ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন

বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা বদলেছে ॥ আইএস নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২ জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা বদলেছে ॥ আইএস নেই

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নিস্তব্ধ হলি আর্টিজান। শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই পুলিশের আনাগোনা। আশপাশে অসংখ্য চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছিল পুলিশ। যত্রতত্র কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছিল না। এ যেন এক অন্যরকম নিরবতা। হলি আর্টিজানে প্রবেশের প্রতিটি রাস্তায় বেরিকেড। রাত পেরিয়ে ভোর হতেই সেই নিরবতা আস্তে আস্তে ভাঙতে থাকে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যস্ততা বাড়তে থাকে পুলিশের। হলি আর্টিজানের সামনের অন্তত পাঁচ শ’ গজ সামনে বেরিকেড বসানো হয়। এদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। সকাল সাতটার দিকে শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন। নিঃশব্দে শ্রদ্ধা নিবেদন করে চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে যেতে দেখা যায় জাপান, ইতালি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ অসংখ্য দেশী-বিদেশী আর স্বজন হারানো ব্যক্তিদের। বুকে পাথরসম শোক থাকার পরেও হলি আর্টিজানের পর জঙ্গীরা আর কোন বড় ধরনের হামলা করতে না পারায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রেস্তরাঁটিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা দেশী-বিদেশীরা। তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার শতভাগ সফল। তবে ভেতরে ভেতরে জঙ্গীবাদের তৎপরতা রয়েছে কিনা সে সম্পর্কে সন্দিহান তারা। সরকারের উচিত জঙ্গী দমনে এমন সফলতা নিজেদের স্বার্থেই ধরে রাখা। অন্যথায় দেশটির জন্য বড় ধরনের বিপদ আসতে বাধ্য। কোন পরাক্রমশালী দেশ বা গোষ্ঠী বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের অস্তিত্ব থাকার দোহাই দিয়ে কারণে অকারণে হস্তক্ষেপ করবে। হলি আর্টিজানে হামলার পর বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেক বিদেশীই মনে করতেন। অবশ্য আস্তে আস্তে তাদের সেই ধারণা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। তারাও এমন ভ্রান্তধারণা থেকে সরে এসেছেন। সরকারের উচিত সর্বদা সতর্ক থাকা। তবে সুযোগ পেলেই জঙ্গীবাদের ভূত যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, তা বলতে দ্বিধা করেননি অনেক বিদেশীই। তারা বলছেন, আপাতত জঙ্গী হামলার আশঙ্কা না থাকলেও, কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আচমকা আবার এমন যদি হয়? শুক্রবার রাত থেকেই গুলশানের হলি আর্টিজানসহ আশপাশের এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকেই হলি আর্টিজান খুলে দেয়া হয় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। আশপাশের প্রতিটি সড়কে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী। পুরো এলাকায় সুনসান নিরবতা। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের আনাগোনা। অনেকে অনেক সকালেই সেখানে হাজির হন। তবে নিরাপত্তার কারণে সহজেই তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। মূল ফটক থেকে অন্তত পাঁচ শ’ গজ সামনে চৌরাস্তা মোড়ে বসে পুলিশের চেকপোস্ট। সেখানে কাঁটাতারের বেরিকেড দিয়ে তল্লাশি চলতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হলি আর্টিজানে প্রবেশ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ভিড় বাড়তে থাকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে। ঢুকেই দেখা গেল সেখানে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। রেস্তরাঁটি দাঁড়িয়ে আছে বুকে অসংখ্য বুলেটের ক্ষত নিয়ে। শত শত বুলেটের চিহ্ন রয়েছে বাড়িটির দেয়ালে। অনেক বুলেট বিদ্ধ হয়ে ভেতরেই রয়ে গেছে। সামনের সবুজ মাঠ আবার সুন্দর হয়েছে। বাড়িটিতে প্রবেশের রাস্তায় বসেছে স্টিলের বেড়া। যে কারণে আর আগের মতো বাড়িটি দেখা যায় না। সুনসান নিরবতা। বাড়িতে কেউ থাকে না। পাশের লেক ভিউ ক্লিনিকেও কেউ ভয়ে সেই পথ মাড়ান না। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। সেখানে মেরামতের কাজ চলছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা লেকের দিকে যাওয়ার রাস্তার গেটটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারি আর পাশেই লেকভিউ ক্লিনিক। দুইটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাঝ বরাবর প্রায় ১২ ফুট সবুজ স্টিলের টিন দিয়ে বেড়াটি যেন দুইটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোজন যোজন মাইল দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছে। দুইটি প্রতিষ্ঠানের পূর্ব দিকে খোলা। তবে স্টিলের বেড়ার কারণে প্রবেশ করা যায় না। আর ঢুকেই বামদিকে দশ থেকে বারো ফুট ঢোকার রাস্তা। ঢুকতেই চোখে পড়ে দোতলা হলি আর্টিজান রেস্তরাঁটি। নির্মাণাধীন বাড়ির সামনেই রাখা হয়েছে দশ-বারো ফুট লম্বা একটি টেবিল। তাতে শান্তির প্রতীক হিসেবে সাদা কাপড় বিছানো। সেই টেবিলেই সবাই ফুলেল শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন অনেকেই। আর প্রিয়জনদের কথা স্মরণ করে নীরবে চোখের জল সামলাচ্ছেন। কারও মুখে যেন কথা নেই। সবাই সেদিনের কথা স্মরণ করে হয়তো ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদছিলেন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই নিরবতা ভাঙ্গেন বাংলাদেশস্থ জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবি। তিনি নিহতদের স্মরণে নিরবতা পালন করেন। এ সময় তাদের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। প্রায় আধঘণ্টা সেখানে অবস্থান শেষে তিনি ক্লান্ত শরীরে অবশ মন নিয়ে চলে যান। