ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নগর বিশেষজ্ঞদেও মতামত

টেকসই উন্নয়নের জন্য সব মেয়রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৩০ অক্টোবর ২০১৭

টেকসই উন্নয়নের জন্য সব মেয়রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে টেকসই নগর উন্নয়নে দেশের সকল মেয়রের একত্রে কাজ করার পক্ষে মত দিয়েছেন নগর ও নগর ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী বক্তারা। তারা বলেন, মেয়ররা একত্রিত হয়ে কাজ করলে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে নগরীর বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করতে পারবেন। পাশাপাশি পরিকল্পিত নগরী গড়তে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিকল্প কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেন বক্তারা। তারা আরও বলেন, বিশে^র সকল উন্নত রাষ্ট্রের নগরীগুলোতেও নানা সমস্যা ছিল, সেসব সমস্যা সমাধান করেই তারা সফল হয়েছে। একইভাবে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নগরীর সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের চিত্রও পাল্টে যাবে। রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘সিটিস ফোরাম: বিল্ডিং নলেজ নেটওয়ার্ক এ্যান্ড পার্টনারশীপ ফর সাসটেইনেবল আরবান ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনারের সমাপনী দিনে তারা এসব কথা বলেন। বিশ্ব ব্যাংক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল মিউনিসিপ্যাল এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাপ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি), বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট এবং সুইস এজেন্সি। সেমিনারে দেশী-বিদেশী ৩ শতাধিক মেয়র অংশ নেন। সেমিনারের সমাপনী দিনে সারাদেশ থেকে চারটি পৌর পৌরসভাকে চারটি ক্যাটাগরিতে বেস্ট পৌরসভা এ্যাওয়ার্ড ২০১৭ প্রদান করা হয়। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বিজয়ী পৌরসভার মেয়রদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন স্থীতিশীলতা। গত আট থেকে নয় বছর দেশ স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। আমরা দারিদ্র্যের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জিডিপির হার সাড়ে সাত শতাংশ। গ্রাম ও শহরের দূরত্ব কমিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে আমি আশাকরি আগামী ২০ থেকে ৫০ বছরে গ্রাম আর শহর বলতে কিছুই থাকবে না। পুরো দেশটাই শহর হয়ে যাবে। স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। সেই স্বাধীনতার সুফল আমরা পাচ্ছি। ২০১৯ সালের মধ্যে সারাদেশে বিদ্যুতায়ন সম্ভব হবে বলে আশা করেন প্রতিমন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, দরিদ্র মানুষেরা এমপিদের কাছে যেতে পারে না, কিভাবে তাদের কাছে আরও যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে পারে তা নিয়ে আমরা ভাবছি। এ সময় মেয়রদের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন। মেয়রদের পরিকল্পনামাফিক কাজ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আসতে বলেন। আমাদের টাকার কোন অভাব নেই বলেও জানান অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে প্রথম অধিবেশনে মডারেট ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট কারবারো। এই অধিবেশনে বাংলাদেশ পৌরসভা সমিতির উপদেষ্টা এ্যাড. আজমত উল্লাহ খান বলেন, ২০০৩ সালে পৌরসভা সমিতি গঠন হয়। এ ধরনের এ্যাসোসিয়েশন ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইনসহ অনেক রাষ্ট্রেই আছে। বাংলাদেশেও কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়। আমাদের কিছু দাবি ছিল। যার অনেকগুলোই এখনো পূরণ হয়নি। তবে আশার কথা হলো ২০০৯ সালে পৌরসভা আইনে পুলিশের সহায়তা বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। ম্যাপকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে তবেই উন্নয়ন সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, সরকারের নানা সংস্থা আমাদের যেমন সাহায্য চান আমারা সেভাবে কাজ করি। আমরা একটা জরিপে দেখেছি ২০ ভাগ পরিকল্পনাবিদ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। অন্যদের ভিন্ন ভিন্নভাবে কাজ করতে হয়। মেয়ররাই শেখাবে মেয়রদের ॥ বাংলাদেশের বক্তাদের পর বিদেশী নগরবীদদের অধিবেশনে ফিলিপাইনের মেয়র মেল সেনেন এস সারমিনতো বলেন, আমরা সকল মেয়রদের নিয়ে কাজ করি। সবার মতামত নেই। উন্নয়নে এর বিকল্প নেই। আমাদের দেশে পলিসি ইউনিট গঠন করেছি। যার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন পলিসিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হই। মেয়ররা আরও ভাল শিখতে পারেন আরেকজন মেয়রের কাছেই, বলেও জানান তিনি। এ জন্য নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সল্টলেক সিটির মেয়র রালফ বেকার বলেন, আমাদের কোন ভাল পরিকল্পনা যা সফল হলো গোটা শহরে তা অনুকরণ করা হতো। তখন আমরা বলতাম আমার পরিকল্পনা শহরজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের কোন মেয়র কোন সমস্যায় পড়লে কিভাবে তা সমাধান করত তা আমরা জানতাম এবং শিখতাম একই সঙ্গে চর্চা করতাম। বাংলাদেশের