ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়মুক্তির চেষ্টা

কুসিক নির্বাচনে পরাজয়ের দায় নিয়ে আওয়ামী লীগে বইছে ঝড়

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৮ এপ্রিল ২০১৭

কুসিক নির্বাচনে পরাজয়ের দায় নিয়ে আওয়ামী লীগে বইছে ঝড়

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা থেকে ॥ কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের এক সপ্তাহ পার হলেও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের দায় নিয়ে জেলাজুড়ে এবং বিভিন্ন মহলে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দোষারোপের রাজনীতি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। কোনভাবেই এ পরাজয় মেনে নিতে পারছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ খুঁজে ফিরছেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই প্রার্থীর পরাজয়ের নেপথ্যে নানামুখী কথা হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। দলের নেতা-কর্মীদের একপক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করতেও দ্বিধা করছে না। প্রার্থীর পরাজয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং এ নিয়ে জেলা পর্যায়ের নেতারা দায় চাপাচ্ছে একে অপরের ওপর। এদিকে আগামী ১২ এপ্রিল দলটির কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ এবং দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার বিষয়বস্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। নির্বাচনে সিটির দক্ষিণাংশের ৯টি ওয়ার্ডে ব্যাপক ভরাডুবির পর ওয়ার্ডগুলো কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, স্থানীয় এমপি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নির্বাচনী এলাকা নয় বলে গণমাধ্যমে দেয়া তার বক্তব্যের পর দলীয় অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সিটি নির্বাচন পর্যালোচনায় দলীয় সূত্র ও বিশ্লেষকরা বলছেন, দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দ্বিধাবিভক্তি, সম্পর্কের দূরত্ব, কোন্দল নিরসনে ব্যর্থতা, দলের প্রার্থীর বিপক্ষে একটি পক্ষের কৌশলগত বিরোধিতা, দল বা প্রতীকের অনুসারী কর্মীর পরিবর্তে নেতাকেন্দ্রিক কর্মী সৃষ্টি করে প্রভাব বিস্তার, প্রার্থীর পারিবারিক ইমেজ, প্রভাবশালী ব্যক্তিবিশেষের ষড়যন্ত্র, দ্বন্দ্বে এক পক্ষের হারে অপর পক্ষের জয়ে তৃপ্তির ঢেকুর, জেলা কমিটির ঢিমেতালে কার্যক্রম পরিচালনা, পাঁচ বছরে জেলা যুবলীগ ও মহানগর আওয়ামী লীগ-যুবলীগের কমিটি গঠন না হওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী মাঠে তেমন সক্রিয় না থাকা, দলের হয়ে নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নিষ্ক্রিয়তা- ইত্যাকার বিষয় দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ। তারা মনে করছেন- জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতাদের অতি আত্মবিশ্বাসই তাদের প্রার্থীকে ডুবিয়েছে। কেননা নেতা-কর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল। দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে নানারকম প্রশ্ন উঠেছে। কুমিল্লার রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের জটিল সমীকরণ শুরু থেকেই গুরুত্ব পায়নি কেন্দ্রীয় নেতাদের চোখে। তারা স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার প্রচারের কাজটি করতে পারলেও ভোটের মাঠে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোটারদের ঘরে ঘরে তেমনটি পৌঁছাতে পারেননি। এছাড়া দলীয় প্রার্থীকে ভোটারদের কাছে তুলে ধরার জন্য যতটা না প্রচার ছিল তার চেয়ে স্থানীয় নেতারা বেশি ব্যস্ত সময় পার করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় কেন্দ্রিক প্রচারে। অনেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে স্মৃতি ধরে রাখার লক্ষ্যে সেলফি ও ফটোসেশনসহ জেলা যুবলীগ ও মহানগর আওয়ামী লীগ-যুবলীগের কমিটিতে স্থান পাওয়ার আশায় নিজেদের তুলে ধরার জন্য ছিলেন ব্যস্ত। এতে মাঠ পর্যায়ে সাধারণ ভোটারদের প্রার্থীর পক্ষে মোটিভেশনের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। সূত্র মতে, শুরু থেকে সীমা ও তার অনুসারীদের অনেকটাই ভরসা ছিল কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর। তাদের ধারণা ছিল- দলীয় প্রভাবে ভোটের দিন নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনের কিছুটা হলেও নমনীয় ভাব ও শিথিলতায় ভোটের ফল অনুকূলে