ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী কারাগারের মহানন্দা ওয়ার্ডে রাষ্ট্রপতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২ নভেম্বর ২০১৭

রাজশাহী কারাগারের মহানন্দা ওয়ার্ডে রাষ্ট্রপতি

ফিরোজ মান্না/মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে ॥ রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে এসে জেল জীবনের নানা স্মৃতি স্মরণ করলেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এই কারাগারে জীবনের সাতটি মাস কাটিয়েছেন তিনি। সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান তাকে জেলে পুরেছিলেন। রাজবন্দী মোঃ আবদুল হামিদ কারাগারের সেই দুর্বিষহ স্মৃতি তিনি কর্মকর্তাদের বলেন। কিছু স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বঙ্গবন্ধুকেও বার বার পাকি শাসক গোষ্ঠী এই কারাগারে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে যে সেলে রাখা হয়েছিল সেই সেল এখন ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ’। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ কক্ষটি পরিদর্শন করেন। দীর্ঘ ৪০ বছর পর আবার তিনি এলেন। তবে বন্দী হিসেবে নয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সেদিনের সেই অসম্মান তাকে যেমন ব্যথিত করেছিল আজ তার ঠিক উল্টো চিত্র ছিল। বিকেল তিনটা ৪০ মিনিটে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান। সেখানে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। কারাগার পরিদর্শন শেষে তিনি পদ্মা নদীতে নৌকা ভ্রমণ করেন। দুই দিনের সফরে দুপুরে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে রাজশাহী পৌঁছেন রাষ্ট্রপতি। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৭ সালের মে থেকে নবেম্বর পর্যন্ত রাজবন্দী হিসেবে রাজশাহীর এই কারাগারে ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ আবদুল হামিদ। সংসদ সদস্য থেকে ডেপুটি স্পীকার, স্পীকারের পদ পেরিয়ে চার বছর আগে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বভার নেন তিনি। মোঃ আবদুল হামিদ কারাগারে পৌঁছলে কারারক্ষীদের একটি দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়। পরে তিনি তার সাত মাসের রাজশাহী জেলজীবনে কাটানো ৮ নম্বর ডিভিশন ওয়ার্ড (বর্তমান নাম মহানন্দা ওয়ার্ড) ঘুরে দেখেন। পাশাপাশি ‘২০ সেল’ ও ‘কনডেম সেল’ ঘুরে দেখেন তিনি। ‘২০ সেলে’ ভয়ঙ্কর কয়েদিদের রাখা হয় বলে কারা কর্মকর্তারা জানান। কনডেম সেলে রাখা হয় মৃত্যুদ-ে দ-িতদের। ডিভিশন ওয়ার্ডে সহবন্দী আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল, সাবেক নেতা প্রয়াত সরদার আমজাদ হোসেনসহ অন্যদের স্মৃতি স্মরণ করেন মোঃ আবদুল হামিদ। তিনি জানান, শাস্তিস্বরূপ তৎকালীন জেল কর্তৃপক্ষ তাকে চারদিন চার নম্বর কনডেম সেলে আটক রেখেছিল। রাজশাহী কারাগারে ঢোকা ও বের হওয়ার সময় জেলের নিয়ম অনুযায়ী ‘এন্ট্রি বুকে’ সই করেন রাষ্ট্রপতি। পরে পরিদর্শন বইতেও সই করেন তিনি। ডিভিশন ওয়ার্ডের সামনে একটি বেল গাছের চারা রোপণ করেন রাষ্ট্র্রপতি। এ সময় উপস্থিত সকলকে রাষ্ট্রপতি জানান, তিনি বন্দী থাকার সময়ও সেখানে একটি বেল গাছ ছিল। ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে যোগ দেয়া মোঃ আবদুল হামিদ পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের পর ১৯৭৬-৭৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলার কারাগারে বন্দী ছিলেন। পাকিস্তান আমলেও দুইবার কারাগারে যেতে হয়েছিল তাকে। দেশ স্বাধীনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামালে তাকে কারাগারে যেতে হয়। ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ঢাকার কারাগারে থাকতে হয়েছে মোঃ আবদুল হামিদকে। সারাজীবন মাঠের রাজনীতি করে আসা মোঃ আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর রসিকতা করে বঙ্গভবনকেও কারাগারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে পার্থক্য হচ্ছে এখন স্যালুট দেয়। কারাগার থেকে মোঃ আবদুল হামিদ রাজশাহীর ‘টি-বাঁধ’ পরিদর্শন করেন এবং পদ্মা নদীতে কিছু সময় নৌকাভ্রমণ করে রাত্রিযাপনের উদ্দেশে রাজশাহী সেনানিবাসে যান। তিনি রাজশাহী সেনানিবাসে পৌঁছলে সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক তাকে স্বাগত জানান। সেনানিবাসে রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দেয় প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি দল। রাজশাহী সফরের প্রথম দিন তার এভাবেই কাটে। দুই দিনের সরকারী সফরে বুধবার রাজশাহী যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে রাজশাহী সেনানিবাসে প্যারা কমান্ডো-১ ব্যাটালিয়নের পতাকা প্রদান করবেন। রাষ্ট্রপতির রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ও পদ্মার টি-বাঁধ পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। সেখানে তিনি কিছু সময় কাটাবেন। রাষ্ট্রপতির আগমনকে ঘিরে পদ্মার তীর ও শহর রক্ষা বাঁধকে নান্দনিক সৌন্দর্যে নানা বর্ণে সাজানো হয়েছে। বর্ণিল করে তোলা হয়েছে গোটা রাজশাহী শহরকে। সর্বত্র নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সফরসূচী অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকালে পদ্মায় নৌকাভ্রমণ করবেন রাষ্ট্রপতি। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি আগামী ২ নবেম্বর সেনাবাহিনীর-১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড (জাতীয় পতাকা) তুলে দেবেন। এর বাইরে তিনি আরও কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। রাষ্ট্রপতি মূলত সেনানিবাসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবেন আজ। কিন্তু তিনি এক সময় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ঐতিহাসিক সেল ৮ এ রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে ছিলেন। তাই সেই সেলটি পরিদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করেন। এছাড়া রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীরে থাকা টি-বাঁধ পরিদর্শন করবেন। সেখানে তিনি কিছু সময় কাটাবেন। রাজশাহী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির আগমনকে কেন্দ্র করে নানা সাজসজ্জার আয়োজন করে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গোটা রাজশাহী নানা রঙে সাজানো হয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধে আগের দিন থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। রাজশাহী জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মহানগরের বিভিন্ন পয়েন্টে রাষ্ট্রপতির আগমনকে স্বাগতম জানানোর জন্য ব্যানার ফেস্টুন টানানো হয়েছে এদিকে, রাষ্ট্রপতির আগমন উপলক্ষে শহরের টি-বাঁধের গেটের সামনেই গাড়ি ওঠানোর জন্য তৈরি করা হয় বিশেষ সিঁড়ি। পদ্মায় ভ্রমণে যাওয়ার জন্য এ সিঁড়ি তৈরি করা হবে। আর টি-বাঁধের ওপরে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী ছাউনি। পাশেই তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী শৌচাগারও। প্রতিটি গাছের গোড়া ইট দিয়ে বাঁধিয়ে রং করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আগমনে রাজশাহী মহানগর এখন অন্য রকম সৌন্দর্য পেয়েছে। যা এর আগে সেখানে ছিল না।
×