ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে ইয়াঙ্গুনে মগদের বিক্ষোভ

রাখাইনে সাত হাজার রোহিঙ্গাকে এনভিসি কার্ড দিল মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

রাখাইনে সাত হাজার রোহিঙ্গাকে এনভিসি কার্ড দিল মিয়ানমার

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতীয় যাচাই- বাছাইকরণ প্রক্রিয়ার অধীনে এ পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি বাসিন্দাকে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) প্রদান করা হয়েছে। কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী চলছে এ কার্যক্রম। এদিকে, রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো সহিংসতার জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দিত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কর্মকা-ের পক্ষে ইয়াঙ্গুনে মিছিল সমাবেশ করেছে সেনাসমর্থক এবং উগ্রপন্থী মগরা। তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়ার পক্ষে তাদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে। শুধু তাই নয়, বিক্ষোভকারীরা বলেছে, একমাত্র সেনাবাহিনীই পারে মিয়ানমারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে। একদিকে, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আশ্বাস, অপরদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দুটোই চলছে পাশাপাশি। সেনাবাহিনী এখন কোন নির্যাতন না চালালেও উগ্রবাদীদের রোহিঙ্গাবিরোধী তৎপরতার পেছনে ওই বাহিনীর ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইয়াঙ্গুনে গত রবিবার বিকেলে আয়োজিত রোহিঙ্গাবিরোধী মিছিল-সমাবেশে অংশ নেয় দুই সহ¯্রাধিক সেনা সমর্থক এবং উগ্রবাদী বৌদ্ধ। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের দাবি হলো, কোনভাবেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনা যাবে না। জাগারা নামের এক অংশগ্রহণকারী উগ্রবাদী ভিক্ষু বলেন, আমরা সেনাবাহিনীর পদক্ষেপকে সমর্থন করি। একমাত্র সেনাবাহিনী শক্তিশালী হলেই মিয়ানমারের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ থাকবে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী ৭০ বছর বয়সী এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। একইভাবে কর্মসূচীতে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলের মুখেই উগ্র স্লোগান। তাদের অনেকেই মিয়ানমারের জাতীয় পতাকা এবং রোহিঙ্গাবিরোধী ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড বহন করে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেয়ার বিপরীতে সেনাবাহিনীর সমর্থনে এমন মিছিল-সমাবেশ বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে, এ ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে। তাছাড়া দীর্ঘসূত্রতার ফলে ইস্যুটি কোন এক সময়ে আবেদন হারিয়ে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কাও অনেকের। ৭ হাজার বাসিন্দাকে ভেরিফিকেশন কার্ড প্রদান ॥ জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের আলোকে গত ১ অক্টোবর থেকে রাখাইন প্রদেশে শুরু হয় সেখানে বসবাসকারীদের যাচাই-বাছাই কাজ। এ পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি বাসিন্দা পেয়েছেন ভেরিফিকেশন কার্ড। কাজটি চলছে বেশ ধীরগতিতে। এ গতিতে চললে বর্তমানে রাখাইনে যারা রয়েছে তাদের ভেরিফিকেশন শেষ হতেই গড়িয়ে যাবে দীর্ঘ সময়। ভিয়েতনাম নিউজ এজেন্সি (ভিএনএ) রাখাইন স্টেট ইমিগ্রেশন ও জনসংখ্যা বিভাগের পরিচালক উ অং মিনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, উত্তর রাখাইনের যে সকল এলাকার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সে সকল এলাকায় যাচাই- বাছাই কাজ চলছে। এছাড়া মিয়ানমার সরকার ৯টি টাস্কফোর্স গঠন করেছে মানবিক সহায়তা পুনর্বাসন এবং রাখাইনে উন্নয়ন কাজ পরিচালনার লক্ষ্যে। রাখাইনে যাচাই-বাছাইকরণ এবং ভেরিফিকেশন কার্ড প্রদানের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, প্রদেশটির দশ লক্ষাধিক মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, যাদের সকলেই রোহিঙ্গা। ২০১২ সালে ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এ জনগোষ্ঠীকে হোয়াইট কার্ড প্রদান করা হয়েছিল, যা ২০১৫ সালে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর নাগরিকত্ব না থাকা রোহিঙ্গাদের এনভিসি কার্ড গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের দফতর। কিন্তু এ ধরনের কার্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল রোহিঙ্গারা। দলে দলে এখনও আসছে রোহিঙ্গারা ॥ ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস এবং নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চলছেই। টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে কখনও নৌকায়, আবার কখনওবা খালি প্লাস্টিক কন্টেনারে ভর করে সাঁতরে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসায় বাকিদেরও দুর্বার আকর্ষণ এদিকে। কোন আশ্বাসই তাদের আর রাখাইনে আটকে রাখতে পারছে না। গত রবি ও সোমবার এ দুদিনে এসেছে ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা। তারা প্রবেশ করেছে শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণপাড়া, জালিয়াপাড়া, ঘোলাচরসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে। অধিকাংশই আসছে পরিবার নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে। স্থানীয়রা জানান, বড়ইতলী, জালিয়াপাড়া, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া পয়েন্ট দিয়ে বহু রোহিঙ্গা ঢুকছে টেকনাফে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছে সেই পুরনো কথাগুলোই। অর্থাৎ রাখাইন প্রদেশে সেনা নির্যাতন এখনও কমেনি। তবে কোন সূত্রই তাদের এ অভিযোগ নিশ্চিত করছে না। অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা ॥ গত ২৫ আগস্ট শুরু হয় নতুন করে রোহিঙ্গা ¯্রােত। সেনা নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে তারা প্রবেশ করে লাখে লাখে। এর আগেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে এত রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ আগে ঘটেনি। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিয়ে উপায় ছিল না বাংলাদেশ সরকারের। শুরু থেকেই বেশ সহানুভূতিশীল ছিল সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় বাসিন্দা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ এবং অসামাজিক কর্মকা-ে। এদের মধ্যে থাকা কিছু সন্ত্রাসী যুবক ডাকাতি, খুন এবং মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবা ব্যবসায় সক্রিয় হয়েছে কিছু রোহিঙ্গা নারী। অনেকেই মিয়ানমার থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছে নানা ধরনের নিষিদ্ধ পণ্য, যা এখন নানাপন্থায় বিক্রির চেষ্টা করছে। এরমধ্যে অনেকে ধরাও পড়েছে। এক ধরনের উৎকণ্ঠা রয়েছে রোহিঙ্গা নারী ও যুবতীদের নিয়েও। কেননা, তাদের অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, আশ্রয় দিয়ে মানবিক আচরণ দেখালেও এরা যে অকৃতজ্ঞ, তা ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ এত সাহায্য পাওয়ার পরও তারা সেভাবে বাংলাদেশের সুনাম গাইছে না। বরং তাদের মুখ থেকে এমন বাক্যও বের হচ্ছে যে, বাংলাদেশ কিছু করছে না। এসব সাহায্য তাদের জন্য আসছে বিদেশ থেকে। স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে ॥ একমাস আগেও রোহিঙ্গাদের প্রতি যে মানবিক আচরণ স্থানীয় পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়েছিল তা এখন লোপ পেতে শুরু করেছে। এর কারণ রোহিঙ্গারাই। তারা বাংলাদেশে এসে যখন একেবারেই আশ্রয়হীন ছিল তখন স্থানীয় বাসিন্দারাই বাঁশ, গাছ, পলিথিনসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী দিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরিতে সহযোগিতা করেছে। ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসার পর তুলনামূলকভাবে তারা এখন আগের চেয়ে ভাল আছে। ফলে তাদের চলাফেরায় পরিবর্তন ঘটেছে। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় তাদের শক্তিও স্থানীয়দের চেয়েও বেশি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে পেশী প্রদর্শনের মানসিকতাও দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছামতো গাছ কাটছে, বসতি কিংবা দোকান স্থাপনের জন্য বেছে নিচ্ছে পছন্দের জায়গায়। এ সকল জায়গার মালিক কে, তা ভাবারও প্রয়োজন মনে করছে না। তাছাড়া জনসংখ্যার এ বাড়তি চাপের কারণে বেড়ে গেছে ভোগ্যপণ্যের মূল্য এবং পরিবহন ভাড়া। এতে করে ভোগান্তির শিকার স্থানীয়রা। ফলে দিনে দিনে বাংলাদেশীদের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি রোহিঙ্গাকে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে সরিয়ে নিয়ে তাদের গতিবিধি নজরদারি করতে বাড়তি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা প্রয়োজন বলে অভিমত স্থানীয়দের। অস্ত্রসহ ৫ রোহিঙ্গা ডাকাত আটক ॥ সোমবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন বাগান এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে আটক হয়েছে ৫ রোহিঙ্গা ডাকাত। ধারালো অস্ত্রসহ এদের আটক করেন র‌্যাব সেভেন কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা। র‌্যাবের মেজর মোঃ রুহুল আমিনের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। আটক রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ৫টি রামদা উদ্ধার করা হয়। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এ ৫ জনকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। র‌্যাবের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোঃ রুহুল আমিন জানান, বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন বাগান এলাকায় ৬ থেকে ৭ জনের ডাকাতের একটি দল ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ তথ্য পেয়ে পরিচালিত অভিযানে আটক করা হয়। এ পাঁচজন হলো আবু বকর, মোঃ আনোয়ার, মোঃ ফারুক, ইমরান এবং খায়ের মোহাম্মদ। এদের সকলের বাড়ি মংডু থানার বিভিন্ন গ্রামে।
×