ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভারি বর্ষণে রাঙ্গামাটিতে দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রম ব্যাহত, আরও এক মৃতদেহ উদ্ধার;###;ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন অনিশ্চিত

খাগড়াছড়িতে ৩, মৌলভীবাজারে মা-মেয়ের মৃত্যু ॥ পাহাড়ে আবার ধস

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ জুন ২০১৭

খাগড়াছড়িতে ৩, মৌলভীবাজারে মা-মেয়ের মৃত্যু ॥ পাহাড়ে আবার ধস

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী/জীতেন বড়ুয়া ॥ আবারও ভারি বর্ষণ, আবারও পাহাড় ধস, আরও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে খাগড়াছড়িতে। সেখানে মারা গেছে তিনজন। মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া রাঙ্গামাটির বেদভেদিতে পাহাড় চাপায় আরও একটি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছে ১ জন। এছাড়া রবিবার বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে ১ জন। গত মঙ্গলবার পাহাড়ের সর্বত্র ভারি বর্ষণে একযোগে পাহাড় ধসের ঘটনার পর থেকে ছোট ও মাঝারি আকারে বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। তবে খাগড়াছড়িতে ভারি বর্ষণে রামগড়ের বুধং পাহাড়ের বড় অংশ ধসে পড়েছে। রাঙ্গামাটির সঙ্গে কাপ্তাই হয়ে নৌপথে জনচলাচল ও পণ্য পরিবহনের আরও উন্নতি হয়েছে। তবে নতুন করে বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, জুরাইঝড়ি, লংগদু, নানিয়ারচর, বিলাইছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ধানসহ মৌসুমি ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। রাঙ্গামাটির সতেরটি আশ্রয় কেন্দ্রে সেনা, বিজিবি ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার পরিবেশন অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সংস্কার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ক্রমাগত বর্ষণের কারণে। রাঙ্গামাটির সতেরটি আশ্রয় কেন্দ্রে ২ সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু অবস্থান করছে। অনুরূপভাবে খাগড়াছড়িতেও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে উপজাতীয় ও বাঙালীরা আশ্রয় নিয়েছে। তবে বান্দরবানের পরিস্থিতির বহু উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বান্দরবান-রুমা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এলাকার ওয়াই জংশন পয়েন্ট থেকে রুমা যাওয়ার পথে বিধ্বস্ত সড়ক পুনঃসংস্কার কাজে সেনাবাহিনী কাজ করছে। অনুরূপভাবে রাঙ্গামাটির মানিকছড়ি, সাপছড়ি এলাকায় সেনা সদস্যরা দ্রুতগতিতে বিধ্বস্ত সড়ক হালকা যান চলাচল উপযোগী করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত মঙ্গলবারের পাহাড় ধসে সৃষ্ট মহাদুর্যোগের ঘটনার পর রাঙ্গামাটির স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু নিখোঁজদের কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই। স্বজন হারানো অনেকের আহাজারি চলছে। যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের আর বেঁচে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। এখন বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে পাহাড়ী জনপদের বাঙালী ও উপজাতীয়রা। সিভিল ও সেনা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্য ও পণ্য সরবরাহসহ সব ধরনের সহযোগিতা ক্রমাগতভাবে বাড়ানো হচ্ছে। কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটিতে নৌবাহিনীর ত্রাণ ও চিকিৎসা তৎপরতা চলছে। অনুরূপভাবে সেনাবাহিনীও চালাচ্ছে এ তৎপরতা। তবে পাহাড়ে এ মহাদুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন নিয়ে এখনও কোন তৎপরতা শুরু হয়নি। ঘরবাড়ি ও স্বজন হারাদের কিভাবে পুনর্বাসিত করা হবে তা অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। ফলে সর্বস্ব হারানো ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নতুন করে কোথায় এবং কিভাবে বসতি গড়ে তুলবে তা নিয়ে তাদের মাঝে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধস খাগড়াছড়ির রামগড় ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় পাহাড় ধসে ৩ জন নিহত