ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপ্রবেশ থামছে না, স্থানীয়দের ভিজিএফ কার্ডের আওতায় আনার দাবি

৬০০০ একর বনাঞ্চল ও পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসতি ॥ বেসামাল টেকনাফ, উখিয়া

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

৬০০০ একর বনাঞ্চল ও পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসতি ॥ বেসামাল টেকনাফ, উখিয়া

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ সহিংসতার মুখে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা নতুন ও পুরনোসহ প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার চাপে বেসামাল অবস্থা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং উখিয়াতে। অন্তত ৬ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাহাড়ে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা বসতি। এতে করে বন যেমন উজাড় হয়েছে, তেমনিভাবে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। হঠাৎ করে একসঙ্গে এত মানুষের আবাস গড়ে ওঠায় সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হতে শুরু করেছে। অসম এ অবস্থায় স্থানীয় অধিবাসীরাও তাদের জন্য ভিজিএফ কার্ড চালুর দাবি তুলেছে। রবিবার কক্সবাজার জেলার উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষিতে প্রশাসনকেও সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য কিছু পদক্ষেপের আশ্বাস প্রদান করতে হয়। এদিকে, রাখাইনে নির্যাতন থাকা আর না থাকার মধ্যে কোন পার্থক্যই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেননা, রোহিঙ্গা স্রোত অব্যাহত রয়েছে আগের মতোই। রবিবারও ২০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল। সীমান্তের ওপার থেকে আর কত রোহিঙ্গা এলে এই ঢল বন্ধ হবে সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার কারণে উখিয়া-টেকনাফের অর্থনীতি, সামাজিক ও চলাচল ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। স্থানীয় মানুষের দুঃখ দুর্দশা বেড়েই চলছে। তরিতরকারি থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। দুই উপজেলায় রোহিঙ্গার চাপে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার এনজিওগুলোতে স্থানীয় শিক্ষিত যুবকদের চাকরি নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে। কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় এখন জনবসতি মানেই রোহিঙ্গা। বিস্তীর্ণ এই এলাকা কিছুদিন আগেও ছিল অনেকটাই জনমানবহীন। কিন্তু এখন মানুষে ঠাঁসা। রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠেছে ৬ হাজার একরের বেশি এলাকাজুড়ে। অস্থায়ী আবাসনগুলো গড়ে উঠেছে বনাঞ্চল এবং পাহাড়ে। এর ফলে অনেক গাছ কাটা গেছে। বনাঞ্চল ধংস হওয়ায় বন্যহাতি নেমে আসছে লোকালয়ে। হাতি চলাচলের পথও বন্ধ। ইতোমধ্যে বন্যহাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে বেশ ক’জন রোহিঙ্গার মৃত্যুও হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরী ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে হাজার হাজার ল্যাট্রিন। দ্রুততার সঙ্গে ল্যাট্রিন নির্মাণ করতে হয়েছে বিধায় এগুলো স্বাস্থ্যসম্মতও হয়নি। অন্তত ৫ রিংয়ের নিচে ল্যাট্রিন স্বাস্থ্যসম্মত না হলেও জরুরী ভিত্তিতে বানাতে হয়েছে মাত্র এক-দুই রিংয়ের ল্যাট্রিনও। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই এ সকল রিং ভর্তি হয়ে সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কা পরিবেশবিদদের। তাছাড়া সেখানকার মাটিও বিষাক্ত হয়ে পড়তে পারে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ৩৫ হাজার ল্যাট্রিন নির্মাণ প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কংক্রিট স্থাপনায় এগুলোর সেপটিক ট্যাঙ্ক নির্মিত হবে। ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে স্যানিটেশন কার্যক্রম পালিত হচ্ছে। তবে প্রথম দফায় ইমার্জেন্সি ল্যাট্রিন নির্মিত হওয়ায় সেগুলো হয়েছে নি¤œমানের। সরকারী এবং বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় রোহিঙ্গাদের জন্য গৃহীত কল্যাণকর পদক্ষেপের কমতি নেই। ফলে রোহিঙ্গারা প্রকারান্তরে পাচ্ছে নিরাপদ ও সুযোগ সুবিধা সংবলিত জীবনের হাতছানি। এতে করে শেষ পর্যন্ত তারা স্থায়ীভাবে আবাস গড়ে ফেলছে কিনা-তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। ৮০ ভাগ স্থানীয় নিয়োগ না হলে কোন এনজিও ঢুকতে পারবে না রবিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা। সেখানে ব্যাপক রোহিঙ্গা আগমনে উৎকণ্ঠার পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের কল্যাণে নানা দাবি উঠে আসে। প্রতিনিধিরা জানান, টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় স্থানীয় জনবসতি প্রায় ৫ লাখ। কিন্তু রোহিঙ্গা এসে পড়েছে ১০ লাখের বেশি। এতে করে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব যেমন পড়েছে, তেমনিভাবে বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য। ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা এসে পড়ায় স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হওয়ার উপক্রম। কারণ রিফিউজি ক্যাম্প থেকে চাল, ডালসহ নিত্যপণ্য তারা পাবে বিধায় স্বল্প মজুরিতেও কাজ করতে পারবে। কিন্তু বাঙালী শ্রমিকদের পক্ষে এত কম মজুরিতে কাজ করা সম্ভব হবে না। ফলে শ্রমজীবীরা ভুগছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং আশঙ্কায়। তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের নানা সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় সকল পরিবারকেও ভিজিএফ কার্ডের আওতায় আনতে হবে। প্রতিনিধিদের দাবির প্রেক্ষিতে উখিয়া-টেকনাফের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি বলেছেন, চাকরির ক্ষেত্রে স্থানীয়দের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৮০ ভাগ নিয়োগ দেয়া না হলে কোন এনজিও প্রতিষ্ঠানকে উখিয়া-টেকনাফে ঢুকতে দেয়া হবে না। এজন্য কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে দুঃখ নেই। তিনি বলেন, উখিয়া, টেকনাফ আমার এলাকা। এখানকার মানুষ যেন ন্যায্য অধিকারবঞ্চিত না হন সে বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখা আমার নৈতিক দায়িত্ব। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা নানা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর এক কিলোমিটারের মধ্যে যেসব স্থানীয় মানুষ রয়েছে তাদের ভিজিএফের আওতায় আনতে হবে। তিনি চাকরির জন্য এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বরাবরে জীবন বৃত্তান্ত জমা দেয়ার আহ্বান জানান। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আরও বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনোয়ারুল নাসের, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৗশল) লে. কর্নেল আনোয়ারুল ইসলাম ও কক্সবাজার পৌসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী। এসময় সরকারী বিভিন্ন দফতরের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আলোচকগণ বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য পরিকল্পিতভাবে স্যানিটেশন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহতায় রূপ নিতে পারে। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে নানা রোগ। তাই এখন থেকে এ বিষয়ে গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। উদ্ভট দুর্গন্ধ রোধে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নিয়মিত মেডিসিন দিতে হবে। আর কত রোহিঙ্গা আসবে বাংলাদেশে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার দেড় মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন সেখান থেকে আর নির্যাতন নিপীড়নের অভিযোগ তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু তারপরও নাফ নদী পাড়ি দিয়ে দলে দলে আসছে রোহিঙ্গা। রবিবার দুপুরের মধ্যে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে অন্তত দেড় হাজার রোহিঙ্গা। সাবরাং হারিয়াখালী বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় কাজ করে যাচ্ছে। দলের প্রধান কর্মকর্তা লে. মেহেদী পিয়াস জানান, শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ১২টি ট্রাক ও জিপে করে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। তাদের ডাল, চিড়া, বিস্কুট, শিশুদের জন্য দুধ, কাপড় দেয়া হচ্ছে এবং সরকারী-বেসরকারী সংগঠনগুলো তাদের চিকিৎসা কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। আরও তিন নারীর লাশ উদ্ধার বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতে নিহত আরও ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে শনিবার রাতে। টেকনাফে জোয়ারের সঙ্গে এ তিনটি লাশ ভেসে আসে। তিনজনই রোহিঙ্গা নারী। শনিবার রাত ১০টার দিকে লাশ তিনটি ভেসে আসার পর উদ্ধার করে স্থানীয়রা রবিবার সকালে দাফন করেছে। উল্লেখ্য, গত ৮ অক্টোবর রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাটি শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারচর এলাকায় ডুবে যায়। সর্বশেষ তিন মরদেহসহ সে ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৭টি লাশ উদ্ধার হলো। এর মধ্যে ১৬টি শিশু, ১৭ জন নারী ও চারজন পুরুষ। টেকনাফ থানার ওসি মোঃ মাইনুদ্দিন খান জানান, শনিবার রাতে যে তিন নারীর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে তাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। নৌকাডুবির ঘটনার পর থেকে টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে উদ্ধার হয়েছে ওই নৌকার প্রাণ হারানো রোহিঙ্গাদের দেহ। তিনি জানান, গত ৮ অক্টোবর ওই নৌকায় ৫০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা ছিল। তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষংদিয়া এলাকা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকার করে টেকনাফে আসছিল। এ নিয়ে গত ২৯ আগস্ট থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই ২৫টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৭১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৭০ জনই রোহিঙ্গা। বাকি একজন বাংলাদেশী মাঝি। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা লাশের মধ্যে ৮৫টি শিশু, ৫৬ জন নারী এবং ২৯ জন পুরুষ। ইয়াবাসহ ২ রোহিঙ্গা আটক রবিবার ভোর রাতে টেকনাফে দুই রোহিঙ্গা এবং ১ জন বাংলাদেশী নাগরিককে ৩০ লক্ষ টাকা মূল্যের ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করেছে বিজিবি। ধৃত ইয়াবা কারবারিরা হচ্ছে- টেকনাফ হ্নীলা ওয়াব্রাং স্লুইসপাড়ার সৈয়দ নূরের পুত্র রফিক, মিয়ানমারের মংডু নাকপুরা গ্রামের আবুল বশরের পুত্র মোস্তাক আহমেদ এবং নুরুল ইসলামের পুত্র আবদুল গফুর। টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, নাফ নদীর কিনারায় নিয়মিত টহলকালে ৫ ব্যক্তিকে ব্যাগহাতে আসতে দেখে সন্দেহ হওয়ায় চ্যালেঞ্জ করা হয়। টহল দলের উপস্থিতি লক্ষ্য করে ব্যাগসহ দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। টহল দল তাদের পিছু ধাওয়া করে তিন মাদক বহনকারীকে একটি ব্যাগসহ আটক করতে সক্ষম হয়। তবে অপর দুইজন পালিয়ে যায়।
×