ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনে জ্বলছে রোহিঙ্গা তাড়ানোর আগুন, এপারে নেমেছে ঢল

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৭ অক্টোবর ২০১৭

রাখাইনে জ্বলছে রোহিঙ্গা তাড়ানোর আগুন, এপারে নেমেছে ঢল

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাখাইন রাজ্যজুড়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন এবং বলপ্রয়োগে বিতাড়ন প্রক্রিয়া মাসাধিককালেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত রাখার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান ও টহল জোরদার করেছে। রোহিঙ্গা বিতাড়নের পাশাপাশি আরও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে সেনা সদস্যরা মংডুর পাঁচটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মহল্লায় ৩ শতাধিক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ সহ¯্র্রাধিক। পাশাপাশি নাফ নদী ও সমুদ্রপথে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এক রাতেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ২ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা। রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের নিধনযজ্ঞের ঘটনা নিয়ে সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষে সুচি সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করার পরও সেদেশের জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত আচরণ করেই যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যাতে সহজে নিজ দেশে ফিরে যেতে না পারে সে লক্ষ্যেই সীমান্তে সেনা মোতায়েন ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে বলে এপার ও ওপারের সূত্রগুলো ধারণা করছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত নাফ নদী ও সাগরপথে আরও ২ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে নৌকাযোগে। সীমান্ত উন্মুক্ত সুবাধে রোহিঙ্গারা সহজেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করছে। এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ত্রাণ সুবিধাও পাচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তে আন্তর্জাতিক সকল নিয়ম-কানুন ও রীতিনীতি উপেক্ষা করে সেদেশের সেনাবাহিনীর অবস্থান, প্রকাশ্য টহল দান, স্থলমাইন স্থাপন, বাঙ্কার প্রতিষ্ঠা, ভারি যানবাহনের উপস্থিতির কোন কারণ এখনও পরিষ্কার নয়। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক পক্ষীয়ভাব এ ধরনের কেন আচরণ করছে তা তাদের অজানা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আগামীতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কণ্টকাকীর্ণ করে তুলতেই তারা এ আচরণ শুরু করেছে। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওপারের জিরো পয়েন্টে অনতিদূরে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় সেনা সদস্যদের উপস্থিতি বেশি। প্রতিদিন রাতে তিন শিফটে সেনা টহল চলছে ওপারের জিরো পয়েন্টসংলগ্ন এলাকায়। গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে জঙ্গী দমনের নামে অসহায় রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেদেশের বিজিপি দফায় দফায় সীামান্ত আইন লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশে বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এর পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদও জানানো হয়েছে কয়েক দফায়। শুধু তাই নয়, ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে আইনবিরোধী সকল কার্যকলাপ বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়। এরপর থেকে দ্রুত সারাবিশ্বে রাখাইন রাজ্যে চলমান গণহত্যা ও বর্বরোচিত ঘটনাবলী ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করে। এমনকি জাতিসংঘের অধিবেশনেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য প্রদান করা হয়। খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দফায় দফায় রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতা, বর্বরতা, গণহত্যা, বিড়াতন, বাড়িঘর, জ্বালাও-পোড়াও’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারকে সংযত আচরণের আহ্বান জানান। ইতোমধ্যেই সামরিক অভিযানের ৪২ দিন অতিবাহিত হয়েছে শুক্রবার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিধন তৎপরতা থামছে না। প্রতিদিন প্রতিরাতে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। অপরদিকে, জান্তা সমর্থিত আউং সান সুচি সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। তারা সামরিক অভিযানকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে বলেছে, বিষয়টি জঙ্গী তৎপরতাবিরোধী অভিযানের অংশ। এ ঘটনায় যারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে তাদের যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমারে ফিরিয়ে আনা হবে। সেদেশের এনএলডি নেত্রী সুচির পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পর বিশ্ববাসী যা আশা করেছিল তাতে বড় ধরনের ছেদ ঘটেছে। কেননা, সুচি সরকার এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে যা বলেছে, তা একদিকে যেমন