ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বুচিদং-রাচিদংয়ে খাদ্যাভাবে মারাও যাচ্ছে . নিরাপত্তা পরিষদেও রোহিঙ্গারা অধিকার বঞ্চিত

রাখাইনে সেনা অভিযান এখনও চলছে ॥ তিন লাখ রোহিঙ্গা জিম্মি

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১ অক্টোবর ২০১৭

রাখাইনে সেনা অভিযান এখনও চলছে ॥ তিন লাখ রোহিঙ্গা জিম্মি

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান এখনও চলছে। রাজ্যের চারটি শহর সিটওয়ে, মংডু, রাচিদং ও বুচিদংয়ের বিভিন্ন স্থানে থাকা ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখন জিম্মি অবস্থায় রয়েছে। এরা পালানোর সুযোগও পাচ্ছে না। ফলে খাদ্যাভাব শুরু হয়েছে। খাদ্যের অভাবে মারাও যাচ্ছে। বেশিরভাগ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ঘরে থাকলেও মৃত্যু, আর বেরিয়ে এলে নৃশংস কায়দায় নিশ্চিত প্রাণহানি। ফলে সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এখন ভিন্নমুখী বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। রাখাইনে সামরিক অভিযান এবং সন্ত্রাসীদের দমন-নিপীড়ন ও বর্বরোচিত আচরণ এবং গণহত্যার শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক একটি অংশ। আর প্রাণ বাঁচাতে যারা মরণ যন্ত্রণার শিকার হয়ে কোন রকম বাংলাদেশে পৌঁছে আশ্রয় পেয়েছে তাদের শেষ ভরসা ছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর উদ্যোগের প্রতি। কিন্তু বিধিবাম। বিশ্ববাসীর শেষ ভরসাস্থল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেও রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক কোন আচরণের পক্ষে সিদ্ধান্ত এলো না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সশস্ত্র অভিযানে নির্বিচারে গণহত্যায় যেসব রোহিঙ্গা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে তারা তাদের জীবন বাঁচানোর নিরন্তর সংগ্রাম থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর যারা এখনও বেঁচে আছে এবং বাংলাদেশে প্রায় ৬ লাখ আশ্রয়গ্রহণ করেছে তারা ত্রাণ সহায়তা পেলেও মরণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আছে। অপরদিকে রাখাইন রাজ্যের চার টাউনশিপ সিটওয়ে, মংডু, বুচিদং ও রাচিদং শহরের বিভিন্ন স্থানে বসতিগুলোতে এখনও ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা গৃহবন্দী অবস্থায় অনাহারে অর্ধাহারে প্রাণ হারানোর ঝুঁকিতে চরম শঙ্কায় রয়েছে। রাচিদংয়ের আন্ডাং গ্রামে গত একসপ্তাহ ধরে ব্যাপক খাদ্যাভাবের জের হিসেবে এ পর্যন্ত চার রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে বলে সীমান্তের ওপার থেকে খবর পাওয়া গেছে। সেনা বর্বরতায় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদ সর্বশেষ যে বৈঠক আহ্বান করেছিল তাতে দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়ার সমর্থন না মেলায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শেষ ভরসাস্থলটুকুও তাদের বঞ্চিত করেছে। এ বঞ্চনার কারণে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য এখন ভয়ানক লাঞ্ছনা গঞ্জনা অপেক্ষা করছে। এমনিতেই তারা ছিল নিজ দেশে পরবাসি। আর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে তাদের বেঁচে থাকতে হবে অনুপ্রবেশকারী বা শরণার্থী হিসেবে। রোহিঙ্গাদের জন্য এ পথ বন্দুর এবং তা অসহনীয়ও বটে। তবে তাদের মাঝে একটিমাত্রই সান্ত¦না প্রোথিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রতি মানবিকতার হাত সম্প্রসারিত করার ফলে তারা এখনও প্রাণে বেঁচে আছে। গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে রাখাইন রাজ্যে সেনা নেতৃত্বে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর প্রাণ বাঁচাতে তাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ অভিমুখী হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। দিনের পর দিন রাতের পর রাত মাইলের পর মাইল হেঁটে কখনও দলে দলে, কখনও বিশাল কাফেলা আকারে এরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। শনিবারও দুদেশের সীমান্তের জিরো পয়েন্টগুলোতে হাজার হাজার রোহিঙ্গার অবস্থান ছিল। মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া শক্তভাবে সংস্কার ও এর বিস্তৃতি ঘটানোর ফলে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে সমুদ্র পথকেই বেছে নিয়েছে। সমুদ্রের সেই উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে নতুন লড়াই করে কেউ টেকনাফের উপকূলে আসতে সক্ষম হয়েছে। আবার অনেকে বৈরী আবহাওয়া ও উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবে প্রাণ হারিয়েছে। সারাবিশ্ব এ অমানবিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। গণহত্যা, নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি একের পর এক আহ্বান জানিয়েছে খোদ জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বিশ্বের শক্তিধর এবং শক্তিহীন অধিকাংশ রাষ্ট্র। কিন্তু মিয়ানমারের জান্তা সমর্থিত সরকার কোন কিছুতেই কর্ণপাত করেনি, এখনও করছে না। এ অবস্থায় বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে নিরাপত্তা পরিষদ ২৯ সেপ্টেম্বর শুধু রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে জরুরী বৈঠক ডেকেছিল তার সমাপ্তি ঘটেছে কার্যকর কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই। রাখাইন রাজ্যে নিপীড়িত, ভিটেমাটি ছাড়া রোহিঙ্গারা এতে করে নতুন বঞ্চনার শিকার হলো। দুর্ভাগ্য রোহিঙ্গাদের। আর মানবতার হলো চূড়ান্ত পরাজয়। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার হাত সম্প্রসারিত করার দীর্ঘ জের টানতে হবে গরিব রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেই। ব্যাপক আশা আকাক্সক্ষা নিয়েই বাংলাদেশসহ বিশ্ববিবেক অপেক্ষা করছে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের দিকে। কিন্তু সিদ্ধান্ত যা হয়েছে তা প্রহসন ছাড়া আর কি-বা বলা যেতে পারে- এ প্রশ্নই এখন বিশ্বজুড়ে সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে জাতিসংঘ মহাসচিব শুরু থেকে এ ঘটনা নিয়ে সোচ্চার ভূমিকায় থেকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন, সেখানে শুধু চীন এবং রাশিয়ার কারণে সবই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আর এ কারণে গত শুক্রবার থেকে রাখাইন রাজ্যের উত্তর মংডু এলাকায় সামরিক অভিযানের গতি নতুন করে মোড় নিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এটাই প্রতীয়মান, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আর শেষ রক্ষা হলো না। রোহিঙ্গাদের সমূলে নিধন ও বিতাড়নে মিয়ানমার এখন আরও শক্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছে। রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য করতে মিয়ানমার সরকার জান্তা বাহিনীর হিংস্র সদস্যদের নামিয়ে নির্বিচারে যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং এখনও তা চলছে এতে রোহিঙ্গারা নামে মানুষ হলেও মূলত কীটপতঙ্গের চেয়েও মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। ঘটনার পর ঘটনা, হত্যার পর হত্যা, ধ্বংসের পর ধ্বংস, বসতির পর বসতি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। এ জীবন তাদের জন্য সুখকর নয়Ñ বেদনা, স্বজনহারা, ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে সীমাহীন প্রবঞ্চনার। রোহিঙ্গাদের সকল আহাজারি, আকুতি, অনুনয়, বিনয় সবই গেল বিফলে। রোহিঙ্গাদের জন্য সমব্যাথি হলেও সীমাবদ্ধতার কারণে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশকে বড় ধরনের বেগ যে পেতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া দু’দেশের সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগামীর পরিস্থিতি কি হবে তা নিয়েও ইতোমধ্যে নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। দশকের পর দশক জুড়ে রোহিঙ্গারা প্রাণ হারাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। যুবতী ও নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। তাদের নাগরিকত্বসহ মৌলিক সব অধিকার বহু আগে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এরপরও তারা বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু এবার সে অবস্থানও ধরে রাখা গেল না। বর্বরোচিত কায়দায় সমূলে উৎখাত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে জান্তা সমর্থিত সুচি সরকার। এদিকে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাখাইনে ৪৮৬টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামের মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে সেনাবাহিনীর সদস্য ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা। শনিবার পর্যন্ত ৩৬ দিনের টানা সেনা বর্বরতায় ৬ সহস্রাধিকেরও বেশি রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এ সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশ্ব সোচ্চার হলেও এর কোন তোয়াক্কা না করে মিয়ানমার সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েই যাচ্ছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করছে একের পর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা ভিটাবাড়ি ফেলে দলে দলে আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। এরপরও রাখাইন রাজ্যের বুচিদং, রাচিদংসহ কয়েকটি অঞ্চলে এখনও সাড়ে ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ হাতে নিয়ে নিজ নিজ বাড়িঘরে রয়ে গেলেও তারা জিম্মি অবস্থায় রয়েছে। এক কথায় গৃহবন্দী। ঘর থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ মিলছে না। ফলে খাদ্যাভাব এখন তাদের জন্য নতুন বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি বহু