ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শতাধিক মৃতের আশঙ্কা ॥ নিহত সবাই শনাক্ত নাও হতে পারে

লন্ডন অগ্নিকাণ্ডে ক্ষোভ বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৭ জুন ২০১৭

লন্ডন অগ্নিকাণ্ডে ক্ষোভ বাড়ছে

ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে। এ পর্যন্ত সতেরো জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছয়জনের পরিচয় আগেই শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু লাশের মিছিল বেড়ে শতাধিক ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, অগ্নিকা-ের ভয়াবহতা এত ব্যাপক ছিল যে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ কোনদিনই নিরুপণ করা সম্ভব হবে না। এদিকে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসলে তিনি হতাহতদের প্রতি মানবিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠে। জরুরী উদ্ধার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা তৃতীয় দিনের মতো অগ্নিকা-ের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নিখোঁজদের সন্ধান করছেন। অগ্নিকা-ের পর থেকে কয়েক ডজন লোক এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। পুলিশের আশঙ্কা, ধ্বংসযজ্ঞ এত ব্যাপক ছিল যে বহু লাশের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। খবর টেলিগ্রাফ অনলাইনের। চব্বিশ তলা ভবনটিতে আগুন লাগার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে উদ্ধারকর্মীরা ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু উপরের তলাগুলোতে বহু বাসিন্দা আটকে পড়লেও উদ্বারকর্মীরা সেখানে পৌঁছাতে দেরি করেছেন। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে তাদেরও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষভাবে, গেল ত্রিশ বছরে বারবার সতর্ক করা হলেও কেন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়া হয়নি। দেশের বাইরে একইভাবে নির্মিত বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলেও গেল এক দশকেরও বেশি সময়ে ব্রিটেনের ভবন অগ্নিনিরাপত্তা নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়নি। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশটির ভবনের বাইরের অংশে যে পলস্তারা বসানো হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একই কারণে মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে পশ্চিম লন্ডনের কেনসিংটন ব্লোকটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে বৃহস্পতিবার অগ্নিকা-ের ঘটনায় সরকারীভাবে একটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। বহুতল ভবনটির সব বাসিন্দাকে স্থানীয়ভাবে পুনর্বাসনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, কি ঘটছে, তা আমাদের জানার দরকার আছে। যারা স্বজন, বন্ধু, প্রিয়জন ও বসতবাড়ি হারিয়েছেন, আমাদের অবশ্যই তাদের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। তাঁদের কাছে আমরা ঋণী। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনকালে বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা না করে চলে আসায় ও উদ্ধারকর্মীদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত না হওয়ায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি নিজেই আলাদা একটি সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলাম। লন্ডনের মেয়র সাদিক খানকেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। জরুরী উদ্ধার কাজের প্রশংসা করায় বক্তব্যের মাঝে তাকে বারবার থামিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তিনি সাত বছরের একটি শিশুর সঙ্গে হাত মেলাতে চাইলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে। শিশুটি সাদিক খানকে পাল্টা প্রশ্ন করে, অগ্নিকা-ে কতটি শিশু নিহত হয়েছে? আপনি সে ব্যাপারে কি করতে যাচ্ছেন? তবে লেবার নেতা জেরেমি করবিনের বেলায় পরিস্থিতি একটু ভিন্ন ছিল। তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। তিনি কেনসিংটনের