ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ মিনারে গগন শিরীষ তলেসর্বস্তরের মানুষের অন্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি

চিরশয়ানে কণ্ঠযোদ্ধা আবদুল জব্বার

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চিরশয়ানে কণ্ঠযোদ্ধা আবদুল জব্বার

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেকের মতো তিনিও লড়েছিলেন। অস্ত্রের বদলে স্বদেশের মুক্তির আকাক্সক্ষায় গেয়েছিলেন গান। সুরের আশ্রয়ে ভালবাসা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন সঙ্গীতানুরাগী শ্রোতাসহ সর্বসাধারণের অন্তরে। সেই কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল জব্বারের বিদায়বেলায় অনুরাগীদের সঙ্গে যেন কেঁদে উঠল প্রকৃতিও। তার শবদেহটি যখন আপামর মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য রাখা হলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তখন অঝোর ধারায় ঝরেছে ভাদ্রের বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে জলে ভেজা শরীরে লাল গোলাপের ভালবাসায় শিল্পীকে চিরবিদায় জানিয়েছেন ভক্ত, অনুরাগী, শুভাকাক্সক্ষী ও স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সহযোদ্ধারা। বৈরী আবহাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে সবাই মিলে জানিয়েছেন শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি। নিজের অজান্তেই হয়তো অনেকের মনে পড়েছে শিল্পীর গাওয়া সেই গানের বাণী ‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা/এবার দাও গো বিদায়...’। দুই দফা শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব ও জানাজা শেষে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার নিয়ে বৃহস্পতিবার চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক আবদুল জব্বার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং তার দীর্ঘ সময়ের কর্মস্থল আগারগাঁওয়ের বেতার ভবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দুই দফা জানাজা শেষে বিকেলে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। সকালে বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে শিল্পীর শবদেহবাহী কফিনটি নেয়া হয় বেতার ভবনে। সেখানে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের পাশাপাশি বেতারের কর্মকর্তা ও কলাকুশলীরা। জানাজা শেষে শিল্পীকে জানানো হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্যসচিব মরতুজা আহমদ, বেতারের মহাপরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় বিসিএস তথ্য-সাধারণ বেতার কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীসংস্থা ও রেডিও এ্যানাউনসার্স এ্যাসোসিয়েশন। হাসানুল হক ইনু বলেন, আবদুল জব্বার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ কণ্ঠসৈনিক। সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকতেন এবং পাকিস্তানীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, গানের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে বাঙালী জাতিসত্তার, ঐতিহ্যের পক্ষে ভূমিকা রাখতেন। তার সব কাজ সংরক্ষণ করার জন্য বেতার, ডিএফপিসহ সরকারী দফতরগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী। আবদুল জব্বারের বড় ছেলে মিথুন জব্বার বলেন, এই রেডিও থেকে তার এক জীবনের শুরু। আজ তার আরেকটি জীবন শুরু হচ্ছে, আরেকটা জীবন প্রবাহিত হবে। উনি লড়াই করেছিলেন শেষ সময় পর্যন্ত। যতই বয়স হোক না কেন, সিংহ কিন্তু লড়াই করে। বাবা চলে যাননি, এই বেতারের মধ্যেই স্মৃতি হয়ে তিনি আছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আবদুল জব্বারের অনুরাগের কথা তুলে ধরে মিথুন জব্বার বলেন, বাবা আমাকে বলত, আমি বাবাকে হারিয়েছি, তবে আজও আমি বাবাকে নিজের মনের মধ্যে ধরে রেখেছি। আর বাবা বলতে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই বুঝতেন। বেতারের নিজস্ব শিল্পীসংস্থার মহাসচিব গাজী আবদুল হাকিম বলেন, একটি নক্ষত্রের পতন হলো। তিনি আজীবন রাজার মতো রাজত্ব করে গেছেন। শেষ দিন পর্যন্ত বেতারে কর্মরত ছিলেন। তুমুল বৃষ্টির মাঝেই বেলা সাড়ে এগারোটায় শিল্পীর শবদেহ নিয়ে আসা হয় ভাষাশহীদদের স্মৃতির মিনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। গগন শিরীষ বৃক্ষতলে কালো কাপড়ে ঢাকা অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয় মরদেহ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে এই নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানে ঢল নামে মানুষের। স্বদেশের ভাবনাতাড়িত প্রিয় শিল্পীকে বিদায় জানাতে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। এখানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়া আকরাম ইবনে সাজ্জাদের নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেয়া হয় আবদুল জব্বারের মরদেহ। শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন পর্বের প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার মুখ্যসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের । সহযোদ্ধা শিল্পীকে শেষবারের মতো ভালোবাসা জানিয়েছেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক সৈয়দ হাসান ইমাম, আশরাফুল আলম, শাহীন সামাদ, নমিতা ঘোষ, কল্যাণী ঘোষ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, বুলবুল মহলানবীশ ও মনোরঞ্জন ঘোষাল। একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হয়েছিলেন শ্রোতানন্দিত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী মির্জা আজম, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তার, সংসদ সদস্য কবি কাজী রোজী, ম হামিদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরউল্লাহ চৌধুরী, অভিনয়শিল্পী কেরামত মওলা, কুদ্দুছ বয়াতি, সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসসহ অনেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে শ্রদ্ধা জানায় জাসদ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ছাত্রমৈত্রী, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় গণগ্রন্থাগার, প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। ওবায়দুল কাদের বলেন, আব্দুল জব্বার ছিলেন সুরের জাদুকর। বাংলা গানের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হিসেবে তাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এ কণ্ঠসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা আমাদের আত্মার আত্মীয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যে গানগুলো গেয়েছেন, তা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে এবং কালজয়ী হয়ে আছে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে আমরা ‘মিউজিয়াম অব মিউজিক’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। সেটির মাধ্যমে আমরা আবদুল জব্বারের সঙ্গীতকে সংরক্ষণ করব। সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, সঙ্গীতে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। আমাদের দেশে নায়কের বড্ড অভাব। আমি আশা করব, তরুণ প্রজন্ম আবদুল জব্বারকে নায়কের আসনে রেখে এগিয়ে যাবে। আশরাফুল আলম বলেন, ছয় দফা ঘোষণার পর যে সকল গণআন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রতিটিতেই আবদুল জব্বার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। তিনি দেশকে প্রচ- ভালবাসতেন। গাজী মাজহারুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের এক একনিষ্ঠ সৈনিক ছিলেন আবদুল জব্বার। একাত্তরে আমার লেখা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আবদুল জব্বার। এ গানটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে এই গান। তার গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। এ কারণেই দেশের মানুষ তার গানকে মন থেকে ভালবেসেছে। নমিতা ঘোষ বলেন, আবদুল জব্বার কত বড় দেশপ্রেমিক ছিলেন তার প্রমাণ পেয়েছিলাম স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করতে গিয়ে। একাত্তরের ক্রান্তিকালে তিনি ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার দ্বিতীয় জানাজা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের জন্য নির্ধারিত স্থানে সমাহিত করা হয় একাত্তরের এই কণ্ঠযোদ্ধাকে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন আবদুল জব্বার। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে তিনি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিলেন। শরীরী না থাকলেও তার মতো দেশপ্রেমিকের মৃত্যু কখনও হবে না। তিনি জীবিত থাকবেন ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে। তিনি থাকবেন জাতীয় পতাকায় ও ভবিষ্যত প্রজন্মের চেতনায়। একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পদকসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত শিল্পী আবদুল জব্বার কিডনি জটিলতার পাশাপাশি হৃদযন্ত্র ও প্রোস্টেট রোগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
×