ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রতি পাসপোর্টে এক শ’ টাকা দেন’

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২০ মার্চ ২০১৭

‘প্রতি পাসপোর্টে এক শ’ টাকা  দেন’

তপন বিশ্বাস ॥ শুক্রবার দুপুর দেড়টা। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বেনাপোলে ভারত থেকে আসার পথে জিরোপয়েন্ট পার হতেই এক পুলিশ সদস্য পথ আটকাল। সরাসরিই বলল, আপনাদের পাসপোর্ট কয়টা? প্রতি পাসপোর্টে একশ’ করে টাকা দেন, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের ঝামেলা পোহাতে হবে না’। কেন টাকা দেব প্রশ্ন করতেই সে সরে গেল সামনে থেকে। তবে অর্থবোধক চাহনী তার। ভাবখানা এমন যে ‘সামনে গেলেই বুঝবেন’। সামনে এগোতেই সিভিলিয়ান একজন। ‘কয়টা পাসপোর্ট? প্রতি পাসপোর্টে দুইশ’ টাকা লাগবে। না হলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কয়েক ঘণ্টা’। দালালের দাবি পূরণ না করে সামনে এগিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েই বোঝা গেল কেন যাত্রীরা এদের টাকা দিতে বাধ্য হয়। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে নানা ভোগান্তি পোহানোর পরই পাওয়া গেল ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের ক্লিয়ারেন্স। ওসি ইমিগ্রেশনের সাহায্য চেয়েও কোন লাভ হয়নি। যারা টাকা দেবে না তাদের ইচ্ছে করেই এই চক্রটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখে। এমনিভাবে মাসের পর মাস চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হাজার যাত্রীকে। নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন যাত্রীরা অভিযোগ করেন, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মই বেনাপোল স্থলবন্দরের স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। একটি দালাল চক্রের নিজস্ব নিয়মে চলছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর। প্রশাসন বলতে কিছুই নেই। অর্থই ওখানে শেষ কথা। যারা অর্থ খরচ করতে পারবেন না তাদের ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনির্দিষ্টকাল। প্রকাশ্য দিবালোকে চলছে দালাল চক্রের এই অশুভ তৎপরতা। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও যোগ দিচ্ছে দালালদের সঙ্গে। দালাল-পুলিশের এই অশুভ তৎপরতায় প্রতিদিন চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শত শত যাত্রী। বিষয়টি যশোর পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এমন অভিযোগ আগেও আমরা পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। দোষী প্রমাণিত হলে তিনি যেই হোন শাস্তি পেতে হবে। সরজমিনে দেখা গেছে, বেনাপোল স্থলবন্দরে পুলিশ সরাসরি দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জিরোপয়েন্ট পার হলেই কোথাও পুলিশ আবার কোথাও দালাল চক্র যাত্রীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিতে চেষ্টা করে। নিরীহ প্রকৃতির যাত্রী অনেক ক্ষেত্রেই না বুঝে তাদের হাতে পাসপোর্ট দিয়ে পিছে পিছে ছোটে। পরে তাদের কাছ থেকে ইমিগ্রেশনের সিল মেরে দেয়ার কথা বলে দুইশ’-একশ’ যার কাছ থেকে যা পারে তা হাতিয়ে নেয়। এদের টাকা না দিলে তাদের হয়রানির শেষ থাকে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। স্থানীয়রা জানিয়েছে, দালাল চক্রের প্রধান আবুল কালম। তার নির্দেশেই চলে বেনাপোল বন্দর। তার সহযোগী ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজেই। এ কারণে তার কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয় না। একটু সামনে এগোতেই দেখা গেল, ভারত থেকে দেশে ফেরা যাত্রীদের দাঁড়ানো দীর্ঘ লাইন থেকে পুলিশ পাসপোর্টপ্রতি ৫০/১০০ টাকার বিনিময় ইমিগ্রেশন করিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তারা বলছে