ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দু’ভাগ হচ্ছে সিভিল এভিয়েশন ॥ আকাশ পথে নব দিগন্ত

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১১ জুন ২০১৭

দু’ভাগ হচ্ছে সিভিল এভিয়েশন ॥ আকাশ পথে নব দিগন্ত

আজাদ সুলায়মান ॥ দু’ভাগ হচ্ছে সিভিল এভিয়েশন। একটি রেগুলেটর অপরটি সার্ভিস প্রোভাইডার। রেগুলেটরের কাজ হচ্ছে আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা। সার্ভিস প্রোভাইডারের কাজ হচ্ছে দেশের সব বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী বলেছেন, আন্তর্জাতিক আদলেই একাজটি করতে হচ্ছে। এটি আরও অনেক আগেই করা দরকার ছিল। এখন কাজ শুরু হয়েছে। সময় লাগলেও এটা নিশ্চিত হবেই। এটি না করে উপায় ন্ই্।ে সিভিল এভিয়েশন বর্তমানে একই সঙ্গে রেগুলেটরি ও সার্ভিস প্রোভাইডার দুটোরই কাজ করছে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এ কাজটি করা হচ্ছে আইকাওর গাইড লাইন অনুসারে। এ জন্য বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন আইকাও প্রতিনিধি দল। সিভিল এভিয়েশনের সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিমানবন্দর ও এয়ারলাইন্সগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতেই পৃথক করা হচ্ছে সিভিল এভিয়েশনের রেগুলেটর ও সার্ভিস প্রোভাইডার। বর্তমানে এ দুটো কাজ একাই করছে সিভিল এভিয়েশন। এতে এয়ারপোর্ট ও এয়ারপোর্টগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) সিভিল এভিয়েশনের এ দুুটো দিক আলাদা করার তাগিদ দিয়ে আসছিল। আইকাও রুলস মেনেই সিভিল এভিয়েশন এ নিয়ে রেগুলটরি ও সার্ভিস প্রোভাইডারের কাজ প্রণয়নে কাজ করছে। এ সংক্রান্ত অগ্রগতি দেখতে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে আইকাও-এর প্রতিনিধিদল। সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক (এফএসআর) উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, রেগুলেটর ও সাভির্স প্রোভাইডার আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব ধরনের কাজই চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটা করা গেলে দেশের সিভিল এভিয়েশনের মান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও মর্যাদাশীল হবে। জানা যায়, পাকিস্তান আমলে বর্তমান সিভিল এভিয়েশন নামের প্রতিষ্ঠান ছিল এয়ারপোর্ট অথরিটি অব বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে এটি সিভিল এভিয়েশন অথরিটি হিসেবে রূপ পায়। যার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সব বিমানবন্দরের রেগুলেটর হিসেবে কাজ করা । একই সঙ্গে সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছে সিভিল এভিয়েশন। বিগত চল্লিশ বছর ধরে এ দুটো কাজই করে আসছে সিভিল এভিয়েশন। কিন্তুু বিশ্বের অন্যান্য দেশে আইকাও রুলস অনুযায়ী সিভিল এভিয়েশনের দুটো বিভাগ আলাদা আলাদা কাজ করলেও বাংলাদেশে তা ছিল ব্যতিক্রম। এ সংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর আইকাও ও এফএএ-এর স্েঙ্গ কারিগরি সহযোগিতার চুক্তি করে সিভিল এভিয়েশন । সেই চুক্তির ভিত্তিতেই বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে দুই সদস্যের একটি অডিট টিম। এ টিম সিভিল এভিয়েশনের বর্তমান সক্ষমতা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বিশেষ দিকনির্দেশনা দেবে। বাংলাদেশের বিমানবন্দর ও বিমানসংস্থাগুলোর প্রবৃদ্ধি কেমন, আগামী এক দশক পর সেই প্রবৃদ্ধির হার কেমন হবে তার একটা ধারণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে এই অডিট টিমের কাছে। সিভিল এভিয়েশন বর্তমানে একই সঙ্গে বিমানসংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবেও কাজ করছে আবার সার্ভিসও দিচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সিভিল এভিয়েশন আন্তর্জাতিক মান ও সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না। চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, যেমন বিমান সংস্থাগুলোকে বিমানবন্দর ব্যবহারের অবকাঠামোগতসহ অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করে সিভিল এভিয়েশন। এখন বিমান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এয়ারলাইন্সগুলো কোন শর্ত ভঙ্গ করলে সিভিল এভিয়েশন কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। একইভাবে সিভিল এভিয়েশনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা বিমানবন্দরের কোন রুলস যদি লঙ্ঘন করা হয়, তারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয় সিভিল এভিয়েশনকে। কিন্তু সেটা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রেগুলেটর ও সার্ভিস প্রোভাইডার একই প্রতিষ্ঠান; সিভিল এভিয়েশনের অধীন। এ অবস্থায় সিভিল এভিয়েশন দুভাগ হয়ে গেলে এ ক্ষেত্রে আন্তজার্তিক মান বজায় রাখা সহজ হবে। এ দুটো বিভাগ পৃথক পৃথক নামেই অভিহিত হবে। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানকারী প্রতিনিধিরা এসব বিষয়ে তাদের সুপারিশমালা প্রণয়নের পাশাপাশি কারিগরি সহায়তা দেবে। আগামী তিন মাসের মধ্যেই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে সিভিল এভিয়েশন। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমান সিভিল এভিয়েশনকে দুভাগ করার পর একটি থাকবে রেগুলেটর বডি হিসেবে যার কাজই হবে শুধু এয়ারপোর্ট ও এয়ারলাইন্সগুলো ঠিকমতো আইন মেনে কাজ করছে কিনা সেটা তদারকি করা ও শাস্তি দেয়া। আবার সার্ভিস প্রোভাইডারের কাজ হবে দেশের সকল বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা, অপারেশনাল কার্যাক্রম, প্রকৌশল বিভাগের উন্নয়ন-সংস্কার কার্যক্রম, কমিউনিকেশনসহ সব ধরনের সেবা সুনিশ্চিত করা। এটার নামকরণ করা হতে পারে এয়ারনেভিগেশন সার্ভিস প্রোভাইডার অথবা ‘এয়ারপোর্ট অথরিটি। ভারতসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এ সার্ভিস দিয়ে থাকে এয়ারপোর্ট অথরিটি নামের প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া থাকবে বিমানবন্দরে যে কোন ধরনের বিমান দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন ‘বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত বোর্ড’। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) এবং ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ)-এর সুপারিশে সিভিল এভিয়েশন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব ইতোমধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়েছে। দেশের বেসামরিক বিমান চলাচল ও বিমান বন্দরগুলোর দ্রুত উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যেই সরকার সিভিল এভিয়েশনকে দুভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। এ বিষয়ে উইং কমান্ডার জিয়া জানান, যে কোন বিমানবন্দরে ফ্লাইট অপারেশনের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী, স্বল্প মেয়াদী ও তাৎক্ষণিক উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের প্রয়োজন হয়। বিমানবন্দরের রানওয়ে বৃদ্ধি, লাইটিং সিস্টেম, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা বাউন্ডারিসহ প্রয়োজনীয় সকল কাজ দ্রত করার লক্ষ্যেই সিভিল এভিয়েশন থেকে আলাদা করে এয়ারপোর্ট অথরিটি নামের নতুন সংস্থাটি করতে যাচ্ছে সরকার। এ সংস্থার অধীনে থাকবে প্রকৌশল বিভাগ, নিরাপত্তা বিভাগ এবং অন্যান্য সার্ভিস প্রোভাইডিং কার্যক্রম। এ জন্য নতুন করে জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন বিভাগকে ঢেলে সাজানো হবে। সিভিল এভিয়েশন শুধু রেগুলেটর বা প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এতে করে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো ও আকাশপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ। দ্রততম সময়ের মধ্যে দেশের বিমানবন্দরগুলোর ব্যাপক উন্নয়নও সম্ভব হবে। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের বিমানবন্দরগুলোর সুনাম বৃদ্ধির সুযোগ পাবে নতুন সংস্থাটি। জানতে চাইলে মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, উন্নত দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই সিভিল এভিয়েশন থেকে আলাদ একটি সংস্থা রয়েছে এয়ারপোর্ট অথরিটি নামে। ওই সংস্থাই তাদের সকল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা, প্রকৌশলী কার্যক্রম, বিমানবন্দরের সার্বিক উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন, ফ্লাইট সেফটি ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণসহ বিমানবন্দরের সকল কর্মকা- পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক আদলে গঠন করা হচ্ছে এয়ারপোর্ট অথরিটি। আর তা বাস্তবায়ন করতে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ রেগুলেটর ও সার্ভিস প্রোভাইডার পৃথকীকরণের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ বিষয়ে উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিমানবন্দরগুলোর সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সিভিল এভিয়েশন থেকে বিমানবন্দরের নিজস্ব আলাদা সংস্থা রয়েছে। সিভিল এভিয়েশন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আর বিমানবন্দর অথরিটি বিমানবন্দরের প্রোভাইডিং সার্ভিস কর্মকা- পরিচালনা করে। আইকাও এবং ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুপারিশে এ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এ কারণে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিএএবি সার্ভিস প্রোভাইডার ও রেগুলেটরি কার্যক্রমকে আলাদাকরণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, এয়ারপোর্ট অথরিটি পৃথক করার প্রয়োজনীয় দিক নিদের্শনা প্রাপ্তির লক্ষ্যে সিএএবির সঙ্গে আইকাওর কারিগরি সহায়তা ব্যুরোর একটি চুক্তি ইতোমধ্যে স্বাক্ষর হয়েছে। এ চুক্তির শর্ত অনুয়ায়ী বিমান দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত বোর্ড গঠন করা হবে। এ বোর্ড সরাসরি বিমানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যে কোন বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত করতে মন্ত্রীর অধীনে এ তদন্ত বোর্ড কাজ করবে। এ কাজটি করতে কেমন সময় লাগতে পারে প্রশ্ন করা হলে চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, এটি পূর্ণাঙ্গ আইনী কাঠামোতে বাস্তবায়ন করতে কমপক্ষে ৪/৫ বছর লাগতে পারে। তবে এর আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন কাজ চালিয়ে যাবার জন্য আইকাওর গাইড লাইন অনুসরণ করা হবে। এই গাইড লাইন হয়তবা মাসতিনেকের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।
×