ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেন্দ্রীয় পেনশন ও ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অফিস প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে ;###;অনলাইনে পেনশন ও ভবিষ্য তহবিল কার্যক্রম সম্পাদনে স্বতন্ত্র কার্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ ;###;এই সুবিধা গ্রহণে শুধু একটি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট কিংবা বিকাশ এ্যাকাউন্ট লাগবে

চাকরি শেষে আর ভোগান্তি নয় ॥ ঘরে বসেই পেনশন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

চাকরি শেষে আর ভোগান্তি নয় ॥ ঘরে বসেই পেনশন

এম শাহজাহান ॥ চাকরি জীবন শেষে পেনশনের টাকা পেতে আর ভোগান্তি নয়। সম্পূর্ণ হয়রানিমুক্ত থেকে যাতে পেনশন পাওয়া যায় সেলক্ষ্যে ‘কেন্দ্রীয় পেনশন ও ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অফিস’ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। অনলাইনে পেনশন ও ভবিষ্যত তহবিল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য স্বতন্ত্র কার্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় বা সিজিএর আওতায় থাকবে এই অফিস। এর অন্যতম সুবিধা হচ্ছে, এতে একজন চাকুরে অবসর জীবনে ঘরে বসেই পেনশনের টাকা পাবেন। এই সুবিধা গ্রহণে শুধু একটি ব্যাংক হিসাব অথবা একটি বিকাশ (মোবাইল ব্যাংকিং) এ্যাকাউন্টের প্রয়োজন হবে। শীঘ্রই কেন্দ্রীয় পেনশন ও ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অফিসের কার্যক্রম শুরু হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, অফিসটির কার্যক্রম শুরু করতে প্রাথমিকভাবে এই কার্যালয়ের জন্য বিভিন্ন গ্রেডের ১৭৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শীঘ্রই নিয়োগ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে এই কার্যালয়ের জন্য লোকবল নিয়োগ দিতে একটি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ বেসামরিক পেনশনভোগী রয়েছেন। এই পেনশনারদের মাসিক পেনশন ও অন্যান্য অবসরকালীন সুবিধা বর্তমানে বিভিন্ন হিসাবরক্ষণ অফিস, ব্যাংক এবং পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে। একইভাবে বর্তমানে প্রায় ২১ লাখ সরকারী চাকরিজীবীর ভবিষ্যত তহবিল হিসাব মহানিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের আওতাধীন হিসাবরক্ষণ অফিসসমূহে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হয়রানিমুক্ত পেনশন ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সিজিএ থেকে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে অর্থমন্ত্রীর কাছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতি মাসের ১ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হিসাবরক্ষণ অফিস অথবা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় গিয়ে পেনশনের অর্থ উত্তোলন করা প্রবীণ পেনশনারদের জন্য কষ্টকর। অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সাধারণ ভবিষ্যত তহবিলের হিসাব সংরক্ষণ করা এবং সেই তহবিলের ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ অবস্থায় পেনশনারদের অর্থ তাদের নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে অনলাইনে স্থানান্তর করা অবশ্যক। সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পেনশন খাতের বরাদ্দ অর্থ বিভাগে স্থানান্তরপূর্বক প্রদর্শন করা হয়েছে। এ বাস্তবতায় সিজিএর বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোতে যথাযথ সেবা প্রদান দুরূহ হবে। এ কারণে প্রশাসনিকভাবে সিজিএ অফিসের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক কেন্দ্রীয় পেনশন ও ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অফিসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। পৃথক অফিস প্রতিষ্ঠার জন্য হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে অস্থায়ীভাবে লোকবল নিয়োগের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। এতে চীফ কন্ট্রোলারসহ মোট ২৪টি ক্যাটাগরিতে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৭৬টি পদ সৃষ্টির অনুরোধ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানা গেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি বাজেট বক্তৃতায় এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা সংস্কার করে আধুনিক, যুগোপযোগী ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা প্রবর্তনে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিদ্যমান সরকারী পেনশন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রথম ধাপে আমরা শতভাগ পেনশন নগদায়নের বিধান রহিত করেছি। পেনশন বাবদ বরাদ্দ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে