ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ শান্তি রক্ষীবাহিনীকে

বিদ্রোহ থামাতে সুদানের জেবেলমারায় নতুন ক্যাম্প বসছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

বিদ্রোহ থামাতে সুদানের জেবেলমারায় নতুন ক্যাম্প বসছে

দারফুরের এলজেনিনা থেকে এলফেসার। পুরোটাই মরু এলাকা। কোথাও কোথাও মরুভূমির মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী। বৃষ্টি হলে নদীতে পানি প্রবাহিত হয়। বছরের দুই থেকে আড়াই মাস এখানে বৃষ্টির মৌসুম। নদীর তীর ঘেঁষে কিছু কিছু লোকবসতি রয়েছে। মূলত এলফেসার শহর ও তার আশপাশের এলাকায় লোকবসতি বেশি। তবে শহর থেকে দূরে জেবেলমারা পাহাড়ী এলাকায় রয়েছে ঘনবসতি। আর এখানেই সুদান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত সুদান লিবারেশন আর্মির (এসএলএ) আধিপত্য। এই আধিপত্য ধ্বংসের জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা কাজ করে যাচ্ছেন। এলাকাটি এসএলএ এত বেশি দুর্ভেদ্য করে রেখেছে যে এখানে শান্তিস্থাপনে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে। এই বিদ্রোহীদের দমন করতে জেবেলমারায় স্থাপন হবে নতুন একটি ক্যাম্প। ক্যাম্পটি পরিচালানার জন্য বাংলাদেশ শান্তি রক্ষাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হবে। নতুন ক্যাম্পটির বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা সেনা প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়। দশ সদস্যের সেনা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যশোর সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনের এলজেনিনা কন্টিনজেন্ট কমান্ডের কর্নেল তানভীর ইসলাম খান চৌধুরী বলেন, ২০০৩ সালের প্রথমদিকে দারফুরে সংঘটিত সংঘর্ষের পর মাত্র দুটি বড় বিদ্রোহী গ্রুপ রয়েছে। তারপর থেকে বিদ্রোহীরা প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মিনিমিন্নির নেতৃত্বে রয়েছে মিনাওয়ারি আর্মি। এলাকাভিত্তিক আরও অনেক ক্ষুদ্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে। তারা লোকজনের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে বেড়ায়। এসব করতে গিয়ে অনেক মানুষকে তারা হত্যাও করে। সরকারের বিরুদ্ধেও তাদের অবস্থান। শান্তিরক্ষা মিশন তাদের কোনভাবেই পচ্ছন্দের নয়। বড় দুটি গ্রুপ ও ছোট ছোট গ্রুপের অত্যাচার থেকে দারফুরের মানুষকে রক্ষা করতে শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন। মানুষের নিরাপত্তা দেয়াই মিশনের প্রদান কাজ। জাতিগত দাঙ্গায় ২০০৩ সালে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। সেই নিষ্ঠুর ও নির্মমতার ক্ষত এখানকার লোকজন বয়ে বেড়াচ্ছেন। ওই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাউকে কাউকে বিচারের আওতায় আনা হলেও সরকারের বিচার তাদের পচ্ছন্দ হয় না। নিজের হাতে সেই প্রতিশোধ নিতে উত্তরাধিকারীরা সব সময় ওঁৎ পেতে থাকে। সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেছে, দাঙ্গাকারী একজন দশ বছর জেল খেটে বের হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। খবর নিয়ে জানা গেছে, ওই ব্যক্তি যাকে খুন করেছিল তার ছেলে তাকে জেল থেকে বের হওয়ার পর খুন করেছে। বিচারটা নিজের হাতে তুলে নিতেই বেশি পছন্দ করে সবাই। ধর্মের দিক থেকে এখানে প্রায় সবাই মুসলিম। কিন্তু বিভক্ত কয়েক শ’ গোত্রে। তাই এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে হত্যা করতে কোন দ্বিধা করছে না। ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙাচ্ছে তবু হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করছে না। বিশেষ করে আরব বংশীয়রা সরকারের সহযোগিতায় হত্যা করছে সুদানী ফুরেস গোত্রীয় আদিবাসী মুসলিমদের। দারফুরে ৬০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে চারলাখকে হত্যা করা হয়েছে। পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে আরও প্রায় ২০ লাখ। এমন এক জঘন্যতম হত্যাকা- চলেছে এখানে। সেই হত্যাকা-ের বদলা নিতে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর জন্ম হয়। প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ১৯৮৯ সালের সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে স্বৈরশাসন চলছে। এই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের অবস্থান। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) দারফুরে গণহত্যার অভিযোগে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ২০০৯ সালে। আন্তর্জাতিক আদালতের এ সিদ্ধান্তকে দারফুরের বিদ্রোহীরা ‘বিজয়’ বলে ঘোষণা করেছে। তবে বশির সরকার আন্তর্জাতিক আদালতের এ সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত দারফুরে বসবাসকারী ফুর, মাসালিত ও জাগাবা আদিবাসী গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সুদানের প্রেসিডেন্ট আল-বশির যে ধ্বংসাত্মক কাজ করেছেন, তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দারফুরের যেসব গ্রাম ও শহরে আদিবাসীদের বসবাস সেসব জায়গা বেছে বেছে সুদানের সরকারী বাহিনী হামলা চালিয়েছে। অন্য আদিবাসী বা বিদ্রোহী বসবাসকারী অঞ্চলকে পাশ কাটিয়ে যেসব গ্রাম ও শহরে ফুর, মাসালিত ও জাগাবা আদিবাসীর লোকজনের বসবাস সেখানেই হামলা চালানো হয়েছে। দারফুরের আদিবাসী এলাকাগুলোয় ধর্ষণ ও নির্যাতন এবং সেখানকার লোকজনকে জোর করে বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। দারফুরে গত ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে অন্তত চার লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ২০০৩ সালে বিদ্রোহীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার পর সরকারপন্থী মিলিশিয়া ‘জানজাবিদ’ সেখানে ফুর, মাসালিত ও জাগাবা আদিবাসীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালায়। আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও প্রেসিডেন্ট বশির ক্ষমতাকে আরও শক্ত করে তুলেছে। এখানে কেউ বশির সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারে না। প্রেসিডেন্ট বশিরের ক্ষমতা আরও সুসংহত হওয়ায় বিদ্রোহী সুদান লিবারেশন ফোর্স এ্যালায়েন্সের (এসএলএ) নেতা আব্দুল ওয়াহিদ ঘোষণা দিয়েছে সুদান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই ঘোষণার পর থেকে এখানে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হচ্ছে। দারফুরের অবস্থা কোন্ দিকে যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারছে না। ওদিকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে, তারা মিশন এলাকা ছোট করে আনবে। মিশন এলাকা ছোট করে আনলে কি ঘটতে পারে সেটাও বলা যাচ্ছে না। জেবেলমারায় মিশনের ক্যাম্প স্থাপন হলে (রেড জোন) কি ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। শান্তিরক্ষা মিশন পরিদর্শনকারী প্রতিনিধিদলের দলনেতা ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের দলনেতা মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, বিষয়গুলো সম্পর্কে সেনাপ্রধানকে অবহিত করা হবে। প্রতিনিধিদল শান্তিরক্ষার বিষয়ে জানতে সুদান সফরে আসেনি। দলটি সুদানের ব্যবস্যা-বাণিজ্যের বিষয়েও খোঁজখবর নিয়েছে। দেশটিতে বাংলাদেশের কি কি ব্যবসা হতে পারে তারও একটা জরিপ প্রতিনিধিদল করেছে। এই প্রতিনিধিদলে রয়েছেন লে. কর্নেল গোলাম মোর্শেদ, মেজর সৈয়দ মশিহুর রহমান, মেজর জায়েদুল আলম, মেজর ফরিদ আহমেদ, মেজর মোঃ অসাদুজ্জামান তাপস, মেজর মোস্তফা আহমেদ, মেজর মোস্তফা আহমেদ মোজাদ্দেদী, মেজর রাকীবুবুল আমিন। গত কয়েক দিন প্রতিনিধিদল সুদানের দারফুরে মোতায়েন বাংলাদেশী কন্টিজেন্টসমূহে আভিযানিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিদর্শন করেছে।
×