ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ত্র ও বিস্ফোরকের বড় অংশ আসছে স্থল পথে ভারত থেকে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৯ মার্চ ২০১৭

অস্ত্র ও বিস্ফোরকের বড় অংশ আসছে স্থল পথে ভারত থেকে

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশজুড়ে এখনও আত্মঘাতী বোমারু অর্থাৎ সুইসাইডাল স্কোয়াডের অনেক সদস্য তৎপর। এর আগে থেকে শনিবার পর্যন্ত সুইসাইডাল স্কোয়াডের ৩৫ সদস্য নিহত হয়েছে। জঙ্গীদের কাছে অস্ত্র, গ্রেনেড, বোমা ও বোমা তৈরির ধরনের সরঞ্জাম আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। অধিকাংশ আসছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিইউ) দায়িত্বশীল একটি সূত্রে এ তথ্য দিয়ে শনিবার জানানো হয়, আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে জঙ্গীসন্ত্রাস শুরু হয়েছে। ফলে দেশের বিভিন্ন কেপিআইয়ে (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) রেড এ্যালার্ট বলবৎ হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি পয়েন্টে এ ব্যবস্থা। ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পর চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরেও এ রেড এ্যালার্ট বলবৎ হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা কারাগার ঘিরে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অপরদিকে, চট্টগ্রামে পতেঙ্গার অয়েল বেল্ট, চট্টগ্রাম বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পুলিশী নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। চেকপোস্টগুলো সর্বক্ষণিক তৎপর রাখা হয়েছে। সাধারণ মানুষের চলাচলের যানবাহনে তল্লাশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর সিএনজিচালিত অটোরিক্সা র‌্যানডম তল্লাশির আওতায় আনা হয়েছে। সূত্র জানায়, জঙ্গীরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম স্থল সীমান্ত দিয়ে দেশে আনছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে জানানো হয়েছে কোন্ কোন্ পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম আসছে। গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই তথ্য দেয়া হয়েছে। এতে তালিকাও দেয়া হয়েছে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সীতাকু-ের দুটি জঙ্গী আস্তানা থেকে এক জঙ্গী দম্পতিকে গ্রেফতার এবং পরিচালিত ‘অপারেশন এ্যাসল্ট-১৬’ এ এক শিশু ও চার জঙ্গী নিহত হওয়ার পর শুক্রবার ঢাকায় র‌্যাব সদর দফতরের অভ্যন্তরে নির্মাণাধীন ব্যারাকে আত্মঘাতী বোমায় এক জঙ্গী প্রাণ হারায়। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শনিবার খিলগাঁওয়ে রেলের তল্লাশি চেকপোস্টে হামলা চালাতে গিয়ে আত্মঘাতী এক জঙ্গী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সিটিইউ সূত্রে জানানো হয়, ঢাকায় হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় লোমহর্ষক জঙ্গী সন্ত্রাসের ঘটনার পর দেশজুড়ে জঙ্গীবিরোধী অভিযান শুরু হলে আত্মরক্ষার্থে এরা আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থান নেয়। ইতোমধ্যে জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে বিশেষ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে মাঠে নেমেছে। যে কারণে কুমিল্লা, মিরসরাই, সীতাকু- এবং সর্বশেষ রাজধানী ঢাকায় পর পর দু’দিন দুই আত্মঘাতী জঙ্গীর অপতৎপরতা দৃশ্যমান। সরকার পক্ষে ইতোমধ্যে পুলিশের সোয়াত, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিইউ), পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স), সিআইডি (ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট), এসবি (সিকিউরিটি ব্রাঞ্চ), ডিবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ), সশস্ত্র ও নিরস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সব ধরনের সদস্যকে জঙ্গীবিরোধী তৎপরতায় নিয়োজিত করা হয়েছে। সূত্র জানায়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জামাদি মিয়ানমারের সীমান্ত পেরিয়ে আসছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা এবং তা নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার কাজে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। নগদ অর্থ ও নানা লোভলালসার ফাঁদে ফেলে এদের অনেকে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের সহযোগী হয়ে কাজ করছে। রাজধানী