আসবে। কিন্তু তাদের কঠোর অবস্থানের কারণে নির্বিঘেœ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট প্রদান করে সাধারণ ভোটাররা। এক্ষেত্রেও জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন সীমা। তবে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই স্পষ্ট করে বলেন, জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আফজল খান ও আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের দ্বন্দ্ব বহুদিনের হলেও এবারের সিটি নির্বাচনে আফজল খানের মেয়ে ও নৌকার প্রার্থী সীমা অংশগ্রহণ করায় দ্বন্দ্ব প্রভাব পড়েনি। আওয়ামী লীগের ভোটের হিসাবে গত কুসিক নির্বাচনের তুলনায় ২১ হাজারেরও অধিক ভোট পড়েছে দলের প্রার্থীর বাক্সে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন- ফল পাল্টে যাওয়ার পেছনে সাধারণ ভোটারদের ভূমিকা ছিল বেশি। দলের বাইরে সাধারণ ভোটারদের কাছে টানতে পারেনি দলটি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, সিটি এলাকার সদর দক্ষিণাংশের ৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলের প্রার্থী দেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, স্থানীয় এমপি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এসব ওয়ার্ডে দুটি কেন্দ্রের ফল স্থগিত রয়েছে। এরমধ্যে ওই নেতার সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে একজন ছাড়া অন্যরা ফেল করেছে। দলের প্রার্থীর পক্ষে কুসিক নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, কুসিক নির্বাচনে এক নেতা কেন্দ্রীয় নেতাদের তার আসনের ৯টি ওয়ার্ডে জেতার বিষয়ে বার বার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তার ছোট ভাইও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওই ৯টি ওয়ার্ডে যেতে হবে না বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। এ ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে বাইরের কাউকে ভাবতে হবে না একথাও বলেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে ওই এলাকার ২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ২০টি কেন্দ্রেই চরম ভরাডুবি ঘটে দলের মেয়র প্রার্থী সীমার। ফল ঘোষণার পর দলের নেতাকর্মীর অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ওই নেতা কাউন্সিলর পদে যাদের সমর্থন দিয়েছেন ওই সব প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একই নেতার অনুসারীরা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়া দায়িত্ব নিয়েও দলের মেয়র প্রার্থীকে তুলে ধরার মতো কর্মকা- না থাকায় ভোটের মাঠে কৌশলগত দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং ফল বিপর্যয় ঘটে। তারা আরও বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে ওই নেতা-অনুসারী ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে চেন অব কমান্ড ছিল না, তাই দলের মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলরদের ভরাডুবি ঘটেছে। এদিকে সিটি নির্বাচনের পর নির্বাচন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওই এলাকার এমপি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল। ফলাফলের বিষয়ে তিনি বলেন, ৯টি ওয়ার্ড অনেকেই জানেন আমার এলাকা। আসলে বিষয়টি সঠিক নয়। এলাকাটি কুমিল্লা সিটির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আমার সাংগঠনিক কর্মকা- বা উন্নয়ন করার আর সুযোগ নেই। সে জন্য এলাকাটি আমার নয়। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা জানান, জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত মহানগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কমিটি হয়নি। নেই জেলা যুবলীগের কমিটিও। এক্ষেত্রে সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থীর পরাজয় নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তাই প্রমাণ করে। এছাড়া গণমাধ্যমে দেয়া লোটাস কামালের এ ধরনের বক্তব্য আমাদের হতাশ করেছে। অপরদিকে নির্বাচনের আগে কুমিল্লায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক একেএম এনামুল হক শামীম বলেছিলেন, দ্বন্দ্ব নিরসন করে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করার জন্য আমরা এসেছি। এখানে ঘোড়ার ঘাস কাটতে আসিনি। তার এমন বক্তব্যে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু গত ৩০ মার্চ নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার ভরাডুবি ঘটে।
×