মেয়রদেরও অন্য মেয়রের কাছে শেখার থাকতে পারে এবং সবার শহর সুন্দর করার শুভ কামনাও প্রত্যাশা করেন তিনি। গ্লোবাল প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্টের পরিচালক ডেভিড গ্রোসম্যান বলেন, এটি করা হয় সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য। অন্যান্য সংগঠনকে নিয়ে কিভাবে সুশাসন নিশ্চিত করা যায় তার চিন্তা করে এই সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রের সকল অঙ্গরাজ্যেই এর সদস্য। আমরা নীতিমালার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করি। আমেরিকার প্ল্যানিং এ্যাসেসিয়েশনের আন্তর্জাতিক কর্মসূচীর পরিচালক জেফ সোল বলেন, শাসন ও নীতিমালা, সংস্কৃতির সম্পদ বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের সম্মেলনের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। তিনি বলেন, জাতীয় সম্মেলনে সকল মেয়র একত্র হয়ে সমস্যা চিহ্নিত করে এগুতে হবে। টেকসই উন্নয়নে সবার অংশগ্রহণ জরুরী বলেও মনে করেন তিনি। কুরিয়া রিচার্স ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান সেটেলমেন্ট এর ডাঃ জা ইয়ং ইউ বলেন, বাংলাদেশ ও কোরিয়া যে সংগঠন আছে যেখানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, জাতীয় ও নগর উন্নয়নে ১৯৯০ সালে প্ল্যান করা হলেও অংশগ্রহণ তেমন ছিল না। পরবর্তীতে স্থানীয়বাসিন্দাসহ সবার অংশগ্রহণে উন্নয়নে অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানান তিনি। স্থানীয় তথ্য আদান প্রদান, স্থানীয় অংশগ্রহণ ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত থাকতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। তাতেই উন্নয়ন ভাল হয়। যেভাবে পাল্টে গেল ব্রাজিল ॥ অপরিচ্ছন্ন ও অনুন্নত অবস্থা থেকে কীভাবে উন্নত ও দৃষ্টিনন্দন শহর করেছে ব্রাজিল তার ওপর এরপর কেস স্ট্যাডি হিসেবে ব্রাজিলের কুরিতবা নগরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন চিত্র দেখানো হয়। ব্রাজিলের কুরিতবা রিচার্স এবং শহর পরিকল্পনা ইনস্টিটিউট (আইপিপিইউসি) এর সিনিয়র উপদেষ্টা এলবার্টো মেইন ডি রোচা পেরানহোস বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, তার শহরে কোন পরিকল্পনা ৫ বছরের জন্য নেয়া হলে তা জাতীয়ভাবে অনুমোদন নেয়া হয়। এটা না নিয়ে করলে মেয়রদেরও শাস্তি থাকে। সে শাস্তি হিসেবে এখনও কেউ কেউ জেলে আছেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, কুরিতবা ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলের পারানা রাজ্যের রাজধানী। যেখানে মহানগর অঞ্চলে ২৯টি পৌরসভা বিদ্যমান। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশ। ১৯৬৫ সালে নতুন পরিকল্পনা নেয়া হয়। যেখানে মাস্টার্স প্ল্যান প্রণয়নের নির্দেশনা দেয়া হয়। তিনি বলেন, ব্রাজিলে বাসের জন্য মাঝ রাস্তা দিয়ে আলাদা ভাবে তৈরি। বাসকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ ব্রাজিলে ৭০ ভাগ মানুষ বাস ব্যবহার করে। আর আমরা অধিক মতামতকে গুরুত্ব দেই। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা যদিও এ বিষয়ে নাখোশ। ব্রাজিলের নদী নিয়ে বলেন, আমাদের শহরে মধ্যে অনেক নদী যা অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমত। এ জন্য নদীর চারপাশের পাড় অধিগ্রহণ করে আরও প্রশস্তভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। আমাদের শহর আর ময়লা হয় না এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা ঘোষণা দিলাম প্রত্যেক কেজি ময়লার পরিবর্তে সবজি দেয়া হবে। ফলে সবাই তার ময়লা নিজে এসে দিয়ে যেত। আমাদের যাওয়ারও প্রয়োজন হতো না শহরও নোংরা হয় না। এভাবে প্রত্যেক ধাপে ধাপে শহর কিভাবে এগিয়ে যায় তার চিত্র তুলে ধরেন তিনি। বেস্ট পৌরসভা এ্যাওয়ার্ড পেল যে চার পৌরসভা ॥ দুদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক এই সেমিনারের শেষ সমাপনী দিনের শেষ অধিবেশনে চারটি ক্যাটাগরিতে দেশের চারটি পৌরসভাকে বেস্ট পৌরসভা এ্যাওয়ার্ড ২০১৭ প্রদান করা হয়। ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানিং ক্যাটাগরিতে এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হয় গোপালগঞ্জ পৌরসভা। গোপালগঞ্জ পৌরসভার মেয়র কাজী লিয়াকত আলী পুরস্কার গ্রহণ করেন। পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ক্যাটাগরিতে ফুলপুর পৌরসভা এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হয়। এই পৌরসভার মেয়র আমিনুল হক পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। সিটিজেন এনগেজমেন্ট ক্যাটাগরিতে নিলফামারী পৌরসভা এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হয়েছে। এই পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হয়েছে গুড গবর্নেন্স ক্যাটাগরিতে। মেয়র নজরুল ইসলাম পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিতরণের পর অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ডাঃ এ কে এম আবুল কালাম, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি কাজী গোলাম নাসির, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোঃ কবির আহমেদ ভূইয়া, বিশ^ ব্যাংক বাংলাদেশের অপারেশন ম্যানেজার রাজস্রি এস পারেলকারসহ প্রমুখ।
×