মিথ্যাচার, অপরদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রাখা হয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ততথ্য ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইনের মংডু পৌরসভার ৫টি রোহিঙ্গা বসতির মহল্লায় অগ্নিসংযোগ করেছে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। এতে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৩ শতাধিক বাড়িঘর। শহরের ৩নং ওয়ার্ডের সিনেমা হলের পূর্ব পাশের রোহিঙ্গা বসতির মহল্লায় সন্ধ্যার পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা অগ্নিসংযোগ করে। এরপর নয়াপাড়া, পূর্বপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও সুন্দরীপাড়ায় আগুন দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টার দিকে মাঙ্গালা পাড়ায় আগুন দেয় সেনা সদস্যরা। এ সময় রাখাইন যুবকরা রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী স্লোগান দিয়ে ধাওয়া করে। শহরের অভ্যন্তরে অগ্নিসংযোগ করলেও কোন ফায়ার সার্ভিস কর্মী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। বাড়িঘরে আগুনও নেভায়নি। শুধু তাই নয়, যারা আহত হয়েছে তাদেরও উদ্ধার করেনি। সূত্র আরও জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর নৃশংসতা শুরু হওয়ার পর এসব মহল্লার অধিকাংশ আগেভাগে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। যারা সাহস করে থেকে গিয়েছিল, তাদেরও এখন আর থাকতে দেয়া হচ্ছে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডু অঞ্চলের ৯০ ভাগ গ্রাম রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের ৭০ ভাগ বসতি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে রাখাইন যুবক ও সেনারা। রোহিঙ্গাদের ছেড়ে যাওয়া কিছু কিছু উন্নতমানের দ্বিতল কাঠের বাড়িঘর অক্ষত রাখা হয়েছে। এসব বাড়িঘরের দখল নিয়েছে স্থানীয় রাখাইনরা। অপরদিকে, নাফ নদীর উপকূলে এখনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর থেকে শুক্রবার ভোর রাত পর্যন্ত ২ সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সেনা টহল জোরদার ॥ বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে স্থায়ীভাবে অবস্থান নিতে শুরু করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বিশেষ করে জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গা অবস্থান রয়েছে এ ধরনের তিনটি স্থানে দিনরাত পালা করে বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) পাশাপাশি সেনাবাহিনীও দায়িত্ব পালন করছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে দেশের বর্ডার গার্ড বাহিনী। সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন আন্তর্জাতিক রীতির লঙ্ঘন। এ অবস্থায় টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি নজরদারি বাড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির নজরদারি আরও বৃদ্ধি ॥ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষীদের সকল নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)এর পক্ষ থেকেও সীমান্ত পরিস্থিতিতে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, শুক্রবার সকাল থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্তের ওপারে সেদেশের সেনা ও বিজিবি সদস্যদের ভারি অস্ত্র সাজে সজ্জিত অবস্থায় টহল দিতে দেখা গেছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা দিনে-রাতে পালাক্রমে এ টহল তৎপরতা চালাচ্ছে। গত তিন দিন আগে টহল তৎপরতা পরিলক্ষিত হলেও তা এখন জোরালো হয়েছে। তুমব্রু সীমান্ত এলাকা ছাড়াও চাকমাপাড়া এবং বাইশারী সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিজিবির তৎপরতা বেশি। জিরো পয়েন্টে অনতিদূরে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য রীতিমতো ঘাঁটি গেড়েছে। এদিকে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিজিপি সদস্যদের এ ধরনের তৎপরতা উস্কানিমূলক। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিজিবি সদস্যদের উস্কানিমূলক কোন ফাঁদে পা না দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। শুধু তাই নয়, সর্বক্ষেত্রে আচরণ সংযত রাখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মকা- অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান আবারও জানিয়েছেন, কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে তৎপরতা চালিয়ে যাবে বাংলাদেশ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী সদস্যদের সীমান্ত আইন দফায় দফায় লঙ্ঘন করলেও এর জবাব দেয়া হচ্ছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। এছাড়া সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে চলে আসতে পারে তা নিয়ে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে না। কিন্তু হাজার হাজার রোহিঙ্গা নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান করে যাচ্ছে। বিজিবির কক্সবাজার সদর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিজিপি সদস্যদের এ ধরনের তৎপরতায় আমরা কোন হুমকি মনে করছি না। আমরা আমাদের যা যা করণীয় তাই করছি। উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ চলমান রেখে সেদেশের হেলিকপ্টার