দীর্ঘ লাইন দেয়ার দরকার নেই। টাকা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেশন সেরে দেব। এভাবে লাইন থেকে বা জিরোপয়েন্ট থেকে আগত যাত্রীদের এনে লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের বাইপাস করে ইমিগ্রেশন সেরে বিদায় দিচ্ছে। আর যারা এদের ঘুষ দিতে রাজি হচ্ছে না তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীরা কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করলেও তারা মনগড়া নানান কথা বলে থাকে। কখনও বলছে ভিআইপি। কখনও বলছে এরা ঢাকার যাত্রী। কোন কোন ক্ষেত্রে মিলছে পুলিশের দুর্ব্যবহারও। শুক্রবার দুপুরে বেনাপোলে দালালের ভূমিকায় দেখা গেছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে নাজমুল, মেজবাহ, হান্নান, মুজিবর, মহিদুল, আঃ বারীসহ আরও কয়েকজনকে। পুলিশের পাশাপাশি কালামের নেতৃত্বে বেনাপোল বন্দরে রাজত্ব করছে ১২/১৪ জনের দালালচক্র। কালাম তার সহযোগীদের বিছিয়ে রেখেছে জিরোপয়েন্ট থেকে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত। সেখানে পুলিশের চেয়েও ক্ষমতাশালী এই কালাম বাহিনী। এমনকি ইমিগ্রেশন ফরমও নিতে হয় এদের কাছ থেকে। কমবেশি সকলকে তাদের কিছু না কিছু টাকা দিতে হয়। ১০ টাকার বিনিময়ে প্রতিটি ফরম পূরণও করে দেয় তারা। কালাম নিজে থাকে ইমিগ্রেশন অফিসারের পার্শ্বে। সে নিজে ফরমের ওপর পাসপোর্ট নম্বরটি লিখে ফরমে রেখে দেয়। তার নির্দেশে সিল মারে তারই এক সহযোগী। পুলিশ নীরবে বসে থাকে। শুক্রবার দেখা গেছে ইমিগ্রেশনের তিনটি কাউন্টারের মধ্যে দু’টি কাউন্টারে কোন লোক নেই। এতে যাত্রীদের লাইনও দীর্ঘ হচ্ছে। একটিতে পোশাকধারী এক পুলিশ বসে রয়েছে। আর তার পাশ্বে কালাম দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ফরমে লিখে দিচ্ছে। আর তার সহযোগী সিল মারছে। বাকি পুলিশ দালালির কাজে ব্যস্ত। যেখানে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ, সেখানে কালাম বাহিনী কীভাবে প্রবেশ করল এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি বেনাপোলের ওসি ইমিগ্রেশন ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, এখানে কোন বহিরাগত নেই। পুলিশ সদস্যদের দালালির কথা জিজ্ঞেস করলে ওসি ইমিগ্রেশন বলেন, কারা করছে নাম বলেন তো। নাম বলার পর তিনি বলেন, ঠিক আছে আমি দেখছি। তারপরও অবস্থার কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। ওসির ডান হাত এসআই খায়রুল। যাত্রীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন তিনি। পুলিশের এই দালালির বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার ওপর চড়াও হন তিনি। সম্প্রতি এমনই এক ঘটনার ছবি করতে গেলে এক ফটোসাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নেন তিনি। বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ যাত্রী এই বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে যাতায়াত করে। চরম অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের কারণে যাত্রীদের কাছে ক্রমান্বয়ে দুর্গম হয়ে উঠছে বন্দরটি। সরকারের অনেক সাফল্য থাকলেও কিছু পুলিশের এই হঠকারিতা মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। কেউ কেউ বলছে, পুলিশকে স্বাধীনতা দেয়ার কারণে কী তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে? অন্যান্য বন্দরের মতো বেনাপোল বন্দরেও রয়েছে ‘ডিউটি ফ্রি শপ’। অন্যান্য দ্রব্যের পাশাপাশি রয়েছে মদের দোকান। পাসপোর্ট ছাড়া এসব দোকানে কারও প্রবেশাধিকার থাকার কথা নয়। অথচ এই মদ বিক্রি হয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে। দেখার যেন কেউ নেই। বেনাপোলে অবস্থিত সরকারের সকল বিভাগই মিলেমিশে কাজ করছে। ফলে কোন অভিযোগই উর্ধতন কর্মকর্তার কানে পৌঁছায় না।
×