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও ডিএমপির গুলশান বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন। এরপর শ্রদ্ধা জানান ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা। তার সঙ্গে ইতালির আরও কয়েক উর্ধতন কর্মকর্তা ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় নিহতদের স্মরণ করে তারা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। উপস্থিত চার ইতালীয়দের মধ্যে একজনের স্ত্রী ছিল। এরপর একই টেবিলে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া স্বজন হারানো মানুষ আর বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নিহতদের স্মরণে। সকাল দশটার দিকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, জঙ্গীরা দুর্বল হয়েছে। তবে নির্মূল হয়নি। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করলে চলবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গীবাদ দমনে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সকাল দশটার দিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, শক্তি দিয়ে জঙ্গীবাদ হয়ত সাময়িকভাবে দমন করা যায়, কিন্তু নির্মূল করা সম্ভব নয়। জঙ্গীবাদ দমন করতে হবে আদর্শ দিয়ে। এ জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন করতে হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী নূপুর, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী, শহীদ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, মেয়ে নুজহাত চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সারসহ অনেকেই। পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বলেন, হলি আর্টিজানের ওই দিনের ঘটনাটা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। এ ধরনের ঘটনার যে ব্যাপকতা দেখা দিয়েছিল সেটা মোকাবেলা করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তাৎক্ষণিকভাবে তা মোকাবেলা করতে গিয়ে দুজন সিনিয়র অফিসারের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ যাতে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি না পায়, এজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ সময় তার সঙ্গে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম, পুলিশের গোপনীয় শাখার এআইজি মনিরুজ্জামানসহ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির সিনিয়ির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, বাংলার যে সাম্প্রতিক বন্ধন, তাতে কালিমার তিলক দিয়েছে এ হামলা। এরপর বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে এবং কেউ কেউ দলগতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দুপুর দুটো নাগাদ শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব চলে। তারা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে যে যার যার মতো বেরিয়ে যান। পরে তাদের অনেকের সঙ্গেই এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা তাদের নাম পরিচয় উল্লেখ না করার শর্তে জানান, হলি আর্টিজানে হামলার পর আইএসের নামে হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এমন বিবৃতি প্রকাশের কারণে তাদের মনে রীতিমতো ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। তারা ধরেই নিয়েছিলেন, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে। এরপর তাদের পরিচিতদের অনেকেই নিজ দেশে ফেরত গেছেন। ফেরত যাওয়া বিদেশীদের মধ্যে ইতালি ও জাপানীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এর মূল কারণ হত্যাকা-ে সবচেয়ে বেশি নয়জন ইতালীয় নিহত হন। এরপর নিহত হন ৭ জাপানী। জাপানী ও ইতালীয়দের হত্যার পর এদেশে বসবাসকারী এই দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে তারা আইএসের টার্গেট বলে মনে করতে থাকেন। বিশেষ এর আগে গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার এবং রংপুরে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। বহুদিন, এমনকি এখনও অনেকেই নিজেদের জাপানী ও ইতালির নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও পরিচয় দেন না। জাপানীদের অধিকাংশই চেহারাগত মিল থাকার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের নাগরিক বলে পরিচয় দেন। যদিও দাফতরিক কাজের বেলায় সেটি হয় না। শুধুমাত্র সামাজিক চলাফেরার ক্ষেত্রে তারা বাড়তি সাবধানতা হিসেবে এমন কৌশল নিয়েছেন। তবে হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গীরা আর কোন হামলা চালাতে পারেনি। এরপর আস্তে আস্তে বিদেশীদের মধ্যে থেকে বাংলাদেশে আইএসের যে কোন অস্তি¡ত্ব নেই তার বিশ্বাস জন্মাতে থাকে। তাদের ধারণা, সত্যিই আইএস থাকলে আরও হামলা হতো। কিন্তু এক বছরেও আর কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি। যা তাদের ভীতিকে কাঁটিয়ে দিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ প্রশংসার দাবিদার। তবে বাংলাদেশকে এ ধারা ধরে রাখতে হবে। অন্যথায় কোন পরাক্রমশালী দেশ, যারা সাধারণত জঙ্গীবাদের অজুহাতে বিভিন্ন দেশে নিজেদের শক্তিমত্তা খাঁটিয়ে স্বার্থ হাছিল করে, তারা সুযোগ নিতে পারে। বিদেশীরা জানান, তারা বিদেশী হিসেবে বাংলাদেশে যারা বসবাস করছেন তাদের অনেককেই চেনেন। পরিচিতরা এখন আর ভীত নন। তাদের মধ্যে থেকে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর যে ভীতি ছিল, সেই ভীতি বা আতঙ্ক কোনটিই নেই। তবে পুলিশের গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা উপকমিশনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলছেন, তারা সর্বদা সতর্ক রয়েছেন। সর্বক্ষণিক টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। বাংলাদেশস্থ প্রতিটি বিদেশী অফিস, দূতাবাস ও চ্যান্সারি অফিসের সঙ্গে নিয়মিত তাদের যোগাযোগ রয়েছে। যেকোন প্রয়োজনে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ তাদের স্মরণ করা মাত্র তারা তাদের টিম নিয়ে হাজির হন। তাদের যেকোন ধরনের অভিযোগ, অসুবিধাসহ নানা বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। নিরাপত্তার কারণে তারা সন্তুষ্ট বলেও তিনি দাবি করেন। এমনটাই দাবি করেছেন ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার এসএম মোস্তাক আহমেদ খান। তিনি বলছেন, তারা সর্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে করণীয় সবই করছেন।
×