একাধিকবার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ড্রোনও পাঠিয়েছে। এছাড়া সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থলমাইন স্থাপন করেছে। বাঙ্কার প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। বিজিবির কাছে সব কিছু তথ্য রয়েছে। তারা যা করছে তা একতরফা। এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা এ ব্যাপারে কমান্ডিং অফিসার পর্যায়ে প্রতিবাদ পাঠানো অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে যা প্রতীয়মান হচ্ছে তারা কোনকিছুরই তোয়াক্কা করছে না। এরপরও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে সব ধরনের সহিংসতার পথ পরিহার করে চলা হবে। সীমান্তে কর্মরত বিজিবির এক সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী গায়ে পড়ে কিছু একটা করতে চায়। আমরা ধারণা করছি, রোহিঙ্গা ইস্যুটি ধামাচাপা দিতেই তারা ভিন্নপথে এগোতে চায়। আমরা তাদের কোন ফাঁদে পা দেব না। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ নির্দেশনা রয়েছে। নির্দিষ্ট ক্যাম্পে যেতে অনীহা রোহিঙ্গাদের ॥ মানবেতর জীবনে থাকলেও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে জিরো পয়েন্টে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা উখিয়ার বালুখালী নির্দিষ্ট ক্যাম্পে যেতে অনীহা প্রকাশ করে যাচ্ছে। ফলে সরকার এসব রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করলেও তাতে গতি আসছে না। শুক্রবার তুমব্রু এলাকায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পক্ষে জানানো হয়েছে, প্রাণ বেঁচে তারা এ স্থানে এসেছে। নানা কষ্টে স্বীকার করে তারা ইতোমধ্যে প্রাণে বেঁচে থাকার তাগিদে বসতি গড়ে তুলেছে। এখানে তারা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এখান থেকে নতুন স্থানে নেয়া হলে তাদের দুর্ভোগ বাড়বে। নতুন করে জীবনযাপন শুরু করতে হবে। একেত সব হারিয়ে রাখাইন থেকে তারা এদেশে এসেছে। আশ্রয় মিলেছে। ত্রাণ সহায়তাও পাচ্ছে। নতুন জায়গায় গেলে আবার কোন অনিশ্চয়তা তাদের উপর ভর করে তা নিয়ে তাদের মাঝে শঙ্কা রয়েছে। জীবন বাঁচাতে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ রোহিঙ্গা আশ্রয় হয়েছে টেকনাফের পুঠিবনিয়া, শামলাপুর, লেদা, উখিয়ার কুতুপালং, পালংখালী, তাজনিরমার খোলা ও বালুখালী ক্যাম্পে। তবে বান্দরবানের তুমব্রু, বাইশারি ও চাকডালা সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে অনেকেই। নাইক্ষ্যংছড়িতে থাকা রোহিঙ্গাদের উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে যেতে নারাজ। তারা বলে দিচ্ছে তাদের নাকি নোয়াখালী হাতিয়ার ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই রোহিঙ্গারা গাড়িতে উঠতে চাইছে না। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, তুমব্রু সীমান্তের পশ্চিমকূলে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা। আর নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের চাকডালা সীমান্তে রয়েছে আরও ১০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা। এর মধ্যে এখানকার রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ৩ অক্টোবর থেকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পশ্চিমকূলের ৫০ রোহিঙ্গা পরিবারের ২২১ জনকে কুতুপালং ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, পর্যায়ক্রমে এখানকার অন্য রোহিঙ্গাদেরও স্থানান্তর করা হবে কুতুপালং ক্যাম্পে। তবে তারা যেতে চাইছে না। তাদের মধ্যে এক ধরনের অজানা শঙ্কা বিরাজ করছে। তাদের নানাভাবে বোঝানো হচ্ছে। ফলে অনেকের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব রোহিঙ্গারা এসেছেন, তাদের জন্য সরকার কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছে। যতদিন পর্যন্ত তারা নিজ দেশে ফিরে না যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত তারা সেখানেই থাকবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আনায়নে সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বান্দরবানের রোহিঙ্গাদেরও পর্যায়ক্রমে কুতুপালংয়ে স্থানান্তর করা হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে। এখানে রোহিঙ্গাদের থাকাটা নিরাপদ নয়। যে কোন মুহূর্তে মিয়ানমার বাহিনীর হামলার ঝুঁকি রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা আশ্রয় ও ত্রাণ সহায়তার কথা চিন্তা করেই তাদের কুতুপালং ক্যাম্পে সরিয়ে নেয়ার তৎপরতা চলছে। ত্রাণ তৎপরতা ও চিকিৎসাসেবা ॥ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান অব্যাহত চলছে। এর পাশাপাশি সেনা তত্ত্বাবধানে কুতুপালং এলাকায় চলছে আশ্রয় শিবির নির্মাণ। সরকারী-বেসরকারী ও দেশী-বিদেশী সাহায্য সংস্থার পক্ষ থেকে ত্রাণ প্রদান তৎপরতা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিত্তশালীদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সাহায্য প্রদানের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। প্রাপ্ততথ্য অনুযায়ী পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে লক্ষাধিক শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। আর হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী রয়েছে সন্তান প্রসবের অপেক্ষায়। এদের নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। টেকনাফ উপকূলেই রোহিঙ্গা স্রোত ॥ বর্তমানে টেকনাফের বিস্তীর্ণ উপকূল দিয়েই মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আগমন অব্যাহত রয়েছে। শত শত নৌকাযোগে এরা নাফ নদী ও উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ে পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। বাংলাদেশ সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনুপ্রবেশকারীদের গ্রহণ করা হচ্ছে। এদের নাম তালিকাভুক্ত করে উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে প্রেরণ করছে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সুপেয় পানির ব্যবস্থা ॥ উখিয়া ও টেকনাফে ১২ অস্থায়ী রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রে মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে সরকারী উদ্যোগে নেয়া স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির উৎস স্থাপন কাজ জোর গতিতে এগিয়ে চলছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নলকূপ বসানো ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে নলকূপ ও টয়লেটের সংখ্যা। ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৫শ’ টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। আরও ১৭ হাজার ৫শ’ টয়লেট স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ১ হাজার ৯শ’ সেনিটারি টয়লেট, ১ হাজার ৫২৮ টিউবওয়েল স্থাপন করেছে। এছাড়াও ১৪টি মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও ৭টি ওয়াটার ট্রাকের মাধ্যমে খাবারের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তিন হাজার লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৬টি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ক্যারিয়ারের মাধ্যমে উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন ক্যাম্পে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পানি বিতরণ ব্যবস্থা সুবিধাজনক করার লক্ষ্যে রাস্তার পাশে ১ হাজার লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৮টি ওয়াটার রিজার্ভার স্থাপন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কক্সবাজারে ইতোমধ্যে ৪ লাখ ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট মজুদ করা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ভা-ারে আরও ১৬ লাখ ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট মজুদ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ রোধে ইতোমধ্যে ২৯ ড্রাম ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হয়েছে এছাড়া বিপুল পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার মজুদে রাখা হয়েছে। জিহাদি ভিডিওসহ আটক ব্যক্তি কারাগারে প্রেরণ ॥ কক্সবাজার জেলার উখিয়া পালংখালী বাজারে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ জিহাদি ভিডিওসহ আটক ব্যক্তিকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা বুধবার পালংখালীর মৃত আহমদ হোসেনের পুত্র মোঃ কামাল হোসেনকে সিপিইউ, মনিটর, স্পীকার ও পেনড্রাইভসহ আটকের পর উখিয়া থানায় সোপর্দ করা হয়েছিল। শুক্রবার কামাল হোসেনকে আদালতে নির্দেশ অনুযায়ী কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ওপারে হিংস্রতা, এপারে মানবতা ॥ সীমান্তর ওপারে রাখাইন রাজ্যজুড়ে সেনা সদস্য ও উগ্রবাদীদের বর্বরতা, গণহত্যা, বাড়িঘরে আগুন, নারী ধর্ষণ, বলপ্রয়োগে বিতাড়ন প্রক্রিয়া চলছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। তাদের এ অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের জন্য বহুমুখী ক্ষতি ডেকে আনছে এরপরও বাংলাদেশ মানবতার হাত সম্প্রসারিত করে রেখেছে। মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য বাংলাদেশ আশ্রয় ত্রাণ সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে যে সোচ্চার ভূমিকা রেখে চলেছে তাতে রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রাণে বেঁচে থাকার বিশ্বাস জন্মেছে। তারা মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্ত রক্ষীদের বর্বর আচরণ দেখেছে। আর এপারে এসে সেনা ও সীমান্তরক্ষীদের আচরণ দেখছে ভিন্ন। এপারের মানবতা, ওপারের হিংস্রতাকে হার মানাচ্ছে। অনেকে ফিরতে চায়, অনেকে চায় না ॥ রাখাইন রাজ্যে সেনা বর্বরতায় প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অনেকেই নিজ ভূমে ফিরে যেতে চায় আবার অনেকে চায় না। যারা সহায় সম্পদ ফেলে এসেছে তাদের রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। আর যারা সর্বহারা হয়েছে তাদের মাঝে ফিরে যেতে কোন আগ্রহই নেই। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচাতে এবং সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয় প্রদানের যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে তারা বিস্মিত। শত বেদনার মাঝেও তারা বেঁচে থাকার নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে। এতে তাদের মাঝে উল্লাস না থাকলেও প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দটুকু রয়েছে।
×