ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন ১৬ এপ্রিল

সেগুনবাগিচা ছেড়ে আগারগাঁও যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৬ মার্চ ২০১৭

সেগুনবাগিচা ছেড়ে আগারগাঁও যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

মনোয়ার হোসেন ॥ একাত্তরের যুদ্ধদিনের স্মৃতি স্মারক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সেগুন বাগিচা ছেড়ে চলে যাচ্ছে শেরে বাংলা নগরের আগারগাঁওয়ে। স্বাধীনতার মাস মার্চের ৩ তারিখের ভরদুপুরে পৌঁছে যাই সেগুন বাগিচা থেকে স্থানান্তরিত হতে যাাওয়া বাংলার জন্ম-ইতিহাসের সাক্ষ্যবহ এ জাদুঘরে। সেগুন বাগিচার একুশ বছরের স্মৃতি পেরিয়ে আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনের প্রবেশমুখেই স্বাগত জানায় হান্টার নামের যুদ্ধবিমান। সুদৃশ্য আটতলা ভবনটির নিচতলার উপরের অংশে চমৎকারভাবে দৃশ্যমান হয়েছে বাঙালীর রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিনির্মাণের রণাঙ্গনে পাকবাহিনীকে আকাশ থেকে বোমা মারা ভারতীয় এয়ারফোর্সের ফাইটারটি। এই নিদর্শনের নিচেই দেখা মেলে সাত বীরশ্রেষ্ঠ স্মরণে নওগাঁ থেকে নিয়ে আসা দিব্যক পিলার। বাঙালী জাতির জন্মের সংগ্রামমুখর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এমন স্মৃতিময় প্রায় ২৫ হাজার স্মারক নিয়ে যাত্রা করছে নতুন ভবনে নতুন করে শুরু করা জাতির গৌরবগাথার কথা বলা এ সংগ্রহশালা। বর্তমানে জাদুঘরটির নবযাত্রা শুরু করার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। আগামী ১৭ এপ্রিল থেকে আপামর মানুষের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে নবরূপ পাওয়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আর ১৬ এপ্রিল ইতিহাসের স্মারক নতুন ভবনটির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক ও আধুনিক মানদ-ের ভাবনায় নান্দনিকতার মিশেলে গড়া নতুন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে থাকছে চারটি স্থায়ী ও দু’টি অস্থায়ী গ্যালারি এবং সেমিনার কক্ষ। চার স্থায়ী গ্যালারিতে প্রদর্শিত হবে দেড় হাজার স্মারক। আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকা বাকি স্মারকগুলো পর্যায়ক্রমে প্রদর্শিত হবে একটি অস্থায়ী গ্যালারিতে। অপর আরেকটি অস্থায়ী গ্যালারিতে উপস্থাপিত হবে পৃথিবীর নানা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। পাশাপাশি এই গ্যালারিটিতে বিভিন্ন সময় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হবে। এছাড়া থাকবে ২৫০ আসনের একটি আধুনিক অডিটরিয়াম। যেখানে পরিবেশিত হবে সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাটক, আবৃত্তিসহ নানা রকম পারফর্মিং আর্ট। নবনির্মিত এ সংগ্রহশালায় নতুন প্রজন্মের জন্য থাকছে ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পেস, যেখানে নতুন মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ের আলাপ-আলোচনা হবে। দর্শনার্থীসহ সকলের জন্য থাকবে ক্যাফেটেরিয়া এবং সামনের খালি জায়গায় ওপেন এয়ার থিয়েটার। তেইশে মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুরে নতুন ভবনে কথা হয় জাদুঘরের ডিসপ্লে টিমের সমন্বয়ক ও আর্কিভিস্ট আমেনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘরের জন্য যেসব অনুষঙ্গ প্রয়োজন তার সব বৈশিষ্ট্য নিয়েই নির্মিত হয়েছে নতুন ভবনটি। ভবনের নির্মাণশৈলীর সঙ্গে স্মারক প্রদর্শনের বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, দর্শক যেন সহজেই একাত্ম হতে পারে। অনুভব করতে পারবে আত্মত্যাগে গড়া আপন জাতিসত্তার গৌরবময় জন্ম ইতিহাসকে। সেগুন বাগিচার ভবনটিতে স্থান সঙ্কটের কারণে দৃষ্টিননন্দন ও হৃদয়গ্রাহী করে স্মারক প্রদর্শনে