ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজে দেয়া পোস্টে শারমিন

‘আমি যখন নাইনে পড়ি, মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন’

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৪ এপ্রিল ২০১৭

‘আমি যখন নাইনে পড়ি, মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন’

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সত্যনগর গ্রামের বাবা কবির হোসেন ও মা গোলেনূর বেগমের মেয়ে শারমিন আক্তার। ২০১৫ সালে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দেশব্যাপী আলোচনায় আসে। তার এ সাহসিকতার জন্য স্বর্ণকিশোরী ফাউন্ডেশন তাকে ২০১৫ সালে পুরস্কার প্রদান করে। এরপর থেকে শারমিন বাল্যবিবাহ রুখতে এবং জোরপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের এ সাহসী কন্যা সম্প্রতি বিশ্বসেরা সাহসী নারীর পুরস্কার অর্জন করেছে। ২৯ মার্চ শারমিনকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘সেক্রেটারি অব স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অফ কারেজ (আইডব্লিউওসি) ২০১৭’ প্রদান করেন আমেরিকার ফার্স্ট লেডি মেলিনা ট্রাম্প। এ পুরস্কার নিতে ১৮ মার্চ ঝালকাঠির শারমিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছেন। পুরস্কার পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত শারমিন। তার ভাষ্য, ‘আমি লেখাপড়া করে কিছু করতে চাই, অসহায় মেয়েদের জন্য কাজ করতে চাই। আর আমি চাই সবাই আমার মতো এ ধরনের সাহসী কাজে উদ্বুদ্ধ হউক।’ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেইজে (ইউএস অ্যাম্বাসি-ঢাকা) পোস্ট করা এক ভিডিও বার্তায় শারমিন কিভাবে তার বাল্যবিবাহ রুখেছে সে প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘২০১৫ সালে আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি। বয়স কম হলেও এটুকু বুঝতে পারছিলাম, আমার ওপর যা হচ্ছে তা পুরোপুরি অন্যায়। আমার মায়ের ইচ্ছায়, সেই অন্যায় সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল। একে তো আমার বিয়ের বয়স হয়নি। হঠাৎ মা একদিন বললেন, ‘এ ছেলে তোর স্বামী, এখন থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে ওর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে হবে তোকে।’ মা আমাকে বাবার বয়সী স্বপন খলিফা নামক একটা লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি বলি, না আমি বিয়ে করব না, আমি লেখাপড়া করব।’ ‘২০১৫ সালের ৬ আগস্ট। আমাকে চিকিৎসা করানোর কথা বলে মা খুলনায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে তোলেন। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন স্বপন নামের লোকটি। রাতে আমাকে ওই বাসায় স্বপনের সঙ্গে এক কক্ষে থাকার জন্য মা চাপ দিচ্ছিলেন। তাতে সম্মত না হওয়ায় মা আমাকে মারধর করে জোর করে স্বপনের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেন। ৭ আগস্ট সকালে আমি ওই বাসা থেকে কৌশলে পালিয়ে রাজাপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। স্বপন ও তার লোকজন আমার পিছু নেন। পিরোজপুরে এসে স্বপন ও তার লোকজন আমাকে ধরে ফেলেন এবং বাস থেকে নামিয়ে রাজাপুরে নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে আমার বাড়িতেই আটকে রাখেন তিনি। ১৬ আগস্ট বন্দিদশা থেকে পালিয়ে সহপাঠী নাদিরা আক্তারের বাড়িতে যায় এবং তাকে সব খুলে বলে। তারপর থানায় গিয়ে পুলিশকে সবকিছু বলি। কিন্তু তিনি কেসটা নিতে চাইছিলেন না। পরে আশপাশের সাংবাদিকদের চাপেই মামলা নেন ওসি। আমার মা ও ওই ব্যক্তিকে তারপর গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের চার মাস করে জেল হয়। এরপর থেকে আমি দাদির কাছে থেকেই পড়াশোনা চালিয়েছি।’ শারমিনকে কিভাবে ‘সেক্রেটারি অব স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অফ কারেজ (আইডব্লিউওসি) ২০১৭’ পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে বাছাই করা হলোÑ এ প্রশ্নের উত্তরে ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেরিনা ইয়াসমিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে শারমিনের এ সাহসিকতার গল্প প্রচার হওয়ায় সে একজন সাহসী নারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় শারমিনকে আমরা বাংলাদেশের সাহসী নারী হিসেবে বাছাই করি। শারমিন এখনও যুক্তরাষ্ট্রে আছে। শীঘ্রই সে দেশে আসবে। আমরা আশা করছি সে দেশে আসলে তাকে আমরা বিশেষভাবে অভিবাদন জানাব। ভবিষ্যতে শারমিনের মতো দেশের অনেক নারী সমাজের অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাহসিকতার পরিচয় দেবে বলে আশা রাখছি।’ পুরস্কার পেয়ে আনন্দিত শারমিন ভিডিও বার্তায় সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আমি যে সাহসটা দেখাইছি, নিজের বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দিয়েছি, সে জন্য পুরস্কারটা পেয়েছি। আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে। আমি চাই বাংলাদেশের আর কেউ আমার মতো কেউ কিছু করে দেখাক। নিজের বাল্যবিয়ে আটকাক। তারা যেন দুর্বল না হয়ে পড়ে। নিজের মধ্যে সাহস রাখে।’ সাহসিকতার জন্য প্রশংসিত শারমিন এ বছর রাজাপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। বর্তমানে সে তার দাদির সঙ্গে ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সত্যনগর গ্রামে বসবাস করছে। সমাজের ক্ষতিকর প্রথা বাল্যবিবাহ ও জোরপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে শারমিন ভবিষ্যতে একজন আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সেক্রেটারি অফ স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অফ কারেজ (আইডবিউওসি) এ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে প্রতিবছর বিশ্বের নারীদের অসাধারণ সাহসিকতা ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে যারা ব্যক্তিগত ঝুঁকি সত্ত্বেও শাস্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, নারী-পুরুষের সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন এর ব্যাপারে অবদান রেখেছেন। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের এ পুরস্কার এ পর্যন্ত বিশ্বের ৬০টি দেশ থেকে শতাধিক নারীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বছর বাংলাদেশের কন্যা শারমিনসহ বিশ্বের ১৩টি দেশের ১৩ জন নারী এ সম্মাননা পেয়েছেন।
×