রাখার পরিবর্তে অর্থ বিভাগের অনুকূলে রাখার ব্যবস্থা করেছি এবং পৃথক একটি পেনশন অফিস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। শুধু তাই নয়, ১ জুলাই ২০১৭ থেকে অবসরগ্রহণকারী সরকারী পেনশনার আবশ্যিকভাবে তার প্রাপ্য পেনশনের অর্ধেকের ওপর নির্দিষ্ট হারে আনুতোষিক পাবেন এবং বাকি অর্ধেক আজীবন মাসিক পেনশন হিসেবে পাবেন। পূর্বে পেনশনারগণের পেনশন নির্ধারণের পর নতুন পে-স্কেল চালুর আগে পেনশনের হার বৃদ্ধি করা হতো না। ফলে পেনশনারগণ অতি নগণ্য হারে পেনশন পেতেন। আমরা প্রথমবারের মতো মাসিক পেনশনের ওপর বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট প্রথা প্রবর্তন করেছি। যা একদিকে পেনশনারদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য রহিত করবে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি হতে সুরক্ষা প্রদান করে তাদের জীবনযাত্রার মান সমুন্নত রাখতে সহায়ক হবে। জানা গেছে, পেনশন ব্যবস্থা সহজ করার জন্য কয়েক বছর ধরে কাজ করছে সরকার। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে বেশকিছু নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এর আলোকে কল্যাণ তহবিল, সরকারী প্রভিডেন্ট ফান্ড, চাকরিজীবী অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার আগেই যাতে পান, সে বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পেনশনের জন্য যেসব দফতরের ছাড়পত্র নিতে হয়, সেগুলো আর পেনশনারকে সংগ্রহ করতে হবে না। কল্যাণ কর্মকর্তা নিজ দায়িত্বে তা সংগ্রহ করবেন। নির্ধারিত সময়ে সংগ্রহ করতে না পারলে পেনশনার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোন আপত্তি নেই বলে ধরে নেয়া হবে। এছাড়া বর্তমানে চাকরিজীবী স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী আজীবন পেনশন সুবিধা পান। কিন্তু চাকরিজীবী স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত এ সুবিধা পান। এ বৈষম্যও দূর করার কথা ভাবছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ঘরে বসেই যাতে পেনশনের টাকা পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করা হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থসচিব মোঃ মুসলিম চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে পেনশনের টাকা ঘরে বসেই পেতে পারেন সেলক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। মাসে মাসে পেনশনের টাকার জন্য এজি অফিস বা ব্যাংকে গিয়ে আর লাইন ধরতে হবে না। এলক্ষ্যে পেনশনার ডাটাবেইজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় সকল পেনশনারের নাম এই ডাটাবেইজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরা সবাই বেসামরিক সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী বা তাদের পরিবারের পেনশন সুবিধাভোগী। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল পেনশনভোগীকে এ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ শুরু ॥ সকল শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীসহ প্রবীণদের জন্য একটি সর্বজনীন ও টেকসই পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তন নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ সরকারী চাকুরে পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্রাচ্যুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমার পাশাপাশি গড় আয়ু বাড়ার কারণে জনমিতিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। এতে প্রবীণদের সংখ্যা এবং মোট জনগোষ্ঠীতে তাদের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে নগরায়নের কারণে একক পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাস্তবতায় সকল শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীসহ প্রবীণদের জন্য একটি সর্বজনীন ও টেকসই পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তন করার ঘোষণা দিয়েছে বর্তমান সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তিন বছর ধরে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার কথা বলে আসছেন। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়ও এ বিষয়ে তার ঘোষণা রয়েছে। সেখানে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারী পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারী কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে। সরকারের সামগ্রিক কর্মকা-ের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা। জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি দাতাদের সহযোগিতায় যৌথভাবে এ তহবিল গঠন করা হবে। এ তহবিলের টাকা যোগান দিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন দাতার সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছে।
×