ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন জেলায় একযোগে পাহাড় ধসের নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৫ জুন ২০১৭

তিন জেলায় একযোগে পাহাড় ধসের নেপথ্যে-

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মধ্যে মঙ্গলবার রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে একযোগে অসংখ্য পাহাড় ধসের ঘটনার নেপথ্যে প্রাথমিকভাবে একাধিক ঘটনা চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত রবিবার থেকে লাগাতার ভারি বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে বড়-ছোট ও মাঝারি আকারের ধস সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্নস্থানে। সবচেয়ে পাহাড় ধসের বড় ঘটনা ঘটেছে রাঙ্গামাটির মানিকছড়িতে। ধসের এ ঘটনায় তিন জেলায় মৃতের সংখ্যা বুধবার পর্যন্ত ১৫১ জনে উন্নীত হয়েছে। আহত হয়েছে অগণিত। আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন অনেকে। নিহতদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ২ কর্মকর্তাসহ ৪ সদস্যও রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে ভারি বর্ষণের পর পাহাড় অঞ্চলজুড়ে ব্যাপকভাবে পাহাড় ধসের এ ঘটনা পুরো দেশ ও জাতিকে বিস্মিত করেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাঙ্গামাটি শহরসহ এর আওতাধীন দশ উপজেলা। বান্দরবানেও হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে মৃতের সংখ্যা কম। একযোগে একই দিনে পাহাড় ধসের এ ঘটনা বিশেষজ্ঞদের ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে ধারণা দেয়া হয়েছে, একদিকে বছরের পর বছরজুড়ে জুম চাষে পাহাড়ের গাছপালার সঙ্গে সবুজের সমারোহ ধ্বংস হচ্ছে। অপরদিকে, যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার্থে প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি এবং নতুন নতুন বাড়ি-ঘর নির্মাণে পাহাড়ী এলাকায় মাটি কাটা ইত্যাদির কারণে পাহাড়ের গোড়া নড়বড় হয়ে গত মঙ্গলবার ভারি বর্ষণে অসংখ্য পাহাড় ধসে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগেও পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার যা হয়েছে তা পাহাড়ের জন্য অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সূত্র জানায়, পাহাড়ের মাটির আকার বেলে যা নরম আকৃতির। টানা বর্ষণ হলেই কোন না কোন স্থানেই ছোট-খাটো ভূমি বা পাহাড় ধস হয়ে আসছে। এর মূল কারণ পাহাড়ের একটি পাহাড়ও অক্ষত নেই। কোন না কোনভাবে এর গোড়ায় আঘাত লাগছে। এবার একযোগে এত পাহাড়ে ধস নেমেছে যে, যা সকল মহলকে বিস্মিত করেছে। এ নিয়ে সকল মহলে নানা ধরনের আলাপ- আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড়ের সমাহার। পাহাড় ঘেঁষেই মানুষের বসতি। পাহাড় ঘেঁষেই সড়ক নির্মিত। বর্ষা মৌসুম ও ঝড়বৃষ্টির সময় ছোট-খাটো দুর্যোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। পাহাড়ী ঢলে মানুষের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়। প্রাণহানিও ঘটে। কিন্তু এবার কেন একযোগে একই সময়ে এমন ঘটনা ঘটল যে, এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়জুড়ে গাছপালা অর্থাৎ বনজ সম্পদের সমাহার। উঁচু-নিচু পাহাড়ের প্রাকৃতিক সেই বনজ সম্পদ একের পর এক উজাড় হচ্ছে জুম চাষসহ গাছ কাটার কারণে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গাছপালার শেকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। এখন যেহেতু গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে এবং জুম চাষের ফলে সবুজ থাকছে না, ফলে পাহাড়ের বেলে মাটি ভারি বর্ষণের কারণে স্থির থাকতে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরদিকে, তিন পাহাড়ী অঞ্চলে প্রতিবছর নতুন নতুন যে সড়ক নির্মিত হচ্ছে এবং জনবসতি বিস্তৃতি লাভ করছে এতেও পাহাড়ের গোড়ার মাটি কাটা হচ্ছে। ফলে পাহাড় প্রতিনিয়ত ভারসাম্য হারাচ্ছে। দীর্ঘদিনের নির্বিচারে এ জাতীয় ঘটনার ফলে মঙ্গলবার একযোগে তিন পাহাড়ী এলাকায় ভারি বর্ষণের ফলে বড় ধরনের ধসের ঘটনার জন্ম দিয়েছে বলে নিশ্চিত করা হচ্ছে। সূত্র সমূহে বলা হচ্ছে, পাহাড়ী এলাকার উন্নয়নে পাহাড় কাটার বিকল্পও নেই। তবে পরিকল্পিতভাবে তা বাস্তবায়ন করা হলে পাহাড়ের অবস্থান নড়বড়ে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এসব নতুন নতুন সড়ক প্রতিষ্ঠা, বাড়িঘর নির্মাণ, জুম চাষের জন্য পাহাড়ের গাছপালা জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদির কারণে পাহাড়ের নিজ অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। মূলত, এসব কারণেই মঙ্গলবারের এ ধস। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে সাধারণত পাথর নেই। নরম আকৃতির বেলে মাটি দিয়ে সৃষ্ট। এর ফলে এ পাহাড়ের গায়ে যখনই আঘাত হচ্ছে তখনই এর অবস্থান প্রতিনিয়ত নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। এসবের ফলে মঙ্গলবার তিন পাহাড়ের মধ্যে বিশেষ করে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে যে ধসের ঘটনা ঘটেছে তাতেই এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নেমে এসেছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ও এতটা বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি, যা ঘটিয়েছে টানা দুইদিনের ভারি বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়া। মঙ্গলবার সাগরে কোন নি¤œচাপ ছিল না, ছিল না ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত। সঙ্গত কারণে কারও ভাবনাতেই ছিল না এতটা প্রাণহানি ঘটাতে পারে লঘুচাপে সৃষ্ট একটি স্থল নি¤œচাপ। এর ব্যাপ্তি ছিল নগরীসহ পুরো চট্টগ্রাম জেলা, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং কক্সবাজার জেলা পর্যন্ত। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া উপড়ে নিয়েছে অনেক ঘরবাড়ি ও গাছপালা। সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি ঘটেছে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস, যা মনে করিয়ে দেয় ২০০৭ সালের ১১ জুনের মানবিক বিপর্যয়কে। সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল ১২৭ জন। ঠিক দশ বছরের ব্যবধান। মাসটিও এই জুন মাস। তারিখটি শুধু ১১-এর পরিবর্তে ১৩। জুন মাসে সাগরে লঘুচাপ মানেই প্রবল বর্ষণের সম্ভাবনা। কারণ বর্ষা মৌসুম সমাগত। শুধু বায়ু চাপের তারতম্যের আধিক্য এবং সঞ্চালনশীল মেঘমালা ঘটিয়ে দিয়েছে যেন এক মহাবিপর্যয়। উপকূলে, সমতলে এবং পাহাড়ে ঘটে যায় তা-বলীলা। সব মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন সেনাবাহিনীর ৪ সদস্যসহ শতের কাছাকাছি মানুষ। সম্পদহানি বিপুল। আচমকা এমন বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না সাধারণ মানুষ ও প্রশাসন। চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনা নতুন নয়। প্রাণহানিও ঘটেছে মাঝেমধ্যে। তবে টনক নড়ে ২০০৭ সালে মানবিক বিপর্যয়ের পর। এরপর থেকে চলতে থাকে প্রতিবছর বর্ষার প্রারম্ভে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ ঘরগুলো থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়ার তৎপরতা। ২০০৭-এর পরও পাহাড় ধস হয়েছে, তবে এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুলনামূলক কম। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ভূমিকা রেখেছে। তবে এবার নগরীতেও পুনরাবৃত্তি হতে পারত, যার প্রমাণ বিপর্যয়ের পর দেড় শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে নেয়া। অর্থাৎ, সেখানে যে ঠিকই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে এতগুলো পরিবারকে উচ্ছেদের জন্য খুঁজে পাওয়া। আবহাওয়া দফতরের কর্মকর্তা শেখ ফরিদ আহমেদ জানান, আষাঢ় মাস না এলেও মনসুন এর মধ্যেই চলে এসেছে। এ সময়ের মধ্যে সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হলে তা ভারি বর্ষণ ঘটিয়ে থাকে। লঘুচাপের জন্য মহাবিপদ সঙ্কেত দেখাতে বলা হয় না। তবে টানা বর্ষণের কারণে পাহাড় নরম হয়ে ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে, যা আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়ে থাকে। এ বছর জৈষ্ঠ্যে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তা স্মরণকালের মধ্যে সর্বাধিক। আবহাওয়া দফতর সূত্রে পাওয়া রেকর্ডে দেখা যায়, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১২৮ মিলিমিটার। এর আগে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় ১৩১ মিলিমিটার এবং সকাল ৯টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টায় ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। দুইদিনের এ বর্ষণ ছিল প্রায় একটানা। এতে করে পাহাড়গুলো নরম হয়ে খুবই নাজুক অবস্থায় পতিত হয়ে আংশিক ধসে পড়ে। প্রতিবার বর্ষণে বিপর্যস্ত হয় চট্টগ্রাম নগরী। কিন্তু এবার নগরীতে ভোগান্তি সৃষ্টি করলেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে পার্বত্যাঞ্চল ও উপজেলা পর্যায়ে। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান এবং চন্দনাইশে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে তা এক ধরনের মানবিক বিপর্যয়। ধসে পড়া মাটি সরিয়ে সড়ক উন্মুক্ত করতে গিয়ে প্রাণ হারান সেনাবাহিনীর চার সদস্য। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৫১ নিশ্চিত হওয়া গেলেও এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে প্রশাসন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে।
×