ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

শাহীন রহমান ॥ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? বরকতের রক্ত। বাংলা ও বাঙালীর প্রাণের ভাষা এই বাংলা। যে কথা বলার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন দামাল ছেলেরা। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলা মায়ের ভাষার অধিকার। বাঙালী জাতির যত ইতিহাস রয়েছে ভাষা আন্দোলন তার মধ্যে অন্যতম। যা স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল। ভিত্তিমূল রচনা করেছিল। ৬৬ বছর পরে বাঙালীর মাঝে আবার ফিরে এসেছে সেই ভাষার মাস অমর ফেব্রুয়ারি। আজ বৃহস্পতিবার ভাষার মাসের প্রথম দিন। ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন হলেও এর বীজ নিহিত ছিল দেশ বিভাগের শুরুতেই। ৪৭ সালের ১৪ আগস্ট উপমহাদেশে পাকিস্তান নামের আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় ভূপ্রাকৃতিকভাবে ভিন্ন এক জাতিগোষ্ঠীকে। দুটি জাতি নিয়ে পাকিস্তান নামের একটি রাষ্ট্রের জন্ম নিলেও সেখানে ভাষা এবং সংস্কৃতির বিস্তর ফারাক ছিল। প্রাথমিকভাবে এই দেশভাগ জাতি মেনে নিলেও ভাষার প্রশ্নটা প্রথম থেকেই ছিল। বিশেষ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাষা কি হবে তা নিয়ে তখনকার বুদ্ধিজীবীরা প্রথমে প্রশ্ন তোলেন। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিবন্ধন প্রকাশিত হতে থাকে। দেশভাগের শুরুতে তারা প্রশ্ন রাখেন পাকিস্তানের ৫৬ ভাগের মাতৃভাষা বাংলা। তাই বাংলাই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। দ্বিজাতির তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ ছিল পশ্চিমপাকিস্তানীদের হাতে। তাই তারা কখনো বাঙালী জাতির চাওয়া পাওয়া এবং অধিকারকে গুরুত্ব দেয়নি। দেশ বিভাগের পরপরই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন নিয়ে শুরু হয় দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ। বাঙালী জাতি সেদিন ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানী শাকসগোষ্ঠীকে একবিন্দু ছাড় দেয়নি। ফলে অনিবার্যভাবে আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত ছিল ৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে অকাতরে জীবন দিয়েছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলে সালাম, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে সেদিনের সেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম শুধু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই সংগ্রামেই জাতি প্রেরণা পেয়েছিল আজকের স্বাধীনতা অর্জনের। শুরুতেই বাংলা ভাষার অধিকারের কণ্ঠ রোধ করে দেয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে বাঙালীকে নিস্তব্ধ করে দেয়ার সব ষড়যন্ত্র করেছিল শাসকগোষ্ঠী। তাইতো বাংলা ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় মহান ’৭১। বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলন। কুচক্রী মহলকে যেমন একাত্তরে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে। তেমনি তারা বাধ্য হয়েছিল বাংলাভাষাকে স্বীকার করে নিতেও। তারা বুঝতে পেরেছিল বুলেটবিদ্ধ করে বাঙালী জাতিকে কোনদিন দাবিয়ে রাখা যাবে না। পারেওনি কোন দিন। তাই তো আন্দোলন সংগ্রামের অনিবার্য ফল আমাদের মহান স্বাধীনতা। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫২ সালে ভাষার জন্য চূড়ান্ত যে লড়াই হয়েছিল মূলত পৃথক বৈশিষ্টপূর্ণ ভূখ-ে নিজেদের বিকাশ, আত্মচেতনার উপলব্ধিতে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সংস্তৃতির লড়াই। এ লড়াই ছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, তাদের শোষণের বিরুদ্ধে এবং ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজেদের মাতৃভাষার চর্চা ছাড়া কোন জাতির সার্বিক বিকাশ কোনদিন সম্ভব নয়। একটি জাতির, একটি রাষ্ট্রের এবং সমাজে, ব্যক্তি এবং পরিবারের টেকসই উন্নয়নের জন্যও নিজস্ব মাতৃভাষা বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে। পৃথিবীর সব দেশের জন্য এ কথা প্রয়োজ্য। তাই প্রত্যেক জাতি নিজ ভাষা চর্চার ওপরে প্রথমেই বেশি জোর দেন। প্রয়োজনে অন্য ভাষার চর্চা করেন। কিন্তু নিজ ভাষার প্রশ্নে কেউ একচুল ছাড় দেন না। কারণ একটি ভাষা বেড়ে ওঠে তার ভৌগলিক অবস্থান এবং প্রয়োজনীয়তাকে কেন্দ্র করেই যা সেই জাতিসত্তার মধ্যে আশ্রয় লাভ করেছে। প্রতিটি দেশ জাতির কর্মদক্ষতা, চিন্তার গড়ন, ভাষার ওপর নির্ভরশীল। এর ওপর দাঁড়ানো ছাড়া উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোন দেশেই কথা বলার অধিকার, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন, সংগ্রাম করতে হয়নি। এই অধিকার তার মাতৃজঠরের অধিকার। আমাদের সেই অধিকারের ওপর আঘাত এসেছিল ৫২ ফেব্রুয়ারিতে। যার পরিণতিতেই ফেব্রুয়ারি আজ অমর হয়ে রয়েছে। ’২১ অমর হয়েছে। আগামী হাজার বছর তাই ভাষার মাস বাঙালী জাতির কাছে অমর হয়ে থাকবে। ১৯৫২ সালের আগুনঝরা দিনগুলো বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে থাকবে। ৬৬ বছর পেরিয়ে আমাদের কাছে আবার এসেছে সেই ফেব্রুয়ারি। আজ বৃহস্পতিবার ১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার মাসের প্রথম দিন। প্রতিবারের মতো আজ থেকে জাতীয় শহীদ দিবস সামনে রেখে প্রাণে প্রাণ মিলবে নানা কর্মসূচীতে। সবচেয়ে বড় আয়োজনটির নাম অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি চত্বরে আজ এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাসব্যাপী মেলা শুধু বইয়ের নয় বরং বাংলা সংস্কৃতির। তাই এ মাসে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হবে। তাই তো কবি বলেছেন, হাজার যুগের সূর্যতাপে/জ্বলবে এমন লাল যে,/সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে! অথবা প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি/আমায় নেবে সঙ্গে, বাংলা আমার বচন, আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।
×