ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিকল ল্যাপরোস্কপি মেশিন সেবাবঞ্চিত রোগী

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

বিকল ল্যাপরোস্কপি মেশিন সেবাবঞ্চিত রোগী

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ চার শ’ দিন পার হলেও যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ ল্যাপারোস্কপি মেশিনটি সচল হয়নি। ফলে প্রয়োজনীয় দক্ষ চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও এতদিনে সরকারী সেবাবঞ্চিত হয়েছে অগণিত রোগী। আর বেসরকারী হাসপাতাল এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে রোগীর কাছ থেকে ব্যবসা করেছে লাখ লাখ টাকা। ‘ফান্ড নেই’ এ অজুহাতে বিকল হয়ে থাকা বহু গুণেগুণান্বিত হাসপাতালের ল্যাপারোস্কপি মেশিনটি বছর গড়িয়ে গেলেও তা আর চালু হয়নি। মেশিনটি সাধারণত সার্জারি, গাইনি ও ইউরোলজি বিভাগের রোগীর অপারেশনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। গেলো এক বছরে সার্জারি বিভাগে ১৪ হাজার ২শ’ ৭৭ জন ভর্তি হলেও তাদের মধ্যে ল্যাপারোস্কপি মেশিনের সাহায্যে অপারেশনের জন্য যোগ্য রোগী নির্বাচিত করা হয়েছিল ১শ’ ৩৭ জনকে, ইউরোলজিতে ৬৪ ও গাইনিতে ৩৯ জনকে। কিন্তু একজনও সেবা পাননি। প্রত্যেককে পেট কেটে অপারেশন করা হয়েছে। অথচ যশোরের দুটি বেসরকারী ক্লিনিকের মধ্যে কুইন্স হসপিটালে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩শ’ ২১ এবং কিংস হসপিটালে ৪৮ রোগী ল্যাপারোস্কপি মেশিনের সাহায্যে চিকিৎসা নিয়েছেন। সামান্য ৩ লাখ টাকা যোগাড়ের অভাবে উন্নত প্রযুক্তির ল্যাপারোস্কপি মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে। অথচ স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন করার বিভিন্ন সেøাগান দিয়ে আসছে কর্তৃপক্ষ। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজের দানশীল ব্যক্তির কাছ থেকে দান- অনুদান নিয়ে ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বার, আড্ডার রুম, কনফারেন্স হলে এসি, ফ্যান, আসবাবপত্র সংযোজনের মাধ্যমে চাকচিক্য করছেন। সরকারী বরাদ্দের টাকাও ব্যয় করা হচ্ছে সাজসজ্জার কাজে। কিন্তু রোগীর উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে বরাবরই কর্তৃপক্ষ থাকছেন উদাসীন। এ অবস্থা একদিন, দু’দিনের নয়, এমনকি একমাসেরও ব্যাপার নয়, টানা এক বছর মেশিনটি ব্যবহার অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে। যশোর হাসপাতালে ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে জার্মানির তৈরি স্টোরজ কোম্পানির এই মেশিনটি সরবরাহ করে সরকার। হাসপাতালে তৎকালীন কর্মরত সার্জারি বিভাগের ডাক্তার আবু আহসান লাল্টু ও ডাক্তার আহমেদ উজ জামান রোগীর পিত্তথলীর পাথর অপসারণের ক্ষেত্রে মেশিনটি ব্যবহার করতেন। তারা অনত্র বদলি হওয়ার পর মেশিন বাক্স বন্দী করে রাখা হয়। এরপর ২০১০ সালে যশোরে মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রম শুরু হলে সার্জারি, ইউরোলজি ও গাইনি বিভাগে পর্যাপ্ত ডাক্তার নিয়োগ দেয় সরকার। সার্জারি বিভাগে ৬ ল্যাপারোস্কপিক সার্জন কর্মরত। তাদের মধ্যে একজন অধ্যাপক, ২ জন সহযোগী অধ্যাপক, একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও ২ জন সহকারী অধ্যাপক রয়েছেন। ইউরোলজি বিভাগে রয়েছেন ২ জন সহকারী অধ্যাপক। যাদের মধ্যে একজন প্রোস্টেট, কিডনিতে পাথর, প্রস্রাবের নালীর পাথর অপসারণ করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। গাইনি বিভাগের একজন ডাক্তার রয়েছেন যিনি ল্যাপারোস্কপি মেশিনের সাহায্যে অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারেন। উল্লেখিত সংখ্যক ডাক্তাররা চেষ্টা করেছেন ল্যাপারোস্কপি মেশিনের সাহায্যে রোগীকে উন্নত সেবা দেয়ার। এ মেশিনের সাহায্যে পেট না কেটে মাত্র ৩টি ছোট্ট ছিদ্র করে পিত্তথলীর পাথর অপসারণ করা সম্ভব। এমকি এ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনও করা যায়। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের নথিপত্র ঘেটে দেখা গেছে ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর সর্বশেষ এক রোগীর পিত্তথলীর পাথর অপসারণ হয়েছে মেশিনটির সাহায্যে। এই মেশিনটির দাম মাত্র ৩ লাখ টাকা। একবছর যাবৎ একাধিকবার চাহিদা দিয়েও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি সরবরাহ পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের নথিপত্র ঘেটে জানা গেছে, ২০১৬ সালের পহেলা অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্জারি বিভাগে মোট রোগী ভর্তি হয়েছে ১৪ হাজার ২শ’ ৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ বিভাগে ৭ হাজার ৮শ’ ৯০ জন, মহিলা বিভাগে ৪ হাজার ৩শ’ ৫১ জন ও শিশু সার্জারি বিভাগে ২ হাজার ৩৬ জন। হাসপাতালে ইউরোলজি বিভাগের দু’জন সহকারী অধ্যাপক সার্জারি বিভাগের আওতায় কাজ করেন। এছাড়াও শিশু সার্জারি বিভাগে ৪ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মধ্যে ১ জন রয়েছেন ল্যাপারোস্কপিক সার্জন। অর্থাৎ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে অধ্যাপক শেখ ছাইদুল হকের নেতৃত্বে জেনারেল সার্জারিতে ৬, ইউরোলজি বিভাগে ১ ও শিশু সার্জারিতে ১জনসহ মোট ৯ ডাক্তার রোগীকে ল্যাপারোস্কপি মেশিনের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা দিতে পারেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গাইনি বিভাগে এক বছরে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৯শ’ ৭৩ জন। এ বিভাগে রোগীকে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জন্য সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন ৭ জন। গাইনি রোগীদের মধ্যে ল্যাপারোস্কপি মেশিনের সাহায্যে হিস্টেক্ট্রোমি (জরায়ু ফেলে দেয়া) অপারেশন করা সম্ভব। এমনকি মেশিনটির সাহায্যে কোন নারীর সন্তান না হওয়ার কারণ নির্ণয় করে, সে মোতাবেক চিকিৎসা করাও সম্ভব। জানা গেছে, বেসরকারী হাসপাতালে ল্যাপারোস্কপি মেশিনের সাহায্যে চিকিৎসা নিতে গেলে শুধু ডাক্তারকেই দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা (রোগভেদে)। ওষুধ, হাসপাতালের আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে একজন রোগীর খরচ হয় অর্ধলাখ টাকা। এ অপারেশনটি যদি সরকারী হাসপাতালে করানো যেত তাহলে ডাক্তারের ফি লাগত না। এমনকি হাসপাতালে বাড়তি কোন খরচও নেই। সরকারী সরবরাহের ওষুধের সুবিধাও পেত রোগী। সব মিলিয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা ব্যয়ে স্বল্প সময়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারতেন গরিব অসহায় রোগী। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার একেএম কামরুল ইসলাম বেনু জানিয়েছে, ল্যাপারোস্কপি মেশিনটি সচল করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য সরকারী কোন বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। সার্জারি বিভাগ থেকে ৩ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয়ের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। সরকারীভাবে তা পাওয়া না গেলেও কর্তৃপক্ষ অন্যভাবে তা সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। তুরস্ক সরকার পরিচালিত টার্কিস কো-অপারেশন এ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন এজেন্সি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অনুদান দিচ্ছে। তাদের কাছে যশোর হাসপাতালের জন্যে ল্যাপারোস্কপি মেশিনের যন্ত্রপাতিসহ ১৮ প্রকার বিভিন্ন মেশিন সরবরাহের জন্য অর্থ অনুদান চাওয়া হয়েছে। যার মূল্য ৪৫ লাখ টাকা। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল আবেদন করার পর ৬ আগস্ট তা অনুমোদন করেছে সংস্থাটি। এরপর অনুদান নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পত্র পাঠানো হয়। গত ৩ অক্টোবর মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। আশা করা যায় আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে ল্যাপারোস্কপি মেশিন সচল করাসহ হাসপাতালে উন্নত সেবার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক মেশিন বসানো সম্ভব হবে।
×