ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের যৌথসভা

আবার যাতে ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে না পারে সজাগ থাকুন ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ১১ আগস্ট ২০১৭

আবার যাতে ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে না পারে সজাগ থাকুন ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণের একাংশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়েছে দাবি করে তা আইনগতভাবে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকম-লীর সদস্যদের যৌথসভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কারোর একক নেতৃত্বে আসেনিÑ এমন বক্তব্যের মধ্যে মূলত বাংলাদেশকে অস্বীকার করা হয়েছে। সার্বভৌম সংসদ নিয়েও রায়ের পর্যবেক্ষণে যা কথা বলা হয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রচ- দাবির মুখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়েছে, এটা দুঃখজনক। আইনগতভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করা হবে। এদিকে বৈঠকের সূচনা বক্তৃতায় দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে আবার যাতে ষড়যন্ত্র ‘দানা বাঁধতে’ না পারে সে বিষয়ে দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ চায়নি, তাদের প্রেতাত্মা এখনও এদেশে রয়ে গেছে। তারা সুযোগ পেলে ছোবল মারে। এ ব্যাপারে বাঙালী জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। কারা তাদের কল্যাণে কাজ করে এ বিষয়টি জনগণকে বোঝাতে হবে।’ তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে যে অবিশ্বাস করে, সে দেশকে বিশ্বাস করে কিনা সন্দেহ আছে। শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্টের কালো দিবস যদি না আসত তবে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ হতো। দুর্ভাগ্য বাঙালীর যারাই এ জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করে, যারাই এদেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ করে, যখনই মানুষ সুফল পেতে শুরু করে তখনই ষড়যন্ত্র আরও দানা বেঁধে উঠে। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। এই সংশোধনী নিয়ে কী করণীয় সে সব বিষয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত চান দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, ড. আবদুর রাজ্জাক, আবদুল মতিন খসরু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, আইন সম্পাদক শ. ম রেজাউল, সিনিয়র নেতা শেখ আবদুল¬াহ বক্তৃতা করেন। বৈঠকে সিনিয়র নেতারা বলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে যে রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলা হয়েছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধানের ’৭০-এর অনুচ্ছেদ নিয়ে বলা হয়, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক সব দেশে বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট করার ক্ষমতায় সংসদের হাতে রয়েছে। একমাত্র সামরিক সরকার শাসিত দেশগুলোতে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘কোন একক ব্যক্তির কারণে হয়নি’ বলায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করে বলেন, জাতির পিতার অবদান অস্বীকার করে তিনি কী বুঝাইতে চাইছেন? কারও একক চেষ্টায় কোন কিছুই হয় না। কিন্তু সব কিছুর পেছনে কারও উদ্যোগ থাকে, প্রেরণা থাকে, সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকে এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার শক্তি থাকে। সেই শক্তি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ষোড়শ সংধোনীর কয়েকটি পর্যবক্ষেণ আপত্তিকর। রায়ের সঙ্গে এসবের কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। তবে সুপ্রীমকোর্ট আমাদের প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু বিএনপি ভিন্ন উদ্দেশে আমাদেরকে সুপ্রীমকোর্টের প্রতিপক্ষ বানাতে চাচ্ছে। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আছে- একটা বিচার বিভাগ, একটা নির্বাহী বিভাগ এবং অন্যটি আইনসভা। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের সম্পর্কই সহায়কমূলক, পরিপূরক। আইনসভার কাজ আইন প্রণয়ন করা। এ আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের নেই। বিচার বিভাগের দায়িত্ব ন্যায় বিচার করা। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে কতগুলো পর্যবেক্ষণ আছে, যেগুলো আমাদের কাছে আপত্তিজনক। এতে বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী নেতাদের মতামত গ্রহণ করেছেন। তিনি নেতাকর্মীদের জনগণের কাছে গিয়ে ষোড়শ সংশোধনীর যেসব ‘আপত্তিকর’ কথাবার্তা উঠে এসেছে সেগুলো পরিষ্কার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছেও সেগুলো তুলে ধরতে বলা হয়েছে। এদিকে সূচনা বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জাতির পিতা এদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেন। সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলতে পারে, পচাত্তরের ১৫ আগস্টেও পর ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম-নিশানা একেবারেই মুছে ফেলতে অনেক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো, আমাদের দেশের কয়েকটা প্রজন্মকে এই বিভ্রান্তির বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সত্য যেটা, তা প্রকাশ হবেই, সত্য উদ্ভাসিত হবেই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বলেন, ‘পঁচিশ বছর ধরে ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলছেন, একক নেতৃত্বে স্বাধীনতা আসেনি। একক চেষ্টায় কোন কিছু হয় না। কিন্তু সব কিছুর পেছনে লক্ষ্য থাকে, আদর্শ থাকে, স্বপ্ন থাকে, প্রেরণা থাকে, নেতৃত্ব থাকে, শক্তি থাকে; সেই শক্তি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসেছে। তবে কাউকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। কিছু কিছু লোক থাকে, তারা সুযোগ পেলে বিকৃত ইতিহাস সামনে তুলে নিয়ে আসে। কিন্তু বিকৃত ইতিহাস এখন আর কেউ বিশ্বাস করাতে পারে না। ইতিহাস চাপা দিয়ে রাখতে পারে না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা ও পরবর্তীতে দলটির নেতাদের আচরণের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিল তাকে তো বাঙালীরা ব্যারিকেড দিয়ে আটকও করেছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালীর অধিকার আদায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগ ও অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা যদি জীবনে এত ত্যাগ স্বীকার না করতেন তাহলে জাতির ৮০ ভাগের মানুষ দারিদ্র্র্যসীমার নিচে বাস করত, এই দেশের মানুষের জীর্ণ-শীর্ণ শরীর, বিদেশে থেকে কাপড় এনে পরতে হতো। এই রকম একটা পরিবেশ, এই রকম একটা জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন জাতির পিতা। তিনি বলেন, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান গ্রেফতার করেন জাতির পিতাকে। শুধু তাই না ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া যে ভাষণ দিয়েছিল সেখানে বঙ্গবন্ধুর কথাই বলেছিল, তাকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল এবং তার বিচার সে করবে এই ঘোষণাও সে দিয়েছিল। ইয়াহিয়া তার ঘোষণায় আর কারও নাম বলেনি। স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়াটাই ছিল জাতির পিতার বড় অন্যায়। সেই অপরাধে ইয়াহিয়া অপরাধী করেছে জাতির পিতাকে। জিয়াউর রহমানও একজন মেজর ছিল। তাকে কি গ্রেফতার করেছে, তার কি চাকরি গিয়েছিল? কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তার বিচার করে ফাঁসির রায়ে সইও করেছিল ইয়াহিয়া। তিনি বলেন, জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে ব্যারিকেড দিচ্ছিল, ঐ চট্টগ্রামে যারা ব্যারিকেড দিয়েছিল তাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, পাকিস্তানী শাসকদের পক্ষ হয়ে আন্দোলনরত এবং সংগ্রামরত মানুষকে হত্যা করেছিল জিয়াউর রহমান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বার বার প্রচার হচ্ছিল। আমাদের চট্টগ্রামের এক নেতা তিনি বললেন সেনাবাহিনীর কাউকে নিয়ে আসো। যেহেতু এটা যুদ্ধ, সেনাবাহিনীর কাউকে দিয়ে বলালে যেন যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হচ্ছিল। মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন হান্নান সাহেবসহ একে একে আমাদের অনেকে পাঠ করা শুরু করেন। ২৭ তারিখে জিয়াউর রহমান যখন সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানী শাসকদের জন্য অস্ত্র নামাতে যান তখন আমাদের যারা ভলান্টিয়ার তারা তাকে ব্যারিকেড দেয়, তারা তাকে আটকায়। পরবর্তীতে যেহেতু একজন সেনা অফিসার দরকার তাকে নিয়ে আসা হয় এবং তাকে দিয়ে ঘোষণা পাঠ করা হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা এসেছে, এটা শুধু দেশে না, আন্তর্জাতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। এখন আর মানুষের কাছে বিকৃত ইতিহাস বিক্রি করা যায় না। তারপরও সুযোগ পেলে কেউ কেউ এই বিকৃত ইতিহাসকে সামনে আনার চেষ্টা করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে উন্নয়ন হয়। জনগণের কল্যাণ হয়। আজকে উন্নয়নের যে গতি ধারা তা যেন থেমে না যায়। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলে উন্নয়নের ছোয়া, সুফল মানুষ পায়। আজকে তা মানুষ দেখেছে। বর্তমানের সরকারের ধারাবাহিকতার সুফল তুলে ধরে তিনি বলেন, উন্নয়নের গতিধারা ধরে রাখতে হলে সরকারে ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, জনগণের যে আস্থা ও বিশ্বাস আমরা অর্জন করেছি তা ধরে রাখতে হবে। দিন বদলের সনদ দিয়েছি, ঠিকই আমরা তা বাস্তবায়ন করেছি। বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে এখন উন্নয়ন রোল মডেল। বিশ্বের মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করে আমাদের উন্নয়ন দেখে।
×