ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাশিয়ার নতুন জার

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২২ নভেম্বর ২০১৭

রাশিয়ার নতুন জার

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন দেশের ইতিহাসে এক পরাক্রান্ত নেতার ভূমিকায় আবির্ভূত। অনেকে বলেন, স্ট্যালিনের পর তিনিই রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর নেতা। আবার কেউ বলেন, তিনি একবিংশ শতাব্দীর জার। পুতিনের এই তুলনাগুলো এমনি এমনি হয়নি। তিনি দেশটিকে ১৯৯০-এর দশকের বিশৃঙ্খলা-বিভ্রান্তির গর্ভ থেকে টেনে তুলেছেন। বিশ্ব দরবারে আবার দেশটিকে শক্তিশালী আসনে ফিরিয়ে এনেছেন। অনেকে পুতিনকে স্বৈরাচারী বলে থাকেন। কিন্তু এমন ব্যক্তি পর্যায়ের স্বৈরাচারী শাসন তো গত ১৫ বছরে বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়ায় যে উদার গণতন্ত্র চালু হয়েছিল তার চরম ব্যর্থতা থেকে পুতিনের স্বৈরাচারের উত্থান। তার স্বৈরাচার রাশিয়ার সম্রাটদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে তা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয়। একজন জারের মতোই পুতিন অনুগত পরিষদের এক পিরামিড তৈরি করেছেন যার শীর্ষে তার অবস্থান। ২০১১ সালে অলিগার্কদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রথমে মিডিয়ার এবং তারপর বৃহৎ তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে ক্ষমতা ও অর্থবল উভয়ের সমস্ত পথ তার সামনে খুলে যায়। তাঁর জনসমর্থনের হার ৪০ শতাংশেরও বেশি। কারণ যেমন করেই হোক রুশদের মনে এই ধারণা জন্মেছে যে পুতিন নেই তো রাশিয়া নেই। তথাপি মিসরীরা পুতিনকে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এবার পালিত হলো ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী। সরকারী মহল এই বিপ্লব সম্পর্কে নীরবতা রক্ষা করেছে। কিন্তু অন্যদিকে শোনা যাচ্ছে যে, ক্রেমলিন সর্বশেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে গুলি করে হত্যার ঘটনাটির জন্য শোক প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ আঁদ্রেই জোরিন বলেন, জারের বৈধতা পাওয়ার জন্য পুতিনকে জারের বংশ তালিকায় থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। তিনি দেশকে গর্বিত হবার মতো কোন কিছু দিতে পারলে সেটাই হবে তার বৈধতা। ইতোমধ্যে তিনি রাশিয়ার ভূখ- পুনরুদ্ধার করে, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার অন্যায়ের পর দেশকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করে সেই বৈধতা লাভ করেছেন এবং রুশ জনগণের যথার্থ নেতা ও ত্রাতা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। কিন্তু তার বৈধতা বা ক্ষমতার সবচেয়ে বড় উৎস তার প্রতি আনুগত্য। পুতিন ছিলেন সাবেক কেজিবিপ্রধান। তার সাবেক কেজিবি সহকর্মীরা তার প্রতি এমনভাবে আনুগত্য ঘোষণা করেছে যেন তিনিই জার। বিনিময়ে পুতিন তাদের দিয়েছেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। কালক্রমে বৈবাহিক সূত্রেও পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা একটা স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে উন্নীত হয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্র মালিকানাধীন তেল, গ্যাস ও ব্যাংকিং শিল্পের অনেক শীর্ষস্থানীয় ম্যানেজাররা পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাবেক কেজিবি সহকর্মীদের সন্তান। তারা তাদের সহসা বড় লোক হয়ে উঠাকে দুর্নীতি হিসেবে দেখে না বরং আনুগত্যের পুরস্কার বা স্বত্ব হিসেবে দেখে। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর পুতিন টিভির মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থিত হয়ে আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানকে আনুকূল্য বিতরণ করেন। রাষ্ট্রীয় টিভিকে তিনি তার বার্তা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রক্ষা করেন। রুশ সম্রাটদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি নিজেকে তাদের কাছে উচ্চাভিলাষ দ্বারা চালিত রাজনীতিক হিসেবে নন বরং জনগণের খাদেম হিসেবে তুলে ধরেন। এটা তাঁকে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার এবং বিকল্প রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে নির্বিস করার, অলিগার্ক, মিডিয়া, আঞ্চলিক গবর্নর ও রাজনৈতিক দলগুলোতে শক্তিহীন করার সুযোগ করে দিয়েছে। যারা তার কর্তৃত্বের কাছে নতিস্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদের নির্বাসিত করা অথবা জেলে পোড়া হয়েছে। বিশাল ধনকুবের ও তেল-গ্যাস কোম্পানির মালিক এবং একদা রাশিয়ার পয়লা নম্বরের অলিগার্ক মিখাইল খোদোরকোভস্কিকে সাইবেরিয়ার কারাগারে পাঠামোর আনুষ্ঠানিক কারণ যাই হোক না কেন সবাই জানেন যে পুতিনের ব্যক্তিগত রোষানলে পড়েই তার এই অবস্থা হয়েছে। পুতিনের গড়ে তোলা আনুগত্যের ব্যবস্থায় শাসকের ইচ্ছামাফিক অলিগার্কদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। আঞ্চলিক শাসকদের বৈধতার উৎস একইভাবে ভোটারদের ইচ্ছা নয় বরং পুতিনের নিযুক্তি বা অনুমোদন পুতিন জারের শাসনের কিছু কিছু প্রতীকের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন। ২০০৪ সালে তার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে এমন এক অভিষেকের আয়োজন করা হয় যার সঙ্গে জারদের অভিষেকের মিল রয়েছে। প্রধান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্র চ্যানেল ওয়ানের প্রধান রীতিমতো রাজকীয় সেটিংয়ের আয়োজন করেন, ক্রেমলিনের প্রহরীদের জারের যুগের ইউনিফর্ম পরানো হয়। তাদের ঘোড়াগুলো ধার করে আনা হয়েছিল একটি ফিল্ম স্টুডিও থেকে। সেই স্টুডিওর নির্মিত একটি ছবিতে সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডারের অভিষেকের দৃশ্য ছিল এবং সেই দৃশ্যে ঘোড়াগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল। পুতিন যখন ক্রেমেলিন ক্যাথেড্রামে হেঁটে যাচ্ছিলেন তখন মিখাইল গ্লিংকার ‘গ্লোরি টু দ্য জার’ মিউজিক বাজানো হচ্ছিল। রুশ আর্থাডক্স চার্চের প্রধান তাঁর উপর আশীর্বাদ বর্ষণ করেন। পুতিনের রাশিয়া আজ এমন এক দেশ যেখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পদ জোগান দেয়া হয় আইনের শাসনের দ্বারা নয় বরং উপর থেকে প্রদত্ত সুবিধাদির দ্বারা। এখানে অপ্রথাগত নেটওয়ার্ক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর স্থান পায়। ১৯৯০-এর দশকে প্রভাব বিস্তার করার জন্য এই নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়েছিল। ২০০০-এর দশকে এগুলোকে সমন্বিত করে একটি একক পিরামিডের রূপ দেয়া হয় যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সর্বশীর্ষে থাকেন পুতিন। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সম্পত্তির অধিকার ও আইনের শাসনের দুর্বলতা আপতিক কোন সীমাবদ্ধতা নয় বরং প্রয়োজনীয় উপাদান। মালিকানা বা পদের বৈধতা শুধুমাত্র প্যাট্রনই যোগাতে পারেন। এই প্যাট্রন ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে রুশ সমাজ শাসিত হচ্ছে। সেখানে পুতিন একই সঙ্গে লোলুপ ও শিকারী এলিট শ্রেণীর হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার ভূমিকায় আবির্ভূত এবং সম্ভাব্য গণঅভ্যুত্থানের হাত থেকে এলিট শ্রেণীরও রক্ষাকর্তা। রাশিয়ার জনগণের ৮০ শতাংশই সেখানে পুতিনের সরকারকে দুর্নীতিবাজ এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে নিয়োজিত সেখানে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতার এই ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকতা রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য যতটা ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে তেমন ঝুঁকি দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসের আর কোন সময়ই তেমন হয়নি। আগামী বসন্তে রাশিয়ার নির্বাচন। সেই নির্বাচনে পুতিন যে পুনর্নির্বাচিত হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নির্বাচনের উদ্দেশ্য পুতিনের বিকল্প সন্ধান করা নয় বরং এটাই প্রমাণ করা যে তাঁর কোন বিকল্প নেই। পুতিনের জনসমর্থন এখন ৮৬ শতাংশ। যেখানে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজমান সেখানে এমনটা হতে বাধ্য। এই শূন্যতার কারণে পুতিনের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, কোন চ্যালেঞ্জার নেই। ফলে রাশিয়ায় এক অদ্ভুত ধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজমান। এই কথিত স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য পুতিন অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্বটা উদার ভাবাপন্ন টেকনোক্র্যাটদের হাতে দিয়েছেন এবং রাজনীতির দায়িত্ব দিয়েছেন সাবেক কেজিবি অফিসারদের হাতে। অনির্বাস রাজনীতিই আবার অর্থনীতি উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। রাশিয়ার অর্থনীতি এখনও বহুলাংশে প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর যার জন্য এখনও দেশটি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশে ধরে রাখতে পেরেছে। নইলে দুর্নীতিতে আকীর্ণ রুশ সমাজের কি হতো বলা মুশকিল। পুতিন ক্ষমতার উপর বজ্রমুষ্টি ধরে রাখতে পেরেছেন দমন নিপীড়ন ও সামরিক সংঘাতের মাধ্যমে। স্বদেশে স্থিতিশীলতা, ঐতিহ্য ও ধর্মের নামে তিনি রাজনৈতিক বিরোধী, এনজিও, সামাজিক উদারপন্থী ও নারীবাদী সবাইকে দমন করে রেখেছেন। আর বাইরে ক্রিমিয়া দখল করে, সিরিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে তিনি এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করেছেন। তার একমাত্র চ্যালেঞ্জ যার তরফ থেকে আসতে পারে তিনি দেশের শীর্ষ সরকারবিরোধী ব্যক্তিত্ব আলেক্সি নাভালনি। ক্রেমলিন তাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করলেও তিনি পুতিন বিরোধিতার হাল ছেড়ে দেননি। গত ৭ অক্টোবর পুতিনের ৬৫তম জন্মদিনে তিনি তার সমর্থন তরুণদের রাস্তায় নামিয়েছেন। তারা পুতিনের নিজ শহর সেন্ট পিটার্সবার্গে মিছিল করেছে। সেøাগান তুলেছে ‘নয়া জার নিপাত যাক। নাভানলি পুতিনের ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’ পার্টিকে চোর ও বাটপারের দল বলে আখ্যায়িত করেছেন। নাভালনি পুতিনের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও সত্যিকার অর্থে আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে চান। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রাশিয়ার আজকের বাস্তবতাই এমন যে রাজনৈতিক শূন্যতার কারণে কেউ পুতিনের গায়ে আঁচড় মারার মতো অবস্থায় নেই। কোন গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানেরও সম্ভাবনা নেই। তাই পুতিন নতুন জারের ভূমিকায় আছেন এবং আপাতত থেকেই যাবেন। কারণ তাঁর কোন বিকল্প নেই। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×