ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও চাঁদাবাজি মূল কারণ ॥ জামুকা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অভিযোগের পাহাড়

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম ভেস্তে যেতে বসেছে!

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম ভেস্তে যেতে বসেছে!

আরাফাত মুন্না ॥ দুই বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হলেও নানা জটিলতায় তা ভেস্তে যেতে বসেছে। যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন ও আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে অভিযোগের পাহাড় জমেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। এসব অভিযোগে যাচাই-বাছাই কমিটিগুলো দফায় দফায় সংশোধন করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় এসব জটিলতার পেছনে প্রধানত দুই কারণ খুঁজে পেয়েছে জনকণ্ঠ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রথমত যাচাই-বাছাই কমিটি নিয়ে যত অভিযোগ পড়েছে, এর মূলে রয়েছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদগুলোর নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ। এর ফলে এক পক্ষের কাউকে কমিটিতে রাখা হলে অন্যপক্ষ ওই ব্যক্তিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে অভিযোগ দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে যত অভিযোগ পড়ছে, এর মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে জামুকায় অভিযোগ দাখিল করে আবার তার কাছেই চাঁদা দাবি করছে অভিযোগকারী। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। এরই মধ্যে শতাধিক উপজেলায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে দাবি করেছেন, যাচাই-বাছাই কমিটির ওই সদস্যদের সত্যিকার পরিচয় যাচাই-বাছাই করা উচিত। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সাধারণ মানুষকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তুলে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। সারা দেশ থেকে এত অভিযোগ কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে জামুকার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে কিছু কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও অধিকাংশ অভিযোগেরই কোন ভিত্তি নেই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দের বিরোধের কারণেই অনেক অভিযোগ আসে। প্রতিটি সংসদেই একাধিক গ্রুপ রয়েছে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতেই থাকেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এছাড়া যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে আরও বেশ কিছু সমস্যা উঠে এসেছে অনুসন্ধানে এর মধ্যে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ, মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর করা, বিসিএস মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের বাছাই প্রক্রিয়ার বাইরে না রাখা এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্থানীয়ভাবে যাচাই-বাছাই কমিটিতে অমুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তি। জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নতুন প্রক্রিয়া শুরুর আগে ২০১৬ সালের ৬ নবেম্বর একটি গেজেট প্রকাশ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘১৩ বছর বয়সী কোন ব্যক্তি যে বা যারা ভারতে প্রবেশ করে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যারা জনমত সংঘটিত করেছেন, যারা মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। এ ছাড়া যেসব ব্যক্তির নাম ‘লাল মুক্তিবার্তা’য় এবং ভারতীয় তালিকায় রয়েছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃত এবং এসব তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের আর নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের দরকার হবে না।’ অর্থাৎ তাদেরকে যাচাই-বাছাইয়ের বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৩ সালে যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে (বিসিএস মুক্তিযোদ্ধা অফিসার) পিএসসির সুপারিশে নিয়োগ করা হয়েছিল তাদেরকে যাচাই-বাছাইয়ের বাইরে রাখা হয়নি। ১৯৭২ সালের ২৩ জুন শিক্ষানবিস কর্মকর্তা পদে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের জন্য ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। বয়সসীমা ধরা হয়েছিল ২১ থেকে ৩০ বছর। যেসব মুক্তিযোদ্ধা এই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন তাদেরকে চাকরিতে নিয়োগ করা হয়। এখন এসব মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্ন তারা বঙ্গবন্ধুর সময়েই দালিলিক প্রমাণ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এখন আবার কী জন্য তাদেরকে যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আনা হচ্ছে? বিষয়টি নিয়ে তারা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা), মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেও কোন ফল পাননি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হলেও তা আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয়। পরে বাধ্য হয়ে তারা হাইকোর্টে রিট করেছেন এবং হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাই স্থগিত করে দিয়েছে। আবার মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১৩ বছর নির্ধারণের বিষয়েও আদালতে মামলা হয়েছে। আদালত এই রকম বয়স নির্ধারণ কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবে না সে বিষয়ে রুল জারি করেছে। এছাড়া যশোরের কেশবপুর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা পৃথক দুটি মামলায় হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিও স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। অভিযোগ দিয়ে চাঁদা দাবি ॥ ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬৬ মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী বরাবরে পাঠানো এক অভিযোগে দাবি করেছেন, যাচাই-বাছাই থেকে নাম বাদ দিতে আলতাফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি তাদেরসহ প্রায় পৌনে দুইশত মুক্তিযোদ্ধার নামে অভিযোগ দাখিল করেছেন। তারা আরও দাবি করেন, ওই আলতাফ হোসেন অভিযোগ তুলে নিতে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করেন। লিখিত অভিযোগে ওই মুক্তিযোদ্ধারা দাবি করেন, আলতাফ হোসেন দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে এলাকায় এসে ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকা- শুরু করে, যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। এই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন মাস্টারকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রীর কাছে পাঠানো আবেদনে ওই ৬৬ মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিবার্তার নম্বরও উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে সোনারগাঁও থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ওসমান গনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে মোবাইলে জানান, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়দানকারী আলতাফ হোসেন সোনরাগাঁওয়ের পৌনে দুইশত জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করেছেন। আলতাফ হোসেন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন আবার তাদের কাছেই চাঁদা দাবি করেছেন অভিযোগ তুলে নিতে। মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের জন্য আলতাফের বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন এই ডেপুটি কমান্ডার। সোয়া লাখ আবেদন ॥ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অনলাইনে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৫৪টি এবং সরাসরি ১০ হাজার ৯০০টি আবেদন জমা হয়েছে। এ ছাড়াও আবেদনে উপজেলা বা জেলার নাম উল্লেখ করা হয়নি, এমন আবেদন পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৫৫৩টি। তাদের সবাইকে যাছাই-বাছাইয়ের জন্য ডাকা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত তালিকার বাইরের সব মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেটধারীকেও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ডাকা হয়েছে। এর সংখ্যাও ৫৫ হাজার। তাদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। জানা গেছে, হাইকোর্টে একটি রিটের কারণে প্রায় দুই বছর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্তি আবেদন যাচাই-বাছাই বন্ধ রাখা হয়েছিল। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে ওই রিট নিষ্পত্তি হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা যাছাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ জন্য মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নির্দেশিকা ও প্রশ্নমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনসহ সনদ যাচাই-বাছাই করা হবে। নির্দেশিকা অনুসারে যাচাই-বাছাইয়ের পর কমিটি তিন ধরনের তালিকা প্রস্তুত করবে। আর মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে একাত্তরের ২৬ মার্চ ন্যূনতম ১৩ বছর বয়স হতে হবে। যারা বাদ পড়বেন তারা চাইলে কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জামুকায় আপীল করতে পারবেন। এ ছাড়া ১১টি প্রশ্নের মাধ্যমে যাচাইয়ের সময় কমিটি আবেদনকারীর মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ধরনের তথ্য জানতে চাইবেন। এর আলোকেই কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার শেষ হচ্ছে এই যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম।
×