ও দুইজন আহত হয়েছে। রবিবার ভোর রাতে প্রবল বর্ষণের সময় পাহাড় ধসে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। পাহাড় ধসে রামগড় উপজেলায় বিশটির বেশি ঘরবাড়ি, দোকানপাট বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া লক্ষ্মীছড়ি ও গুইমারা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অপরদিকে, নতুন করে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় জেলা প্রশাসন আরও ৩ উপজেলায় ৪ আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছে। রবিবার সকাল ৬টার দিকে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার পাতাছড়া বুদংছড়া এলাকায় বসতবাড়ির ওপর বুদং পাহাড়ের বড় অংশ ধসে পড়ে মোঃ নুরনবী (১৪) ও মোঃ হোসেন (১০) নামে দুই সহোদর নিহত ও বিল্লাল হোসেন নামে একজন আহত হয়েছে। নিহত ও আহতরা বুদংপাড়ার মোঃ মোস্তফার ছেলে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। ভোর রাত থেকে প্রবল বর্ষণ শুরু হওয়ার পর বুদংছড়া এলাকার বাড়িঘরের পূর্ব পাশের পাহাড় থেকে ধস নামে। ফলে মাটিচাপা পড়ে একই ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় দুই সহোদরের প্রাণহানি ঘটে বলে জানিয়েছেন তাদের চাচা মোঃ শাহীন। পাহাড় ধসের ঘটনার পরপর স্থানীয়রা মিলে দুই ঘণ্টা চেষ্টা করে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে। পরে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট এসে মাটিচাপায় নিখোঁজ গবাদিপশুর সন্ধান চালায়। নিহতদের পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ২০ হাজার টাকা সাহায্য করা হয়েছে। অপরদিকে, রবিবার সকাল ৮টায় লক্ষ্মীছড়ির যতীন্দ্র কার্বারীপাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে নিপুণ চাকমা (৫) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। সে একই এলাকার দেবব্রত চাকমার মেয়ে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে এবং বর্ষণ অব্যাহত থাকলে আরও ভূমিধসের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোঃ রাশেদুল ইসলাম জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে আনতে জেলা সদর, মহালছড়ি, মানিকছড়ি ও রামগড়ে ৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতবাড়ি থেকে লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৮০টির মতো পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। তাদের খাবার, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ বছর পাহাড় ধস ও প্রবল বর্ষণ অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে উল্লেখ করে ডিসি ভূতাত্ত্বিকদের সমন্বয়ে পাহাড়ের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য জরিপ করে নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বড়লেখায় মা-মেয়ের মৃত্যু সৈয়দ হুমায়েদ আলী শাহীন মৌলভীবাজার থেকে জানান, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মধ্য ডিমাই গ্রামে পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে আফিয়া বেগম ও তার মেয়ে ফাহমিদা বেগমের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে টানা বর্ষণ চলাকালে পাহাড় ধসে ঘরের ওপর পড়লে তারা মাটিচাপা পড়েন। সকাল সাড়ে ৬টায় এলাকাবাসী খবর পেয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করেন। নিহতরা বড়লেখা সদর ইউনিয়নের মধ্যডিমাই গ্রামের মৃত আবদুস সাত্তারের স্ত্রী ও মেয়ে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার রাতের টানা বর্ষণ আর আকস্মিক পাহাড়ী ঢলে মধ্যডিমাই (বতাউরা) গ্রামের মৃত আবদুস সাত্তারের বসতঘরে পাহাড় ধসে পড়ে। এতে তার স্ত্রী আফিয়া বেগম ও স্কুলপড়ুয়া মেয়ে ফাহমিদা বেগম (১৩) মাটিচাপা পড়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন। রোববার সকাল সাড়ে ৬টায় এলাকাবাসী মাটিচাপা অবস্থায় মা-মেয়ের লাশ উদ্ধার করেন। বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ শহিদুর রহমান মা ও মেয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ওই এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। আরও কয়েকটি ঘরও বিধ্বস্ত হয়েছে। স্থানীয়রা আরও