ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দৃপ্ত চেতনার পথ

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দৃপ্ত চেতনার পথ

মনোয়ার হোসেন ॥ দিনটি ছিল মাথানত না করার। শোকের শক্তিতে আহরিত মাতৃভাষার গৌরবগাথার। মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষার অহঙ্কারমাখা দিবসটির সূচনায় ছিল একুশের প্রথম প্রহরকে সঙ্গী করা রাত। এরপর রাত পেরিয়ে ভোর, সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যাÑদিনভর উচ্চারিত হয়েছে ভাষার চেতনায় জ্বলে ওঠা অমর একুশে ফেব্রুয়ারির জয়গান। সেই চেতনার বিচ্ছুরণ ছড়িয়েছে রাজধানীসহ বাংলাদেশে। ভাষাশহীদদের রক্তঋণের দৃপ্ত সেই চেতনার সিঁড়ি বেয়ে প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রীতির কথা। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। এসেছে জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি। শহরের পথে-প্রান্তে দেখা গেছে বর্ণমালার মিছিল। নারী-শিশু কিংবা পুরুষের হাতে হাতে অহঙ্কার নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে মমতামাখা শোলার তৈরি অক্ষরগুলো। একুশের প্রভাতফেরিতে নিবেদিত ফুলের সঙ্গে ঠাঁই করে নিয়েছিল মাতৃভাষার স্মারকসমূহ। বায়ান্নর ভাষাশহীদদের জন্য শোকগাথা পরিণত হয়েছে প্রেরণার উৎসে। কবিতার পঙ্ক্তিমালায় পূর্বপুরুষের ভাষার লড়াইয়ের অতীত গৌরব স্মরণে ব্যক্ত হয়েছে- মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না/বলো, মা, তাই কি হয়? বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা সে কথাকে সত্য হতে দেয়নি। আত্মপরিচয়ের প্রতিজ্ঞায় অবিচল থেকে রক্ষা করেছিল মায়ের ভাষা ও জাতিসত্তার পরিচয়কে। বুকের রক্ত ঢেলে শামিল হয়েছিল বায়ান্নর ভাষাযুদ্ধে। ছেলেহারা মায়ের অশ্রু গড়িয়ে এসেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষার জন্য মৃত্যুকে যাঁরা ভয় না করে বরণ করেছিল সেই সব শহীদরা দিনটিতে পেয়েছেন অমরত্মের মর্যাদায় আপামর মানুষের পরম ভালবাসা। কবির ভাষায়- অজস্র দিনের মধ্যে জ্বলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি/সালাম বরকত শফি রফিক জব্বার/আত্মায় আহত হয়ে তুলেছে উদ্দীপ্ত তরবারি ...। বুধবার ছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা শহীদদের বুকের রক্তভেজা সেই দিন। জাতিসত্তার চেতনাস্নাত মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিবসটিতে সকাল থেকে রাত অবধি একুশের মর্মবাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাঙালীর হৃদয়ের গহীনে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়েছে বর্ণমালার জন্য প্রাণ সঁপে দেওয়া ভাষাশহীদদের। ভাষা আন্দোলনের স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেমে এসেছিল শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আসা মানুষের জনস্রোত। রাজধানীর সব পথ মিশে গিয়েছিল এই স্মৃতির মিনারে। পুষ্পাঞ্জলি অর্পিত সেই শ্রদ্ধা নিবেদনে ব্যক্ত হয়েছে অশুভ শক্তিকে হটিয়ে কল্যাণময় মানবিক দেশ গড়ার প্রত্যয়। উচ্চারিত হয়েছে উচ্চ আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি। বলা হয়েছে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের কথা। মাতৃভাষার উদযাপনে জানানো হয়েছে সাইন বোর্ড বা লোগো থেকে ইংরেজী হরফের পরিবর্তে বাংলা বর্ণমালা যুক্ত করার দাবি। একুশের নানা আনুষ্ঠানিকতায় প্রকাশিত হয়েছে অপশক্তিকে রুখে দিয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে দারিদ্র্যমুক্ত স্বনির্ভর স্বদেশ নির্মাণের আকাক্সক্ষা। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার দিনটিতে উচ্চারিত হয়েছে বিশ্ব দরবারে মর্যাদাসম্পন্ন জাতির পরিচয় গড়ে নেয়ার কথা। পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুসম্পন্নভাবে এগিয়ে যাওয়ায় স্বস্তির সুবাতাসের কথা বলেছেন একুশ উদ্্যাপনে আসা দেশকে ভালবাসা মানুষেরা। এভাবেই ভাষাশহীদদের প্রতি ভালবাসা ও আগামীর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভাবনায় সারাদেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। ভাষাশহীদদের স্মরণে এদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সবখানে উড়েছে শোকের কালো পতাকা। একুশকে স্মরণ করা মানুষেরা ধারণ করেছেন কালো ব্যাজ। দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ও নিবন্ধ। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিনভর প্রচার করেছে একুশের নানা অনুষ্ঠানমালা। সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো পালন করেছে বিশেষ কর্মসূচী। হয়েছে পাড়া-মহল্লায় একুশের অনুষ্ঠান। রাজধানীর অজস্র স্কুলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ গান-কবিতায় সাজানো অনুষ্ঠান। একুশকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষ পথে নামলেও ঘটেনি নিরাপত্তাজনিত কোন সমস্যা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা। বিঘœ ঘটেনি শোককে ছাপিয়ে সাংস্কৃতিক উদ্যাপনে পরিণত হওয়া উচ্ছ্বাসের আবাহনে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই শহীদ মিনারে শুরু হয় ভাষাশহীদদের নিবেদিত শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব। মাতৃভাষার গর্বের অনুভব নিয়ে ভোরবেলার প্রভাতফেরিতে শামিল হয়েছে শেকড়সন্ধানী বাঙালী। প্রভাতফেরি শেষ করে অনেকেই ছুটে গেছেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। কেউ বা বাংলা একাডেমির মেলা মঞ্চে বসে শুনেছেন স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির উন্মুক্ত আঙ্গিনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ প্রীতি বিতর্ক। ‘কাটাতার উত্তর নয়, এক দীর্ঘ প্রশ্ন’ বিষয়ের পক্ষে যুক্তিনির্ভর তর্ক করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার্কিক শিক্ষার্থীরা। আর বিপক্ষে যুক্তি খ-ন করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার্কিকরা। বসন্ত দুপুরে শহীদ মিনারে দেশী-বিদেশী শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। দেশের শিল্পীদের সঙ্গে ভিন্ন ভাষার গান পরিবেশন করেন বিদেশী শিল্পীরা। ভিন্ন ভাষাভাষীদের অংশগহণে পরিবেশিত হয়েছে সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশনা। স্বদেশের শিল্পীদের পরিবেশনায় অংশ নেন ফিলিপিন্স, ডেনমার্ক, নেপাল, ফ্রান্স, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, স্পেন, কোরিয়া, ইন্ডিয়া ও জাপানের শিল্পীরা। এ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। বসন্ত বিকেলে ধানম-ির রবীন্দ্রসরোবরে ছিল নৃত্য-গীত কবিতায় সাজানো সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একুশের অনুষ্ঠানমালা। সন্ধ্যায় গানের সুরে ও নাট্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পোশাকের সঙ্গে মননের চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে ফাগুন দিনে রাজধানীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছে শহরবাসী। বাবা-মার সঙ্গে বেরুনো শিশুদের কোমল গালে জুড়ে বসেছিল শহীদ মিনার কিংবা বর্ণমালা আঁকা আল্পনা। সবকিছুর মাঝেই যেন ছিল ভাষা আন্দোলন থেকে আহরিত বিপ্লবী চেতনার বহ্নিশিখা। শহরময় যেন নাগরিকদের সঙ্গী করে প্রাণের ভাষা যেন হেঁটে বেরিয়েছে তার বর্ণমালাদের নিয়ে। কবির কথায়Ñ ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে/থেকে থেকেই ডাকে/তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো/আমি যে তার নাম রেখেছি আশা/নাম দিয়েছি ভাষা ...। মায়ের ভাষার জন্য মৃত্যুকে যাঁরা ভয় না করে বরণ করেছিল সেই সব শহীদরা দিনটিতে পেয়েছেন অমরত্মের মর্যাদায় আপামর মানুষের পরম ভালবাসা। একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেশজুড়েই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়েছে ভাষাশহীদদের। একুশের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় নেপথ্যে বেজে ওঠে অমর একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ ভাষাযোদ্ধাদের নিবেদিত পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ শেষে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এরপর একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিন বাহিনীর প্রধানসহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের কূটনেতিক মিশনের প্রতিনিধিরা। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে দলের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সকালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে উচ্চ আদালতসহ সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে রাত ১টার পর শহীদ মিনার খুলে দেয়া হয় সবার জন্য। ততক্ষণে মিনারের চারপাশে ঢল নামে সাধারণ মানুষের। পোশাকে শোকের কালো ও শহীদের বুকের খুনে রাঙা ফুল হাতে হাতে দাঁড়িয়েছিলেন সুশৃঙ্খল সারি বেঁধে। ১২টা বাজার অনেক আগে থেকেই আসতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। সর্বসাধারণের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুষ্পস্তবক হাতে সারিবদ্ধভাবে জানিয়েছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। গভীর রাতে নারী-পুরুষ এমনকি বাড়ির শিশুটিও খালি পায়ে শহীদের প্রতি মমত্ব নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বেদির সম্মুখে। এ সময় মাইকে ভেসেছে শহীদের রক্ত ঋণে লেখা শোকসঙ্গীতÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি ...। এই সুরের সঙ্গে সারারাত ধরে চলে শ্রদ্ধা নিবেদনের আনুষ্ঠানিকতা। ভোর পেরিয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলেছে সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন পর্ব। সূর্যোদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত শহীন মিনার প্রাঙ্গণ যেন নতুন চেহারা পায়। দৃশ্যমান হয় প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়া নানা পেশা, শ্রেণী ও বয়সী মানুষের স্রোত। বেলা যত বেড়েছে ফুল দিতে আসা মানুষের সারি তত দীর্ঘ হয়েছে। শাহবাগ, জগন্নাথ হল, পলাশী মোড়, নীলক্ষেত ও ইডেন কলেজের দিক থেকে বানের স্রোতের মতো এসেছে একুশের চেতনাস্নাত জনতা। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত লাখো মানুষের দেয়া রাশি রাশি ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনার। ভাষাশহীদদের নিবেদিত ফুলগুলো দিয়ে বেদিমূলে নান্দনিক আল্পনা সৃজন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডেট সদস্যরা। অনেকের মতোই এদিন সকালে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন আণবিক শক্তি কমিশনের কর্মকর্তা মোঃ গোলাম মাহবুব। ভাষাশহীদদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে বইমেলার থেকে ফেরার পথে দোয়েল চত্বরে তার সঙ্গে কথা জনকণ্ঠের এই প্রতিনিধির। তিনি বলেন, এখানে এসেছি আমার শেকড়কে আলিঙ্গন করতে। আর একুশে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে বাঙালী স্বাধীনতার আঁতুড় ঘর। বায়ান্নতে যে রক্তধারার ক্ষরণ শুরু হয়েছিল তারই পরিপূর্ণতা ঘটে একাত্তরে। ভাষাযুদ্ধেরই ফসল লাল-সবুজের পতাকায় আঁকা বাংলাদেশ। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আমার কাছে প্রেরণার উৎস। সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা। একজন আদিবাসী হয়েও জন্মগতভাবে মিশে গেছি বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে। এ ভাষার জন্য গৌরব ও অহঙ্কার বোধ করি। দশ বছরের মেয়ে ঋতুকে নিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে এসেছিলেন ধানম-ির তানভীর রায়হান। তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। বলেন, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালীর জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল। বাংলা বর্ণমালার জন্য আমাদেরই ভাইয়েরা তাদের প্রাণটি বিসর্জন দিয়েছিলেন। আজ এই দিনটি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাঙালিত্বের এই গৌরবগাথা ও চেতনার পবিত্রতা ছড়িয়ে দিতে চাই আমার মেয়ের মাঝে। সে কারণেই ওকে নিয়ে এসেছি ভাষার জন্য আমাদের অবিস্মরণীয় ইতিহাস ও বোধের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে। এদেশের মানুষের পাশাপাশি ভাষাকে ভালবাসা ভিনদেশী নাগরিকরাও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্্যাপনের আনন্দে শামিল হয়েছিলেন রাজধানীতে। দোয়েল চত্বরের সামনে কথা হয় মাতৃভাষা দিবসের আয়োজন দেখতে আসা নিউজিল্যান্ডের নাগরিক শেরি এ্যাঞ্জেলার সঙ্গে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এই বিদেশী বলেন, ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার মতো দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। এই বিরল ঘটনাটিই ঘটিয়েছেন এদেশের ভাষার যোদ্ধারা। তাদের কল্যাণেই আজ বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঠাঁই করে আজ বাংলা ভাষা। বিশ্বে এখন বাংলা ভাষা অহঙ্কার করা হয়। সেই ভাষা দিবসের উদ্্যাপনটি কেমন হয় তা দেখার জন্য আমরা বন্ধুরা মিলে এখানে এসেছি। শহীদ মিনারে ফুল শ্রদ্ধা জানিয়েছে সেই সব ভাষাশহীদদের, যারা মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য সঁপে দিয়েছিল প্রাণ। এবারও শহীদ মিনারের জনস্রোত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা শহরে। শাহবাগ, টিএসসি, পলাশী, দোয়েল চত্বর এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের পোশাকে ছিল শোকের কালো রং। সাদা-কালো শাড়ি পরে বের হয়েছিলেন নারীরা। পুরুষের পাঞ্জাবিতেও ছিল সাদা কালো রঙের বিস্তার। জাতীয় পতাকার লাল সবুজটি জুড়ে গিয়েছিল কারও কারও পোশাকে। শহীদ মিনার থেকে অনেকেই সরাসরি চলে যান অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। এ দিন সকাল ৮টায় খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। দেখতে দেখতে ভরে ওঠে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বই বিতানগুলো ঘুরে একুশ উদ্্যাপনকারী বই দেখেছেন ও কিনেছেন। এভাবেই হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালবাসায় প্রতি ফাল্গুনের মতোই ৬৬ বছর পর আবার সেই দিনটিতে যেন জেগে উঠেছিল ভাষাশহীদরা। শরীর অস্তিত্ব না থাকলেও আত্মত্যাগের আলোড়নে তাঁরা জাগিয়ে গেলেন জাতিকে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যের সূত্র ধরে উচ্চারিত হলোÑ তারা জাগে, তারা জাগায়/ তারা ভাষা দেয়, তারা ভাষা চায়। ধানম-ি থানা আওয়ামী লীগ ॥ মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে এক শোভাযাত্রা বের করে ধানম-ি থানা আওয়ামী লীগ। এতে নেতৃত্ব দেন ধানম-ি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাবলা, সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুজ্জামান, আইন বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সরদার মোশাররফ হোসেন ও কবি মুজতবা আহমেদ মুরশেদ।
×