প্রতিবন্ধকতা ছিল। আগারগাঁওয়ের ভবনে বিস্তৃত পরিসরের কারণে প্রতিটি স্মারকই ভিন্ন আঙ্গিকে নবরূপে প্রদর্শনের সুযোগ ঘটেছে। ২১ হাজার বর্গফুটের বড় পরিসরের চারটি স্থায়ী গ্যালারিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে প্রাধান্য দিয়ে ধাপে ধাপে বলা হয়েছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতির জন্মলাভের ইতিহাস। স্থায়ী গ্যালারিগুলোর উপস্থাপনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে আলোকচিত্র। সেই সঙ্গে প্রদর্শিত হবে মুক্তিযোদ্ধার লেখা রণাঙ্গনের ঘটনা প্রবাহিত ডায়েরি, মুক্তিযোদ্ধার লেখা চিঠি, রণাঙ্গনে ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত স্মৃতি স্মারক এবং সেই সময়ের পেপার কাটিং ও দালিলিক উপস্থাপনে স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য। একাত্তরে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টর ‘১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ’ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ প্রথমবারের মতো প্রদর্শন করা হবে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বা শরণার্থী সংক্রান্ত বেশ কিছু দুর্লভ দলিলও প্রদর্শিত হবে। দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতার অবয়বময় ব্রোঞ্জ নির্মিত ম্যুরাল। স্বাধীনতার ঘোষণাবিষয়ক জটিলতা দূর করে অডিওসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া থাকছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদের সচিত্র সংগ্রহ। তিনটি বেজমেন্ট ও পাঁচটি ফ্লোরে বিন্যস্ত আড়াই বিঘা জমির ওপর নির্মিত ভবনটির নকশা করেছেন স্থপতি দম্পতি তানজিম হাসান সেলিম ও নাহিদ ফারজানা। আট ট্রাস্টির উদ্যোগে সেগুনবাগিচার একটি ভবন ভাড়া নিয়ে ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। তাঁদের একজন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। নতুন ভবনে স্থানান্তরের প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ১৬ এপ্রিল সকালে আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন থেকেই আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনে পুরোপুরি কর্র্মকা- পরিচালনা করবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর ১৭ এপ্রিল থেকে জাদুঘর খুলে দেয়া হবে সর্বসাধারণের জন্য। জাদুঘরের নতুন ভবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই ভবন নির্মাণে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মডার্ন টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে দর্শনার্থীরা আরও বেশি একাত্ম হওয়ার সুযোগ পাবেন স্বজাতির ইতিহাসবিজড়িত স্মারকের সঙ্গে। স্মারক প্রদর্শনসহ সবক্ষেত্রেই একটি আন্তর্জাতিক জাদুঘরের মানদ- বজায় রাখা হয়েছে। চারটি স্থায়ী গ্যালারিতে স্মারকের উপস্থাপনা এবং দুটি অস্থায়ী গ্যালারির একটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের আর্ট গ্যালারির আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া তরুণ প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধসহ গঠনমূলক বিভিন্ন বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য থাকবে সেমিনার হলো ও ইন্টারঅ্যাকটিভ স্পেস। একটি আধুনিক মিলনায়তনে সঙ্গে থাকবে প্রজেকশন কক্ষ। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগের বাঙালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা বলবে, ‘আওয়ার হেরিটেজ‘ নামের চতুর্থ তলার প্রথম স্থায়ী গ্যালারিটি। ছবিসহ নানা নিদর্শনভিত্তিক তথ্যের মাধ্যমে উঠে আসবে ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির ইতিহাস। সেই সুবাদে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন ও সেই আন্দোলনে ইলা মিত্রের ভূমিকা, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ নানা বিষয়ক আলোকচিত্রসহ এবং তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে মেলে ধরা হবে। জানা যাবে মওলানা ভাসানীর কাগমারি আন্দোলনের কথা। জাতির পূর্বাপর ইতিহাস তুলে ধরা এই গ্যালারিতে স্মারকের চমৎকার উপস্থাপনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে প্রস্ফুটিত হবে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের সময় পর্যন্ত। এ প্রদর্শনালয়টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারাবাহিক সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস পৃথকভাবে ফুটিয়ে তোলা হবে। উঠে আসবে বাঙালির দীর্ঘকালের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জীবনের কথা। উপস্থাপিত হবে সেই সময়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তথ্য। দ্বিতীয় গ্যালারিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘আওয়ার রাইট’। এই প্রদর্শনালয়ে ছবি এবং তথ্যের ভিত্তিতে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর বাঙালীর ওপর নেমে আসা নির্মম নিপীড়ন ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি তুলে ধরা হবে প্রতিরোধের চিত্র। এখানে সবচেয়ে গুরুত্ব নিয়ে স্থান পেয়েছে অপারেশন সার্চলাইট নামে একাত্তরের ২৫ মার্চের কাল রাতের বিভীষিকার দৃশ্যপট। আলোকচিত্রের সঙ্গে আলো-আঁধারির সহযোগে একটি টানেলের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে পাকবাহিনীর বীভৎসতা। প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে এই গ্যালারিতে অবসান ঘটেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ক বিতর্কের। দ্য টাইমসসহ বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকার খবরে উঠে আসা স্বাধীনতার ঘোষণার তথ্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। দালিলিক প্রমাণের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা। তৃতীয় গ্যালারিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘আওয়ার ব্যাটেল’। এই গ্যালারিতে উপস্থাপিত হবে ১৯৭১ সালের মে থেকে নবেম্বরে খরস্রোতা সময়। সেই সূত্রে বাঙালীর সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ ও অংশগ্রহণ। উঠে এসেছে স্বভূমি থেকে বিতাড়িত শরণার্থী শিবিরের দুর্বিষহ জীবনের নানা দুর্লভ আলোকচিত্র। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীর বীরত্বগাথা প্রতিরোধ লড়াইয়ের পাশাপাশি এ গ্যালারিতে হানাদারদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের অপতৎপরতাও তুলে ধরা হবে। উঠে আসবে সেই সময়ে দেশের শিল্পী সমাজের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের পক্ষে থাকা আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা। চতুর্থ গ্যালারির নাম রাখা হয়েছে ‘আওয়ার ভিক্ট্রি’। এই গ্যালারিতে উপস্থাপিত হবে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়ের স্মৃতিবিজড়িত উপাখ্যান। সেই সুবাদে এখানে উঠে আসবে নৌ কমান্ডোদের অংশগ্রহণে অপারেশন জ্যাকপট ও বিলোনিয়া যুদ্ধের স্মৃতিসহ রণাঙ্গনের নানা তথ্যচিত্র। এ প্রদর্শনালয়টির একটি পৃথক অংশে তুলে ধরা হবে স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীর আত্মত্যাগের কথা। বাংলার নারীদের ওপর পাকবাহিনীর বীভৎস বর্বরতাকে তুলে ধরা হবে মর্মস্পর্শীভাবে। এখানে স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- নিয়ে থাকবে আলোকচিত্র ও তথ্যে সাজানো একটি পৃথক অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অংশগ্রহণের চিত্রসহ বর্ণনাত্মক তথ্য মিলবে এই গ্যালারিতে।
×