রোহিঙ্গা। ৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেলেও এ সংখ্যা আরও সহসা বহুগুণ বেশিতে উন্নীত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাখাইনের পশ্চিম-দক্ষিণ ও উত্তরের গ্রামগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। তবে পূর্ব দক্ষিণের রোহিঙ্গাদের সংখ্যা একটু কম। ওইসব গ্রাম থেকে বাংলাদেশে আসতে হলে কয়েকটি পাহাড়ী এলাকা হেঁটে পৌঁছতে হবে বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায়। ফলে ওইসব রোহিঙ্গাদের পক্ষে এ দুর্গম পথ অতিক্রম করাও অনেকটা দুঃসাধ্য। এছাড়া সেনা সদস্যরা এদের কাউকে বাড়িঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। দিনে-রাতে শুধু গুলি আর গুলির আওয়াজ। কখন কে কোথায় মরছে তা জানাও একটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য নৌকা ডুবি ॥ টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপ, সাবরাং, নোয়াপাড়া, খোরের মুখ, হাজম পাড়া, মহেশখালিয়া পাড়া, তুলাতুলি, লম্বরী, দরগারছড়া, রাজারছড়া, নোয়াখালী, শাপলাপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে অসংখ্য মাঝিমাল্লা ও দালাল রয়েছে যারা রোহিঙ্গা পারাপারে রীতিমতো ব্যবসা গেঁড়ে বসেছে। এসব মাঝিমাল্লারা প্রতিনিয়ত সাগর পথে রোহিঙ্গাদের এ পারে নিয়ে আসছে। আসার পথে ইতোমধ্যে বহু নৌকা ডুবেও গেছে। এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। টেকনাফ থেকে ইনানী উপকূল পর্যন্ত লাশ উদ্ধার হয়েছে বহু। যার মধ্যে পচা ও গলিত লাশও রয়েছে। দাফন হয়েছে ১২২। তবে আইএমওর পক্ষ থেকে ৬০ রোহিঙ্গা নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে। অপরদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় বহু রোহিঙ্গা এখনও নিখোঁজ রয়েছে। সাগরে যে এদের সলিল সমাধি হয়েছে তা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়। হিন্দু হত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান ॥ রাখাইনে হিন্দুদের হত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। উত্তর রাখাইনের একাধিক গণকবর থেকে এ পর্যন্ত ৪৫ হিন্দুর মরদেহ উদ্ধারের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী এ হত্যাকা-ের সঙ্গে আরসার বিদ্রোহীরা জড়িত বলে অভিযোগ তোলে। রাখাইনের যে এলাকার গণকবর থেকে নারী শিশুসহ ৪৫ হিন্দুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সেখানে সে দেশের কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে যায়। হিন্দুদের হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়েছে আরসা। এতে বলা হয়েছে, আরসা এবং সংগঠনটির কোন সদস্যই হত্যা, যৌন সহিংসতা অথবা জোর করে সংগঠনে যুক্ত করার মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়। এক টুইট বার্তায় ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের দোষারোপ না করে আসল পরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহিত না করার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আরসা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন শিশু ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন নতুন নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে। গত এক মাসে সাড়ে তিন শতাধিক শিশুর জন্ম হয়েছে। কক্সবাজারের সিভিল সার্জনের দফতর সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ক্যাম্পের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে শিশুর জন্ম হচ্ছে। যার সঠিক তথ্য প্রশাসনের কাছে নেই। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে ঘরে ঘরে আছে গর্ভবতী নারী। প্রায় ৭০ হাজারের বেশি গর্ভবর্তী মহিলা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এমন তথ্য রয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে। সিভিল সার্জন ডাঃ শেখ আবদুস সালাম জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। তাঁর মতে, গড়ে প্রতিদিন ১২ শিশুর জন্ম নিচ্ছে। অপরদিকে এলাকার হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিভিন্ন এনজিও চিকিৎসা কেন্দ্রে যেসব রোগী আসছে তাদের মধ্যে অধিকাংশই গর্ভবতী মহিলা। রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবায় উখিয়ায় ২১টি ক্যাম্পের মধ্যে বালুখালি, কুতুপালং, রেজিস্টার্ড চিকিৎসা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ডেলিভারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে অনেক শিশু। আরও ১৩০০ শিক্ষা কেন্দ্রে ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য আরও ১৩শ’ শিক্ষা কেন্দ্র তৈরির ঘোষণা দিয়েছে ইউনিসেফ। জাতিসংঘের ইউনিসেফের পক্ষ থেকে শিশুদের নিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। শিক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা আগামীতে দেড় হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এসব শিক্ষা কেন্দ্রে ৪ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা এবং ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের অনানুষ্ঠানিক মৌলিক শিক্ষা দেয়া হবে। রোহিঙ্গা শিশুদের তিন শিফটে চলবে পাঠদান কার্যক্রম। শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের কাউন্সিলিংও করা হবে। এসব শিশুদের জন্য বই, খাতা, কলম, রঙিন পেন্সির ও স্কুলব্যাগসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করবে ইউনিসেফ। শাহপরীর দ্বীপে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ॥ টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে নৌকায় করে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসছে। শনিবার পর্যন্ত গত তিন দিনে ৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু এসেছে সাগর পথে। মিয়ানমার থেকে নৌকায় করে শাহপরীরদ্বীপ জেটি হয়ে প্রতিদিন অনুপ্রবশ করছে রোহিঙ্গারা। এরপর তারা ফের নৌকায় করে টেকনাফে যাওয়ার পথে প্রবেশদ্বার মাথাভাঙ্গা থেকে তারা পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। আবার অনেকে সেনা সহায়তায় উখিয়ার বালুক্যাম্পে পৌঁছে যাচ্ছে। টেকনাফ থেকে ইনানী পর্যন্ত সাগর উপকূলে এমন কোন পয়েন্ট নেই যেখানে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা দিনে রাতে ভিড়ছে না। বিশেষ করে রাতের আঁধারে মিয়ানমারের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রওনা হয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই পৌঁছানোর চেষ্টা করে থাকে। আবার অনেকে দিনের আলোতেও আসছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তের সবক’টি পথ খোলা রয়েছে। ফলে এরা অবাধে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারছে। অনুপ্রবেশের পর কে কোথায় চলে যাচ্ছে তার কোন হদিস নেই। প্রশাসনের পক্ষে সেনা, বিজিবি, পুলিশ সদস্যরা চেষ্টা করছে এদের উদ্ধার করে বালুখালির নির্দিষ্ট ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার। মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু সিকদার পাড়ার ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসা হাকিম আলী জানিয়েছেন, শনিবার সকালে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে নৌকায় করে তারা ২৫ জন শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছান। তিনি জানান, রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন এখনও চলছে। দু’দিন আগেও কয়েকটি বাড়ি ঘরে আগুন দিয়েছে। তিনিসহ পরিবারের ছয় সদস্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এখানে আসার পরপরই তিনি ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন। ইয়াবাসহ তিন রোহিঙ্গা আটক ॥ টেকনাফে ২১ হাজার পিস ইয়াবাসহ মিয়ানমারের নাগরিক ৩ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি। শনিবার সকালে মিয়ানমার হতে নৌকাযোগে নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফের বড়ইতলী সীমান্ত দিয়ে পাচারকালে তাদের আটক করা হয়। ধৃতরা হচ্ছে মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু থানার আশিক্কা পাড়ার মোঃ ইউনুছ আলীর পুত্র মোঃ ফয়সাল, নাইটার ডেইল গ্রামের ফয়েজ আহম্মদের পুত্র মোহাম্মদ আলী ও কাইয়ংখালী গ্রামের রশিদ আহমদের পুত্র মোঃ আব্দুল। টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, ইয়াবার একটি চালান টেকনাফের বড়ইতলী (উঠনী) সংলগ্ন নাফ নদীর কিনারা দিয়ে পাচারের সংবাদে একটি টহলদল টেকনাফের কেওড়া বাগানে অবস্থান নেয়। পরে ২০ হাজার ৯২৫ পিস ইয়াবা, তাদের একটি হস্তচালিত কাঠের নৌকা, নগদ দুই হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রভাব স্থানীয়দের জীবন যাত্রায় ॥ কক্সবাজার উখিয়া-টেকনাফে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে স্থানীয়দের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে। এমন কোন স্থান নেই যেখানে রোহিঙ্গাদের অবস্থান হয়নি। সর্বত্র রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গায় একাকার হয়ে আছে। সার্বিক পরিবেশে বড় ধরনের ভোগান্তি নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, ভোগ্যপণ্য, ওষুধসহ হেন কোন পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। ত্রাণ সহায়তা যতই আসুক না কেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতির বড়ই নাজুক অবস্থা। স্থানীয়রা নিজেদের চলমান জীবন নিয়ে দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। রোহিঙ্গা চাপে জর্জরিত এই জনপদ এখন বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সরকার এসব রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত সম্ভব যথাস্থানে নিয়ে পুনর্বাসন না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
×