ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুসলিম উম্মাহর মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৭ এপ্রিল ২০১৭

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুসলিম উম্মাহর মিলনমেলা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সোহরাহওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত ওলামা মাশায়েখদের সম্মেলন পরিণত হয়েছিল মুসলিম উম্মাহর এক ঐতিহাসিক মিলনমেলায়। সমাবেশ ঘটেছিল লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষের। এদের মধ্যে ওলামা মাশায়েখ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লোকজন ছাড়াও অধিকাংশই ছিলেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাদের অনেকেই সঙ্গে করে ধর্মপ্রাণ অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদেরও এনেছিলেন। জঙ্গীবাদ সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের সচেতন করতেই এমন উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন অনেকেই। আগতরা বলছিলেন, বিশ্ব এজতেমা ছাড়া এত বড় ধর্মীয় সমাবেশ আর কখনও হয়নি। সমাবেশজুড়ে ছিল কঠোর নিরাপত্তা বলয়। বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ একজন। মাথায় টুপি, পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা, পায়ে সেন্ডেল। পাঞ্জাবির বুক পকেটে সম্মেলনে কার্ড ঝোলানো। তাতে তার নাম পরিচয় সবই লেখা আছে। তার বাঁ হাত ধরে বোরখা পরা এক কিশোরী সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। মুখ খোলা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকা, ভবনসহ অন্যান্য জায়গা কিশোরীকে দেখাচ্ছিলেন ওই ব্যক্তি। কাছে গিয়ে সালাম দিলে দুইজনের কাছ থেকেই সালামের উত্তর আসে। এরপর শুরু হয় কথাবার্তা। পেশায় তিনি মাদ্রাসা শিক্ষক। তিনি নাম পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, অনেক আগ্রহ নিয়ে সম্মেলনে এসেছি। সঙ্গে করে মেয়েকেও নিয়ে এসেছি। মেয়েটি ধর্মের প্রতি খুবই ভক্ত। অনেকটা অন্ধও বলা চলে। শুধু মেয়ে নয়, তার পুরো পরিবারই ধর্মপরায়ন। মেয়েকে আনার পেছনে আরও কারণ আছে। যদিও তিনি কারণ সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দেননি। বলেছেন, মেয়েটি যেহেতু মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ধর্মের প্রতি মেয়ের অতিরিক্ত ভক্তির সুযোগ নিয়ে কোন গোষ্ঠী মেয়েটিকে জঙ্গীবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এজন্য মেয়েকে নিয়ে পরিবারের মধ্যে সবার ভয় আছে। সেজন্য ধর্মে জঙ্গীবাদ সম্পর্কে কি কথা বলা আছে তাই শোনাতে নিয়ে এসেছি। সম্মেলনে আগত সৌদি আরবের মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর দুই প-িত ইসলাম ধর্মে জঙ্গীবাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। মেয়ে নিজ কানে প-িতদের কথা শোনে গেল। এতে করে মেয়ের মনে ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের আর কোন বিভ্রান্তি থাকবে না বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। কিশোরী বয়ানে সন্তোষ্ট। ইসলামের দোহাই দিয়ে তাকে আর কেউ বা কোন গোষ্ঠী বিপথগামী করতে পারবে না বলেও জানায় ওই কিশোরী। ওই শিক্ষক আরও বলছিলেন, মেয়েকে সম্মেলনে আনার পেছনে আরও কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম তাদের এলাকার দুই বোন ইতোমধ্যেই জঙ্গীবাদের চক্রে পড়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। দুই বোনের মধ্যে একজন যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। অপরজনের কোন হদিস নেই। সম্মেলনে আগতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে লোকজন সকালে রওনা হয়ে বাসে করে ঢাকায় এসেছেন। আর অন্যান্য জেলার লোকজনদের অনেকেই রাতেই রওনা হয়েছেন। এসব বাস ভোর থেকে শুরু করে দুপুর বারোটার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে। এরপর নির্ধারিত জায়গায় বাস রেখে হেঁটে ও বিভিন্নভাবে সমাবেশস্থলের দিকে রওনা হন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্মেলনের আয়োজন করে। আগতদের মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীন মসজিদ, মসজিদভিত্তিক পাঠাগারসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ছাড়াও অনেক সাধারণ মানুষ এসেছেন। তাদের অনেকেই নিজ উদ্যোগে আবার কেউ কেউ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে এসেছেন। সম্মেলনে যোগদানকারীরা বলছিলেন, তারা মূলত সৌদি আরব থেকে আগত দুই ইসলামী প-িতকে দেখতে এবং তাদের কথা শুনতে এসেছেন। পাশাপাশি দেশে চলমান জঙ্গী তৎপরতার বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্মে কি বলা আছে তা জানার জন্য, বোঝার জন্য এসেছেন। এছাড়া তাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। ইসলামকে পুঁজি করে বর্তমানে যে জঙ্গীবাদী কর্মকা- হয়েছে তা আসলে ইসলাম সর্মথন করে কিনা, সেটিও জানার বিষয় ছিল। তারা বিষয়টি দেরিতে হলেও সঠিক প-িতদের কাছ থেকে শুনে নিশ্চিত হয়েছেন। এতদিন ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে জঙ্গীবাদের যে ব্যাখ্যা একটি গোষ্ঠী দিয়ে আসছিল, তা ভুল বলে প-িতরা পবিত্র কোরান থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে পরিষ্কার করেছেন। অনেক কষ্ট করে তারা সম্মেলনে যোগ দিলেও, তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। অনেক মাদ্রাসা শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম আক্ষেপ করে বলছিলেন, তারাও অনেক সময় জঙ্গীবাদবিরোধী বয়ান দেন মসজিদে ও ক্লাসে। কিন্তু অনেকেই তা ভাল চোখে দেখে না। আড়ালে আবডালে আমরা ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখি না বলেও তিরস্কার করেন। অনেকে তো সামনেই বলে ফেলেন। এতে করে আমাদের লজ্জায় পড়তে হয়। এবার সৌদি আরব থেকে আগত ইমলাম ধর্মের দুই প-িতের বরাত দিয়ে মাদ্রাসায় ও মসজিদে জঙ্গীবাদবিরোধী বক্তব্য দিতে পারবেন। এতে করে সহজেই আগে যারা আমাদের সমালোচনা করতেন, এখন আর তারা তা করতে পারবেন না। এটি আমাদের জন্য খুবই স্বস্তির বিষয়। শিক্ষক ও ইমামরা জানান, সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এবং জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সৌদি আরব থেকে আগত দুই ইসলামী চিন্তাবিদের এমন বয়ান খুবই কাজে আসবে। অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদেরও আর কুচক্রী মহল ইসলামের দোহাই দিয়ে জঙ্গীবাদের দিকে নিয়ে যেতে পারবে না। আর এর প্রমাণ হিসেবে মোবাইল ফোনে সৌদি আরব থেকে আগত ইসলাম ধর্মের দুই প-িতের বক্তব্য রেকর্ড করে রেখেছি। প্রয়োজনে ক্লাসে, পাড়া মহল্লায়, মসজিদে ও পরিবারে তা বাজিয়ে শুনানো হবে। এতে করে কেউ আর চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। শুধু রেকর্ড নয়, ভিডিও করে রেখেছি। যাতে কেউ আর ন্যূনতম চ্যালেঞ্জ না করতে পারে। এদিকে সম্মেলনে ঘিরে ছিল নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শত শত মাইক লাগানো হয়েছিল পুরো এলাকাজুড়ে। যাতে সমাবেশস্থলের বহুদূর থেকেও বক্তব্য শোনা যায়। অনুষ্ঠানস্থল ও আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছিল অসংখ্য সিসি ক্যামেরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে চারদিকে অন্তত এককিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল অলিখিত ১৪৪ ধারা। সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও যানবাহনে নিয়মিত তল্লাশি চালানো হয়েছে। উদ্যানের চারদিকে এপিসি (আর্মার পারসোন্যাল ক্যারিয়ার), জলকামান, মেশিনগান বসানো হয়েছিল। জেলা থেকেও পুলিশ এনে মোতায়েন করা হয়েছিল পুরো এলাকায়। বসানো হয়েছিল অস্থায়ী তিনটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। সেখান থেকে পুরো এলাকার ওপর সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজর রাখা হচ্ছিল। সকাল থেকেই সব ধরনের ভাসমান দোকানপাট তুলে দেয়া হয়। হকারদের নিরাপদ দূরত্বে বসতে দেয়া হয়েছে। উদ্যানের আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াট, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল, ক্রাইসিস রেসপন্স টিম, র‌্যাবের হেলিকপ্টারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সম্মেলনে প্রবেশদ্বার ছবিহাট, টিএসসি, বাংলা একাডেমি, তিন নেতার মাজার ও কালি মন্দিরের গেটে বসানো হয়েছিল আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর। বসানো হয়েছিল ওয়াচ টাওয়ার। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সর্বক্ষণিক পুরো এলাকায় ভারী অস্ত্রগোলাবারুদ নিয়ে টহল দিয়েছে।
×