেট বাড়িয়ে ১১ কোটি ৯৯ লাখ করা হয়। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১২ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি ৫০ লাখ ও ২০১৭-২০১৮ সালে বিগত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ করে ২৫ কোটি ৬০ লাখ করা হয়। কিন্তু দুই সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার বাজেট করেও তারা মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। দিন দিন মশার অত্যাচার বেড়েই চলছে। সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৬৫৩ মেশিনের মধ্যে ৩৮৭টি হস্তচালিত, ২শ’ ৫৫টি ফগার মেশিন, ১০টি হুইল ব্যারো এবং একটি ভেহিকল মাউন্টেড মেশিন রয়েছে। কিছু মেশিন বিকল রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ সিটির ৯শ’ ৪০টি মেশিনের মধ্যে ৪শ’ ৪২টি হস্তচালিত, ৪শ’ ৪৭টি ফগার ও ৫১টি হুইল ব্যারো মেশিন রয়েছে। তাদের কিছু মেশিন ভালভাবে কাজ করছে না। এ সংখ্যক মেশিন মশক নিধনে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনদুপুরে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় মশার আগ্রাসী আক্রমণ। এ আক্রমণ থেকে বাঁচতে মশারির পাশাপাশি কয়েল, মশারোধক স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাট ও গোলক ব্যবহার করছেন মানুষ। যাদের এসব কিছুই কেনার সামর্থ্য নেই তাদের একমাত্র ভরসা সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কর্মীর ছিটানো ওষুধ। নামমাত্র ওষুধ ছিটিয়ে পার হয়ে যাচ্ছেন কর্মীরা এমন অভিযোগ সর্বত্র। হালে তাদের দেখা পাওয়া যেন অনেকটা সৌভাগ্যের বিষয়। তাই ঢাকার নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী ও বস্তিবাসীদের বাধ্য হয়ে মশার অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। নগরবাসীর অভিযোগ, অনেকটা মানহীন বা মশা নিধনে অক্ষম বা তুলনামূলক কম শক্তিশালী ওষুধ প্রয়োগের কারণে ও মশার উৎপত্তিস্থল থেকে মশার বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কর্মীদের মাঝেমধ্যে ওষুধ দিতে দেখা গেলেও নিয়মিত তাদের দেখা পাওয়া যায় না। এমনকি পর্যাপ্ত ওষুধও দেয়া হচ্ছে না। প্রতিটি এলাকার কয়েকটিস্থানে ওষুধ ছিটিয়ে দিয়ে চলে যায়। ফলে মশার অত্যাচার প্রতিনিয়তই বেড়েই চলছে। এছাড়া বাজারে প্রচলিত নিম্নমানের কয়েল জ্বালিয়েও কোনভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না মশাদের। এছাড়া নিচু অঞ্চলের খাল, ডোবানালা ও জলাশয় ময়লার ভাগাড়ের কারণে প্রায় সারা বছরই পানি জমে থাকে। সেখানেই মারাত্মক রোগ বহনকারী মশা জন্ম নিচ্ছে। সরেজমিন নগরীর উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কালসী, ভাসানটেক, কল্যাণপুর, দারুসসালাম, লালমাটিয়া, তেজগাঁও, বেগুনবাড়ি, নাখালপাড়া, মহাখালী, বিশ্বরোড, বাড্ডা, মগবাজার ও উত্তরা দক্ষিণ সিটি কর্র্পোরেশন এলাকার, বাসাব, খিলগাঁও, মুগদা, মানিকনগর, কমলাপুর, যাত্রবাড়ী, সায়েদাবাদ, টিকাটুলি, ধানম-ি, কাঁঠালবাগান, পরিবাগ, নাজিমউদ্দিন রোড, চকবাজার, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার, বকশীবাজার, সদরঘাটসহ কিছু এলাকার বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে মশার উৎপাতের কথা জানা যায়। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শীত মৌসুম এলেই মশার যন্ত্রণা শুরু হয় যার শেষ হয় বৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত। নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ খাল-জলাশয়ের বেহাল দশা। ময়লা আবর্জনা, কচুরিপানা, কোথাও কোথাও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি জমে থেকে সেখানেই মশার লার্ভার সৃষ্টি হচ্ছে। গুলশান, বনানী ও হাতিরঝিল লেকেও মশার জন্ম হচ্ছে। এছাড়া বনশ্রী, খিলগাঁও, গোড়ান, বাড্ডা, বাসাবো, মুগদা শনিরআখড়া, দোলাইপাড়, কল্যাণপুর, মিরপুর, আদাবর, মোহাম্মদপুরের খাল-জলাশয়ে মশার জন্ম হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা এসব জলাশয়কে মশার খামার বলেও আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমানে ঢাকার বেশিরভাগ এলাকার খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে থাকায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। স্থির পানিতে জন্মাচ্ছে মশা। সূত্র জানায়, ঢাকার খাল-জলাশয়গুলো ওয়াসা ছাড়াও কয়েকটি সংস্থার। গুলশান, বনানী ও উত্তরার কয়েকটি লেকের মালিক রাজউক। এছাড়াও গৃহায়ণ ও গণপূত মন্ত্রণালয়, রেলওয়ের কয়েকটি খাল রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলেঅ এসব খালের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় নোংরা পানিতে মশার জন্ম হচ্ছে। এদিকে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নারগিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চিকুনগুনিয়াসহ যে কোন প্রকার মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন সংস্থাটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। একই সঙ্গে গতবছরের মতো চিকনগুনিয়া রোগ যাতে কাউকে ভোগাতে না পারে, সেজন্য রাজধানীবাসীকে এবার আগেভাগেই সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন মেয়র। শীত শেষে নগরীতে মশার উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় ডিএসসিসি বুধবার এলাকায় মশক নিধনে ‘ক্রাশ প্রোগ্রামের’ উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় মেয়র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভেতরে নিজের হাতে ফগার মেশিন দিয়ে মশার ওষুধ ছিটিয়ে এ কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন। নগরবাসীকে মশার অত্যাচার থেকে বাঁচাতে ডিএনসিসি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সোমবার রাজধানীর উত্তরা ও মানিকমিয়া এ্যাাভিনিউতে একযোগে ক্রাশ প্রোগ্রামের উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া মঙ্গলবার গুলশান এলাকার জন্য নগর ভবন থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উত্তর সিটিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মশক নিধনের বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। পরবর্তীতে চাহিদার প্রেক্ষিতে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ক্রাশ প্রোগ্রাম কার্যক্রম আরও দুই সপ্তাহ বর্ধিত করা হয়। উত্তরের সব এলাকাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ২শ’ ৮৪ কর্মী কাজ করছেন। এছাড়া মশক নিধনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে কেউ কল করেই প্রতিদিন সকাল ৯ থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হট লাইন বা হেল্প লাইনের মাধ্যমে সেবা পেতে পারেন। উল্লেখ্য, গত বছর রাজধানীতে চিকনগুনিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রাজধানীর সর্বস্তরের নাগরিকদের মাঝে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে নাগরিকগণ আশা করেন, দুই সিটি কর্র্তৃপক্ষ এমন উদ্যোগ নেবে যাতে এ বছর মশার উপদ্রব তুলনামূলক কম থাকবে। কিন্তু বাস্তবে বিপরীত অবস্থাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
×