ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন বছরে সব টার্গেট কিলিং মেজর জিয়ার নির্দেশেই

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১০ এপ্রিল ২০১৭

তিন বছরে সব টার্গেট কিলিং মেজর জিয়ার নির্দেশেই

শংকর কুমার দে ॥ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি)’ শীর্ষ নেতা হাফেজ মাওলানা মোঃ মাকসুদুর রহমান ওরফে আব্দুল্লাহ গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, সেনা বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সেই মেজর জিয়াউল হক জিয়ার কাছেই সামরিক প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ৩ বছর ব্লগার, প্রকাশক, লেখক, ভিন্নমতাবলম্বী যত টার্গেট কিলিং করা হয়েছে, তাও জিয়ার নির্দেশেই। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমটি আবারও গোপনে সংগঠিত করা হচ্ছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান গ্রেফতার হওয়া এবিটির শীর্ষ নেতা মাওলানা মোঃ মাকসুদুর রহমান ওরফে আব্দুল্লাহ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) একটি দল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে মাওলানা মাকসুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর তার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আদালতে দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে এবিটির এই শীর্ষ নেতা জানান, তিনি সেনা বাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হকের কাছে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে বছর দুয়েক আগে উত্তরার দেওয়ানবাড়ীর একটি বাসায়। দেড় মাসের ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কম্পিউটার, ইমান, তাওহিদ, কাফের হওয়ার কারণ, জিহাদের মাসালা, চাপাতি চালানো, আগ্নেয়াস্ত্র খোলা ও লাগানোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া বিশেষ এ্যাপসের মাধ্যমে নিরাপদে কিভাবে মেসেজ আদান-প্রদান করা হয়, সে বিষয়েও প্রশিক্ষণ নেয় সে। মেজর জিয়া আনসরুল্লাহ বাংলা টিমের শরিয়া বোর্ডের একজন সদস্য হলেও সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ থাকায় সংগঠনে তাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এ কারণে সামরিক প্রশিক্ষণের সব বিষয় দেখভাল করেন মেজর জিয়া। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, মাওলানা মাকসুদের সাংগঠনিক নাম আব্দুল্লাহ। ২০০৭ সালে ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় পড়ার সময় কিতাবুল জাহিদ পড়তে গিয়ে সে জিহাদ বিষয়ে আগ্রহী হয়। পরবর্তী সময়ে একই মাদ্রাসার অন্য এক শিক্ষকের সঙ্গে জিহাদ বিষয়ে আলোচনা করে। এছাড়া তাদের মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিভিন্ন বইপত্র ও ভিডিও আদান প্রদান হতো। জিজ্ঞাসাবাদে মাকসুদ ওরফে আবদুল্লাহ জানায়, তার বাবার নাম মতিউর রহমান আকন্দ। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার আশ্রমপাড়া এলাকায়। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত সে ময়মনসিংহের ফুলপুর বাসস্টপেজ মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল। যাত্রাবাড়ী এলাকায় সে সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে আসার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে পাঁচ সদস্যের একটি শরিয়া বোর্ড রয়েছে। কাউকে হত্যার আগে এই শরিয়া বোর্ডের অনুমতি নিতে হয়। পাঁচ সদস্যের শরিয়া বোর্ডের প্রধান হলো আরেকজন মাওলানা। যাকে এবিটির আধ্যাত্মিক নেতা বলা হয়। ২০১৩ সালে এবিটির আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করলে পলাতক এই শীর্ষ নেতাকে আধ্যাত্মিক নেতা ও শরিয়া বোর্ডের প্রধান করা হয়। মেজর জিয়া এ শরিয়া বোর্ডের সামরিক শাখার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া গত বছর মাওলানা নাঈম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ, সেও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এই শরিয়া বোর্ডের সদস্য। জিজ্ঞাসাবাদে মাওলানা মাকসুদ বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সাধারণত ইসলাম ধর্ম ও মহানবীকে নিয়ে কটূক্তিকারীকে হত্যার জন্য টার্গেট করে। টার্গেটেড ব্যক্তির বিস্তারিত পরিচয় সংগ্রহ করে তা শরিয়া বোর্ডে উত্থাপন করা হয়। শরিয়া বোর্ড টার্গেটেড সেই ব্যক্তিকে হত্যার অনুমোদন দিলে একটি ‘সিøপারসেল’ কে দায়িত্ব দেয়া হয়। এসব ‘সিøপার সেল’ পরিচালনা করেন মেজর জিয়া। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, শরিয়া বোর্ডের সদস্যরা সরাসরি কোন অপারেশনে অংশ না নিলেও হত্যার অনুমোদন ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতৃত্বে যত হত্যাকা- হয়েছে তার সবই শরিয়া বোর্ডের অনুমতি নিয়ে করা হয়েছে। ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এরপর বছরখানেক বিরতি দিয়ে ধারাবাহিকভাবে ব্লগার অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলয় নীল, অনন্ত বিজয় দাস, নাজিমুদ্দিন সামাদ ও সর্বশেষ গত বছরের শুরুর দিকে সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন রূপবান সম্পাদক জুলহাস মান্নান ও তার সহযোগী মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়। তদন্তে প্রতিটি ঘটনায়ই আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের জড়িত থাকার বিষয় উঠে এসেছে। রাজীব হায়দার হত্যার বিচার ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই মামলায় দুজনকে মৃত্যুদ- ও সাবেক আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীসহ অন্য ছয় আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা আত্মগোপনে রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আপাতদৃষ্টিতে বছরখানেক ধরে দৃশ্যমাণ কোন হত্যাকা- সংঘটিত না করলেও এই জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা গোপনে গোপনে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর নব্য জেএমবির নেতাদের গ্রেফতার করতে দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) ও পুলিশের অন্যান্য ইউনিট। জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণায় মানুষ সচেতন হওয়ায় এবিটির নেতাকর্মীরা একটু সময় নিচ্ছে। সময় ও সুযোগ নিয়ে এই জঙ্গী দলটি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) শরিয়া বোর্ডের প্রধান, অন্যান্য সদস্য ও চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াকে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। জিয়াকে গ্রেফতার করতে পারলেই এবিটি কিছুটা দুর্বল হবে। পলাতক জিয়া সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কিলার বাহিনী হিসেবে একাধিক ‘সিøপার সেল’ তৈরি করেছে, যা তাকে গ্রেফতার করা না গেলে আরও এই ধরনের সিøপার সেল গঠন করার আশঙ্কা রয়ে গেছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শরীয়াহ্ বোর্ডের পাঁচ সদস্যের মধ্যে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক জিয়া ও পলাতক আবু নাঈমসহ অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
×