ঢাকায় কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী বলবৎ থাকার পরও গত দু’দিনে যে দুটি আত্মঘাতী জঙ্গীর পক্ষে সম্ভাব্য হামলার আগেই বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলই মৃত্যু হয়েছে। সূত্র মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে জঙ্গীদের নাশকতা সৃষ্টির একাধিক ছক রয়েছে। শনিবার সীতাকু-ের জঙ্গী আস্তানা পৌর এলাকার ছায়ানীড় ভবন থেকে জঙ্গীদের ছক আঁকা একটি কাগজ উদ্ধার হয়েছে। চিঠির বিস্তারিত তথ্য পুলিশ না জানালেও বলেছে, ওই কাগজে পুলিশকে টার্গেট করে হামলা চালানোর নির্দেশনা রয়েছে। যেহেতু এসব জঙ্গীর মধ্যে আত্মঘাতী বোমারু রয়েছে সেক্ষেত্রে ধরা পড়ার আগে পুলিশের ওপর উপর্যুপরি হামলা চালিয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টার নির্দেশনা রয়েছে। সীতাকু-ের ছায়ানীড় ভবনটি পুলিশ ঘিরে ফেরার পর আত্মঘাতী জঙ্গীরা অনুরূপ তৎপরতা চালিয়েছে। কিন্তু ‘অপারেশন এ্যাসল্ট-১৬’ এ সর্বশক্তি নিয়োগের ফলে সেখানে ৪ জঙ্গী ও এক শিশু প্রাণ হারিয়েছে। শনিবার ছায়ানীড় ভবনে জঙ্গী আস্তানার ফ্ল্যাট থেকে যেসব গ্রেনেড, বোমা, এসিড, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে তা পুলিশকে বিস্মিত করেছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মিরসরাই, সীতাকু- বেল্টে জঙ্গীদের একাধিক আস্তানা গাড়ার সন্দেহ রয়েছে। শুধু মিরসরাই, সীতাকু- নয়, তা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনী থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে। চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, বাঁশখালী, পটিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়ায়ও জঙ্গীদের ছোটবড় বিভিন্ন আস্তানা রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। পাশাপাশি কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতেও জঙ্গীদের অবাধ বিচরণ। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ নাম উল্লেখ করে স্বীকার করেছে, নব্য জেএমবির এ অঞ্চলের নেতৃত্ব দিচ্ছে মুছা নামের একজন। তার সঙ্গে রয়েছে আরও ১১ সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। এরা একদিকে যেমন সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ছক আঁটছে তেমনি বিভিন্নভাবে নতুন নতুন সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি করছে। সরকার ইতোমধ্যে যেসব জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সেসব সংগঠনের দুঃসাহসী সদস্যদের তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করা হচ্ছে। সীতাকু-ের দুটি আস্তানায় নিহত হয় ৪ জঙ্গী আত্মঘাতী। এছাড়া যে দম্পতি গ্রেফতার হয়েছে তারাও সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য বলে পুলিশ নিশ্চিত। কারণ, গ্রেফতার মহিলা আরজিনাকে ধরার পর তার শরীরে আত্মঘাতী বোমা বাঁধা ছিল। ছায়ানীড় ভবনের ফ্ল্যাটে নিহত মহিলার শরীরেও আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে তার শিশু-স্বামীও প্রাণ হারায়। বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে আভাস দেয়া হয়েছে, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ে নির্বাচনী আভাস মিলেছে। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বিভিন্ন জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট দেয়ার জন্যও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। এ অবস্থায় জঙ্গী সংগঠনগুলো আকস্মিকভাবে মাঠে নেমে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার কাজে লিপ্ত। এদের গোপনে উৎসাহ যোগাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত শিবির ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠন। দেশের বিভিন্নস্থানে ইতোমধ্যে যেসব জঙ্গী সদস্য ধরা পড়েছে তাদের অনেকেই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল বলেও একাধিক তথ্য মিলেছে। সূত্রে জানানো হয়, তাদের আশঙ্কা, আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত জঙ্গী সন্ত্রাসীরা বিভিন্নভাবে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে সহিংসতা ঘটানোর ক্রমাগত চেষ্টা চালাবে। এক্ষেত্রে অস্ত্র, বোমা, গোলাবারুদ ও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম আসার রুটে নজরদারি আরও বাড়ানো বাঞ্ছনীয়। কেননা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকদ্রব্য ছাড়া সহিংসতা সৃষ্টির কোন পথ নেই।
×