ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা-৭ উপলক্ষে আলোচনা

শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তরুণ প্রজন্ম এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে চিন্তা চেতনা ও মননে প্রকৃত অর্থে প্রগতিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে হলে শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা-৭’ সভায় ‘সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদ প্রতিরোধে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ৯৬তম জন্মদিন উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক শহীদকন্যা শিল্পী শমী কায়সার। সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কামাল লোহানী। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। তিনি বলেন, কবীর চৌধুরী আমাদের সব আন্দোলনে ছিলেন নির্ভীক অগ্রপথিক। প্রগতি ও মুক্তির লড়াইয়ের ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি জীবন ভর। আপোসহীন ছিলেন সব অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। সাম্প্রদায়িকতা স্বৈরাচার ধর্মান্ধতা মৌলবাদসহ সব সকীর্ণতা ও পশ্বাৎপদতার বিরুদ্ধে ছিলেন স্বোচ্চার। মূল বক্তব্য উপস্থাপনে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সভাপতি নাট্যজন রামেন্দ্র মজুমদার বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে চিরদিনের মতো সাম্প্রদায়িকতার কবর রচিত হয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে বেশি দেরি হলো না। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর দেশ আবার পাকিস্তানী ভাবধারায় প্রত্যাবর্তন করল। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বৈধতা পেল, সাংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নির্বাসিত হলো, একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধীরা রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করল। প্রতিক্রিয়াশীলতার পথযাত্রার সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করলেন অপর সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি ইসলামকে সাংবিধানের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে যুক্ত করলেন। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে এ দেশে ব্যাপক জঙ্গীবাদী তৎপরতা শুরু হওয়ার আগে থেকেই পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে ও অন্য কয়েকটি স্থানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ চলছে। কিন্তু সে সময়ে স্পর্শকাতর বিষয়ে হিসেবে ভোট নষ্ট হওয়ার ভয়ে কোন সরকারই এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অথচ জঙ্গীদের ব্যাপারে আজ সরকার যে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে, ২০ বছর আগে থেকে তা করা হলে দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গী তৎপরতা এত বৃদ্ধির সুযোগ পেত না। শিক্ষাব্যবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আজ যারা মাদ্রাসা বা ইংরেজী মাধ্যমের ছাত্র, তাদের বেশির ভাগই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে লালিত হয়নি। তারা ছোটবেলায় মা-বাবা, দাদা-দাদির কাছে গল্প শোনেনি, বাংলার লোকগীতি শোনেনি, বাংলায় শিশু সাহিত্য পড়েনি। বাঙালী সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দিক তাদের সম্পূর্ণ অজানা। ফলে সহজেই তাদের ভ্রান্তপথে পরিচালিত করা যায়। দুই রকমের তথ্য জেনে দেশের সন্তানেরা বড় হচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে শমী কায়সার বলেন, পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের কাছে আমার একটি চাওয়া থাকবে স্কুলে স্কুলে গিয়ে আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো বলা। ফেনীর একটি স্কুলের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, তারা শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, সেলিম-আল-দ্বিনের কথা জানে না। যেখানে এই তিনজনের জন্মস্থান। এটা একজন শহীদ কন্যা হিসেবে নয়, বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম নগন্য উল্লেখ করে এ শিল্পী বলেন, দেশব্যাপী বাংলার অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাপক সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রয়োজন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির পেছনে যে অর্থ ব্যয় হবে, তার তুলনায় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে খুবই নগন্য। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আমরা এখনও কোন সুচিন্তিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। আমরা শিল্প সাহিত্যের মানুষের বিচ্ছিন্নভাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করেছি। আজ সময় এসেছে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে প্রতিহত করার জন্য সব সংস্কৃতিকর্মীর একজোট হয়ে ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, ২০১৮ সাল, এ বছরটি আমাদের সরকার পরিবর্তন ঘটাবে। সরকার পরিবর্তন মানে হচ্ছে একদল গিয়ে আরেক দল আসবে, তা নয়! একটি নির্বাচন হবে। এই সরকারই আবার নতুন করে শপথ নেবে। সেই বছরটি হচ্ছে এই ২০১৮ সাল। তিনি বলেন, অন্তত পক্ষে ২০১৮ সালের নির্বাচন আমাদের পক্ষে আনতে হবে। তা না হলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন বলেন, সব আবার ৭৫ এর পরবর্তী অবস্থায় চলে যাবে। এ সময় তিনি বেগম খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে বলেন, সাম্প্রদায়িকতা বীজ বপন করেছে জিয়াউর রহমান। আর খালেদা সেই গাছের নিচে বসে শ্বাস নিচ্ছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুস বলেন, সংস্কৃতিক কর্মীরা জাতির সঙ্কটে কখনও পিছপা হয়নি। তারা ঝুঁকি নিতে জানে। ঝুঁকি না নিয়ে কোন অপশক্তিকে প্রতিহত করা যায় না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাজেট কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যখন বাজেট করি, তখন দেখা যায় সাংস্কৃতির বাজেট সবচেয়ে কম। বহু মন্ত্রণালয়ের একটা ব্যর্থ বরাদ্দ এর চেয়ে অনেক বেশি। সংস্কৃতিকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই, লড়াই তো চলছে, এই লড়াইকে যদি যৌক্তিক পরিণতিতে নিতে চাই, ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং বর্তমানে তরুণ প্রজন্মকে যদি চিন্তা চেতনা মননের দিক থেকে প্রকৃত অর্থে প্রগতিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে চাই তাহলে শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সভাপতির বক্তব্যে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, এখনও যদি সংস্কৃতির জন্য আমাদের চিৎকার করতে হয় যে টাকা চাই। টাকা না হলে কাজ হবে না। আজকে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা, তো মুক্তিযুদ্ধের যে সরকার আছে তাদেরই নেয়া উচিত। আজকে কতগুলো দল করে তাদের দিয়ে সারাদেশে প্রচার করানো উচিত। মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো তাদের কানে তোলা উচিত। আজকে যে টেলিভিশনগুলো আছে, শুধু ডিসেম্বর মার্চ আর ফেব্রুয়ারি ছাড়া তারা কয়জন মুক্তিযুদ্ধের গান একটা চাঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেন? কেউই করে না। টেলিভিশন মালিকদের সমালেচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক টেভিভিশনের নাম ইংরেজীতে আছে। তারা তাদের উপস্থাপকদের দিয়ে হায় ভিউয়ারস, হায়, হ্যালো, ইত্যাদি। প্রোগামগুলোর নামও ইংরেজীতে। যেমন মরনিং আওয়ার, আরে শুভ সকাল সুপ্রভাত এটা বলতে অসুবিধাটা কোথায়। এই যে সাম্প্রদায়িকতার মনোবৃত্তি, দাসত্ব এ ক্ষেত্রে আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা যারা কথা বলছি মালিকানায় তারাই আবার উপস্থাপকদের ওই ইংরেজীগুলো চাপিয়ে দিচ্ছেন। এই দ্বিচারিতার কারণে আজকে আমাদের এই দুর্দশা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াতে ইসলামী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে ২৬ বছর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলন সূচিত হয়েছিল তার প্রধান নেতাদের অন্যমত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। মৃত্যুর আগে দীর্ঘ ২০ বছর তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন ৭১ এর ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ আন্দোলনে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচারের জন্য যে ঐতিহাসিক গণআদালত বসেছিল, তার অন্যতম বিচারক ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। খালেদা জিয়ার সরকার তাকে ও জাহানারা ইমামসহ গণ আদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেছিল। কিন্তু শাসক শ্রেণীর ক্রোধ ও প্রতিহিংসা কখনও তাকে দমন করতে পারেনি। তার সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে শুধু ভাষা, সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্বই পড়াননি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পড়িয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার মৌলবাদের উত্থান ও প্রকৃতি; প্রতিরোধের পথ নির্দেশ করেছেন। ২০১১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি।
×