জানান, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে এলাকার অসংখ্য বাড়িঘর ঝুঁকিতে রয়েছে। যে কোন সময় ঘটতে পারে আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা। রাঙ্গামাটির পরিস্থিতি পাহাড় ধসে মহাদুর্যোগের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ৬ দিনের মাথায় রাঙ্গামাটিতে ফের মুষলধারে বর্ষণ শুরু হওয়ায় সড়ক সংস্কার ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা কার্যক্রম থমকে যাচ্ছে। রবিবার বেদভেদিতে আরও ১টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। তার নাম নবী হোসেন (৪৫)। এছাড়া এ ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসারত শিশু মোঃ জিসান (৬) মারা গেছে। ফলে রাঙ্গামাটিতে এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা এককভাবে ১১৫ জনে উন্নীত হয়েছে। বেদভেদি নবী হোসেনের পরিবারের সকলই এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। রবিবার সকাল থেকে আবারও ভারি বর্ষণ শুরু হওয়ায় রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাপছড়ি এলাকার সড়ক সংস্কার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ গত ছয়দিনের মতো বন্ধ রয়েছে। শহর এলাকায় বিদ্যুত ও জ্বালানির আর কোন সঙ্কট নেই। কিন্তু পণ্য সঙ্কট এখনও প্রকট হয়ে আছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসন উদ্ধার কাজ স্থগিত করা পর এই পর্যন্ত আরও ৪ লাশ উদ্ধার হলো। লাশের সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া রবিবার কাউখালীর বজ্রপাত নিমাপ্রু মারমা (২৮) নামের এক মহিলা প্রাণ হারিয়েছেন। বিকেলে বর্ষণের সঙ্গে বজ্রপাতের ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান। অপরদিকে, ভারি বর্ষণে পাহাড় থেকে ঢল নামা অব্যাহত থাকায় জেলার বাঘাইছড়ি, জুরাইছড়ি, লংগদু, নানিয়ারচরের সমতল এলাকা তলিয়ে গেছে। এতে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি গেট দিয়ে পানি ছাড়া অব্যাহত থাকলেও ভারি বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢল রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলার সমতল এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নতুন নতুনভাবে প্লাবিত হওয়ার এ ঘটনায় ভূমিধস থেকে রক্ষা পাওয়া অন্যান্য বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষগুলো এখন ক্ষতির শিকার। সবমিলে রাঙ্গামাটি জেলায় ক্ষতি এতই বেশি যে যা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রবিবার পর্যন্ত নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে পৌরসভা এ কাজ শুরু করেছে। কবে নাগাদ সঠিক তথ্য মিলবে তা অনিশ্চিত। রাঙ্গামাটিতে সেনাবাহিনী ও স্বাস্থ্য বিভাগ শহরে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রিতদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে পুনর্বাসন করার জন্য সেনাবাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন পৌরসভা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। এদের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজে লিপ্ত হয়েছে। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের ৬১ কিলোমিটার এলাকায় ১৫০ ফুট সড়ক একেবারে ধসে গভীর খাদে পরিণত হওয়ায় এ সড়ক মেরামতের কাজ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ও সড়ক বিভাগ যৌথভাবে তৎপরতা চালাতে গিয়ে মাঝে মাঝে কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ভারি বর্ষণের কারণে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে রাঙ্গামাটির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হবে বলে তিনি জানান। রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি সড়কের মহালছড়ি এলাকায় ৭০ ও ৯০ ফুট করে সড়ক ধসে ছড়ার সৃষ্টি হওয়া সড়কে এখনও কোন কাজ শুরুই হয়নি। সেখানে বেইলি ব্রিজ স্থাপন করতে হবে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সড়কের ধসে পড়া ১২ কিলোমিটার এলাকায়ও কোন কাজ শুরু হয়নি। ফলে রাঙ্গামাটির সঙ্গে একমাত্র নৌপথ ছাড়া অন্যান্য সকল সড়ক যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
×