ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিতার প্রত্যাখ্যান, রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট নয়

রাজীব হায়দার হত্যার রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩ এপ্রিল ২০১৭

রাজীব হায়দার হত্যার রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বহুল আলোচিত গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম দীপের দেয়া মৃত্যুদ- এবং জঙ্গী নেতা মুফতি জসিম উদ্দীন রাহমানীসহ অন্য ছয় আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ের সাজাই বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। রবিবার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির, সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম ও বিলকিস ফাতেমা। আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন এ্যাডভোকেট রেজাক খান, কামাল হোসেন মিয়া, মোঃ আহসান উল্লাহ। রায়ের পর ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল জাহিরুল হক জহির সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলার যে তদন্ত হয়েছে, তা আরও সুষ্ঠু, সুনির্দিষ্টভাবে হওয়া উচিত ছিল। তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তের ওপরই নির্ভর করে একটি ফৌজদারি মামলার প্রমাণের বিষয়টি। সেজন্য দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল, দায়বদ্ধ কর্মকর্তাদের তদন্তে নিয়োগ করতে পুলিশ প্রধানকে বলা হয়েছে। অন্যদিকে রাজীবের বাবা ডাঃ নাজিম উদ্দিন বলেছেন, এই রায়ে ন্যায়বিচার পাইনি। আমি এ রায় প্রত্যাখ্যান করলাম। যারা আমার সন্তান মেরেছে তারা প্রমাণিত সন্ত্রাসী, শিক্ষিত সন্ত্রাসী। কিন্তু তাদের সর্বোচ্চ সাজা হয়নি। জঙ্গীদের যদি সর্বোচ্চ সাজা দেয়া না হয়, তা হলে আপনি বুঝতে পারেন সমাজের কি আবস্থা। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার যতটুকু সুযোগ আছে, সেটুকু করব। রায়ে রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম দীপ মৃত্যুদ-। মাকসুদুল হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ-। এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছরের কারাদ- এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদ-। মুফতি মোঃ জসিম উদ্দীন রাহমানীকে পাঁচ বছরের কারাদ- এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে আরও দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদ-। সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে ৩ বছরের কারাদ- এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদ-। আসামিদের মধ্যে রানা নিম্ন আদালতের রায়ের পর পলাতক থাকায় আপীল করার সুযোগ পাননি। কারাগারে থাকা বাকি সাতজনই আপীল করেন। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, একজন ইমামের দায়িত্ব হলো মুসল্লিদের নামাজ পড়ানো। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা। তিনি এমন কোন বয়ান দেবেন না যা দেশের প্রচলিত আইনবহির্ভূত। যদি কেউ ইসলাম এবং মুহাম্মদ (সা.) অথবা যে কোন ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে তাহলে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারও নেই। কোন ব্যক্তির কারও ধর্ম সম্পর্কে কটাক্ষ করা উচিত নয়। আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, এ মামলার আসামি মুফতি জসিম উদ্দীন রাহমানী ছাড়া বাকি সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। তারা কেন এই পথে এসেছে তা বোধগম্য নয়। এ ধরনের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিপথে যাওয়ার জন্য অভিভাবকরাই দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। আমরা অনেকটা তাই মনে করি। এ মামলার আসামিদের সকলের পিতা-মাতা উচ্চশিক্ষিত। তাদের উচিত ছিল সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেয়া। কিন্তু তারা তা দিতে পারেনি। সেকারণে তারা গোল্লায় গেছে। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আমরা নিজেদের লাইফ স্টাইল কিভাবে উন্নত করা যায় সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। শিশু সন্তানদের মানসিক অবস্থার কথা, তারা কি করতে চায়, কোন বিষয়ে পড়তে চায়, তা না জেনে তার (শিক্ষার্থী) মনের বিরুদ্ধে অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়। এতে তাদের সঠিকভাবে বাড়তে দেয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। এ কারণে এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। এমনকি রাষ্ট্রসহ সচেতন নাগরিকদের চিন্তা করতে হবে সুস্থ রাজনীতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান, স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। নিঃসন্দেহে অভিভাবকরা শিশুর প্রাথমিক শিক্ষক। তাই তাদের সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আদালত বলেছেন, আসামিদের অপরাধ এতই ভয়ংকর ও নৃশংস যে তাদের সাজা কমানোর কোন সুযোগ নেই। এছাড়া আসামিদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী, অপরাপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। রায়ে ৫ আসামিকে সাজা কম দেয়ার বিষয়ে বলা হয়, নি¤œ আদালত সকল সাক্ষ্য সঠিকভাবেই পর্যালোচনা করে সাজা দিয়েছে। তাই ওই রায়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। বিচারিক আদালতের রায় পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাইনি। এ কারণে বিচারিক আদালতের রায়ই বহাল রাখা হলো। এ রায়ের পর নিহত রাজিবের পিতা মামলার বাদী ডাঃ নাজিম উদ্দিন অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা খ-িত রায়। এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হবে। তিনি বলেন, যারা আমার সন্তানকে যারা মেরেছে তারা স্বীকৃত ও প্রমাণিত সন্ত্রাসী। তারা অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। তাই তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। তিনি বলেন, সরকার বলছে যে তাদের নীতি হলো জঙ্গীদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। সরকার জঙ্গীদের শাস্তি চায়। অথচ এই রায়ের তার কোন প্রতিফলন হয়নি। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে রাজধানীর পল্লবীতে তার বাসার সামনে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় রাজীবের বাবা ডাঃ নাজিম উদ্দিনের করা মামলায় ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দেয় পুলিশ। এর পরের বছর ২০১৫ সালের ১৮ মার্চ বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু করে। সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে একইবছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার একটি আদালত আটজনকে সাজা দেন।
×