ধনী ব্যক্তিদের খালি ঘরগুলো অগ্নিকা-ে বাস্তুচ্যুতদের জন্য খুলে দেয়ার আহ্বান জানান। নির্বাচনে একতরফা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী টেরেমা মে এখন দলের ভেতরে নিজের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার ও সরকার গঠন নিয়ে এক কঠিন সময় পার করছেন। বিবিসির উপস্থাপক নিক রবিনসন বলেন, অগ্নিকা-ের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীকে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে হারিকেন ক্যাটরিনার পর জর্জ বুশ জুনিয়রকে যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে, সে অবস্থার সঙ্গে তিনি তুলনা করেন টেরেসা মের বর্তমান সময়কে। পহেলা জুলাইয়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে টেরেসা মের পদত্যাগ দাবিতে ছায়া অর্থমন্ত্রী জন ম্যাকডোনেল কয়েক লাখ মানুষের একটি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছেন। গায়িকা লিলি এ্যালেন বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, আমি মনে করি এ ঘটনায় বড় ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাঁরা যেভাবে সাধারণ মানুষের উদ্বেগকে মোকাবিলা করছে, তা থেকেই এ পরিস্থিতির জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয় কাউন্সিলের বদলে কমিউনিটি নেতারা মানবিক সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। এটা এক ধরনের নৈরাজ্য। কমিউনিটি নেতাদের এমন কাজের কোন অভিজ্ঞতাই নেই। কিন্তু তাদের এসব কাজই সরকারকে সুবিধা করে দিচ্ছে। কারণ এক সময়ে এসব মানুষের আশা-ভরসা ক্ষোভে পরিণত হবে। তাঁরা এখন সত্যিকার সমস্যার মোকাবিলা করে যাচ্ছে। লিলি বলেন, আমি আশা করি, সরকারের এখানকার মানুষদের ছোট ছোট দুঃখগুলোও অনুভব করার চেষ্টা করবেন। স্কাই নিউজ এক প্রতিবেদনে জানায়, স্থানীয় অধিবাসীরা বিরোধীদলীয় নেতা করবিনের সমর্থনে বারবার সেøাগান দিতে থাকলে একটি সংবাদ সম্মেলন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু আসলে এসব ঘটনার এই ভিড়ের মধ্যেই রয়েছে রাজনৈতিক সুবিধা। সূত্র জানায়, টাওয়ার ব্লোকের সামনের দরজা দুটিতে কোন অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল না। এই দুর্ঘটনায় এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, দমকলকর্মীরা বাসিন্দাদের ভেতরে অবস্থান করতে বলেছেন। বাসিন্দারা যাতে ভবন থেকে বেরিয়ে না যায়, সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ, তাদের ধারণা দরজার অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বাসিন্দাদের সুরক্ষা দিবে। দমকলকর্মীদের নির্দেশ মানতে গিয়েও অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। একচল্লিশ বছর বয়সের সিদানি আটমানি বলেন, পনেরো তলায় তাঁর এক প্রতিবেশী, স্টিফেন নামে যাকে তিনি চিনতেন, দমকল কর্মীদের নির্দেশনা মেনে ভবনের ভেতরে থাকতে গিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, উদ্ধারকর্মী ও দমকল বাহিনীর নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়ে অনেকে মারা গেছেন। এটা সত্যিই ভয়াবহ। দরজাগুলো অগ্নিপ্রতিরোধী হলে আগুন এক কামরা থেকে আরেকটিতে ছড়িয়ে পড়ত না। কেনসিংটন ও চেলসি কাউন্সিলের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে গ্রিনফেল টাওয়ারের অগ্নিকা- ঘটার ঝুঁকির যাচাই করা হয়নি। অথচ গত মে মাসে ভবনটি সংস্কার করা হয়েছে। ঘষেমেজে তকতকে করা হয়েছে। ব্রিটেনের ভবন নীতিমালা অগ্নিনির্বারণের জন্য যথেষ্ট নয় বলে গত ত্রিশ বছর ধরে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষভাবে অগ্নিকা-ের পর ভবন থেকে নিরাপদে বের হয়ে আসার পথ যথেষ্ট না থাকা ও ভবনের বাইরের তাপ পরিবাহী আস্তরণ ব্যবহার করায় আগুনের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন তাঁরা। অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ক মন্ত্রী নিক হার্ড বলেন, ভয়াবহ এ অগ্নিকা-ের ঘটনায় বিচারিক তদন্ত করা হবে। সবকিছুই তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হবে। কোন অবহেলার সুযোগ নেই।
×