ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৪ বছরের মেয়েকে নিয়ে ক্রিস ও লিন্ডা দম্পতি কানাডায় সুখে আছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

১৪ বছরের মেয়েকে নিয়ে ক্রিস ও লিন্ডা দম্পতি কানাডায় সুখে আছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর পুরনো ঢাকায় অবস্থিত মাদার তেরেসা হোম বা মিশনারিজ অব চ্যারিটির অনাথ আশ্রম। ‘শিশু ভবন’ নামেও এর পরিচিতি অছে। লোকে বলে অনাথ আশ্রম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এমনকি পরবর্তী সময়েও এই আশ্রমকে ঘিরে রয়েছে অজানা এক ইতিহাস। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এমনকি তাদের দেশীয় দোসরদের হাতে নিগৃহীত বীরাঙ্গনা নারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের সময়কার একটি অবিদিত ইতিহাস রয়েই গেছে। তা হলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর দেশীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের দোসরদের হাতে ধর্ষিত এমনকি গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন অসংখ্য মুক্তিকামী নারী। তাদের অনেককেই ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন। এসব মায়ের জন্ম দেয়া সন্তানদের বলা হয় যুদ্ধশিশু। কিন্তু এই শিশুরা কোথায়। কোথায় বা তাদের জন্ম হয়েছিল। অনেক যুদ্ধশিশুর জন্মের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই ‘মাদার তেরেসা শিশু ভবন’। সামাজিক কারণে অনেক নারী পিতৃপরিচয়হীন শিশু নিয়ে স্বামী বা বাবার পরিবারে ফিরতে পারেননি। কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন। যারা ফিরেছিলেন তাদের অনেকের লাঞ্ছনার শেষ ছিল না। স্বামী পরিত্যক্তা হতে হয়েছে অনেককেই। তখন গর্ভবতী নারীদের ঠিকানা ছিল এই শিশু ভবন। যেখানে নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সন্তান জন্ম দিয়ে মায়েরা চলে যেতেন। অনেকেই গোপনে সন্তানের জন্মের পর এখানে রেখে যান। সিস্টারদের হাতে লালন পালন হতো অপুষ্টির শিকার এসব শিশু। পছন্দমতো নাম রাখতেন তারাই। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও অধিক সংখ্যক দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক নথিপত্র ও দলিল এখনও সংরক্ষিত রয়েছে মাদার তেরেসা হোমে। বাবা-মায়ের নাম ঠিকানা না থাকলেও জন্ম তারিখ ও শিশু ভবনে আসার বৃত্তান্ত সংরক্ষিত আছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, অক্টোবর ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধশিশুদের জন্ম হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই যুদ্ধশিশুদের একটি অংশ কানাডার উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। একমাত্র দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় ১৫ যুদ্ধশিশুর ছবি ছাপা হয়েছিল। তাদের নিতে আসেন কানাডার মানবিক চৌদ্দটি পরিবারের সদস্যরা। সরকারী উদ্যোগে ১৫ যুদ্ধ শিশুকে সেদেশে দত্তক বাবা-মায়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক দুর্লভ প্রমাণের দলিল সরকারের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছিল মাদার তেরেসাকে তার ঢাকার মিশনারিজ অব চ্যারিটির ঠিকানায়। যে তালিকা এখনও কানাডীয় জাতীয় আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার কাজে নিয়োজিত কানাডীয় ডাক্তার ডাঃ ডেভিসের মতে, একাত্তরে সেনা আক্রমণ ও দখলদারিত্বের পর প্রায় চার লাখ নারীর সঙ্গে বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছিল। এমন বাস্তবতায় কমপক্ষে দুই লাখ নারীর গর্ভধারণকে বেশ কম করেই হিসাব করা হয়। যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে দুই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার বলা হয়েছে। কানাডায় নেয়া যুদ্ধ শিশুরা এখন দত্তক বাবা-মায়ের কাছে পরম মমতায় বড় হয়েছেন। তাদের জন্মের করুণ ইতিহাস আছে। এতে অনেকেই পেছনের দিতে দৃষ্টি দিতে চান না। এগিয়ে যেতে চান সামনের দিকে। তাদের কেউ বিয়ে করেছেন। কেউবা এখনও অবিবাহিত। ১৫ জনের মধ্যে জন্ম সনদের জটিলতায় একজন ৪৫ বছরেও দেশটির নাগরিকত্ব পাননি। বাবা-মায়ের ঠিকানা না থাকলেও কেউ কেউ জন্মভূমি দেখে গেছেন। চেষ্টা করেছেন গর্ভধারিণী মায়ের খোঁজ করার। ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন আবারও দত্তক নেয়া বাবা-মায়ের ঠিকানায়। কানাডায় ১৫ যুদ্ধশিশুর দত্তক গ্রহণকারী বাবা-মায়ের খোঁজ করে ১২ জনের দেখা পেয়েছেন এক প্রবাসী লেখক। তাদের মধ্যে এক দম্পতি দুটি শিশু দত্তক নিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে ১৪ যুদ্ধশিশু ও তাদের পরিবারের খোঁজ রয়েছে কানাডায়। জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বোর্ড (ন্যাশনাল বোর্ড অব বাংলাদেশ উইমেন্স রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম) স্থাপন করেন। এ বোর্ডের কাজ ছিল ধর্ষণের শিকার ও অন্যান্য অসুবিধাগ্রস্ত নারীর দেখাশোনা করা। বোর্ডের আরেকটি কাজের মধ্যে ছিল, মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত নারী পাকিস্তানী সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত ও নিগৃহীত হন তাদের একটি তালিকা তৈরি করা। একজন ওমরের গল্প ॥ মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল পৃথিবী আলো করে জন্ম নেয় এক শিশু। পিতৃ পরিচয়হীন শিশুটির পুরনো ঢাকার মাদার তেরেসা শিশু ভবনে জন্ম হয়। জন্মের সময় তাঁর ওজন হয়েছিল আড়াই কেজি। অপুষ্টির শিকার শিশুটি খুবই দুর্বল ছিল। আপনজন বলতে কেউ নেই। সামাজিক বাস্তবতার কারণে মা তো শুধু জন্ম দিয়েছেন মাত্র। শিশু সদনের যারা লালন পালন করতেন তাদের সবারই মনে হয়েছিল হয়ত শিশুটি বাঁচবে না। তবুও আশা ছাড়েননি দূরের স্বজনরা। তারা নবজাতকটিকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত সফল হন। জন্মের পর শিশুটিকে বিদেশে দত্তক নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কানাডীয় ডাক্তাররা শিশুটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর দত্তক নেয়ার জন্য বাছাই করেছিলেন। আড়াই মাস বয়সে বাংলাদেশের ভূখ- ছেড়ে কানাডাতে নিয়ে যাওয়া হয় এই শিশুটিকে। তখন তার ওজন হয়েছিল দুই কেজি ৭০০গ্রাম। ছয় সপ্তাহে ওজন বেড়েছিল মাত্র ২০০ গ্রাম। এরপর ভিন্ন দেশে দত্তক নেয়া পরিবারের কাছে শিশুটির বেড়ে ওঠা। আরেকটি নতুন ইতিহাসের জন্ম। সেই ছোট্ট শিশুটি বয়স পেরিয়ে যুবক। এখন পরিণত বয়স পাড়ি দিয়ে ৪৫ বছরে পা রেখেছেন যুদ্ধ শিশু ‘ওমর’। মাদার তেরেসা ভবনে জন্মের সময় রেজিস্টার খাতায় এ নাম লেখা ছিল। পেছনে ফিরতে চান না ওমর ॥ তাঁর জন্মের পেছনে যে একটি করুণ ইতিহাস রয়েছে এ নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই ওমরের। প্রবাসী লেখক মুস্তাফা চৌধুরী এমন ১৪ যুদ্ধ শিশু নিয়ে লিখেছেন ‘৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস’ নামক গ্রস্থ। এতে বলা হয়েছে, ওমরকে বাংলাদেশ থেকে কানাডা নেয়ার সময় দত্তক নেয়া বাবা-মা ‘ক্রিস্টোফার ওমর বুনস্ট্রা’ নামে নতুন করে তার নামকরণ করেন। জীবনের দীর্ঘ সময়েও প্রকৃত-বাবা মায়ের জন্য ওমরের মন কাঁদে না। যদিও যুদ্ধ শিশু নিয়ে তার আগ্রহ রয়েছে। ১৯৭২ সালের পর ২০১০ সালের বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। তখনও মাকে খুঁজে বের করার বিষয়ে তিনি কোন আগ্রহ দেখাননি। বইতে মিশনারিজ অব চ্যারিটির সুপিরিয়র সিস্টার মেরি তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘গর্ভবতী মাকে তার গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা করা যাবে না। ধর্ষণের শিকার নারী তার অবমাননা বিষয়ে কিছুই বলবেন না। বা তাকে বলতে বাধ্য করানোর চেষ্টা করাও যাবে না। এধরণের নিশ্চয়তা দানের জন্য সন্তান সম্ভবারা অনেক স্বস্তিবোধ করেন। এবং গর্ভমোচনের পরিবর্তে সন্তান প্রসবের সিদ্ধান্ত নেন।’ ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে ওমরকে দত্তক নেয়া বুনস্ট্রা পরিবার কিউবেকের স্কটটাউনে জায়গা বদল করেন। পরিবারের অন্য ছেলেমেয়েদের ইংরেজী স্কুলে পড়ানো হতো। বাস্তবতা হলো ক্রিসের জন্ম সনদপত্র বলতে পাকা কোন কাগজপত্র ছিল না। এমনকি তার জন্মদাত্রী ও জন্মদাতা মা-বাবার নাম, তাদের নাগরিকত্ব ও মাতৃভাষা সম্পর্কে কোন তথ্যই ছিল না বুনস্ট্রা দম্পত্তির হাতে। মূলত ঢাকার মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার মার্গারেট মেরির স্বাক্ষরিত কাগজের ওপর ভরসা করেই বিমানযোগে ওমরকে কানাডায় নিয়ে আসা হয়েছিল। এই হিসেবে ওমরের পিতা-মাতা বুনস্ট্রা দম্পতি। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে এটি সন্তানের প্রকৃত পরিচয় বলে বিবেচিত হয়নি। তাই বিকল্প হিসেবে ক্রিসকে একটি ফরাসী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করা হয়। যদিও তার দত্তক নেয়া পিতা-মাতা ইংরেজীভাষী। ছেলের ভর্তি নিয়ে দারুণভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। এজন্য খুবই ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট ছিলেন ওমরের বাবা-মা। স্কুল জীবনের কথা ॥ ওমরের স্কুল জীবনের গল্প বলতে গিয়ে দত্তক নেয়া পিতা-মাতা জানান, ক্রিসের কোন দিনই ফরাসী ভাষা শেখা হয়নি। বুনস্ট্রাদের সাত ছেলেমেয়ের জন্য কেবলমাত্র ক্রিসকেই এরকম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হলো ওর জন্মসনদ না থাকা। অথচ ক্রিস পুরোপুরি ঘটনাচক্রের শিকার। স্কুল জীবনে বারবার এরকম নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে ওমরকে। বেগ পেতে হয়েছে বাবা-মাসহ গোটা পরিবারের সদস্যদের। তার বাবা-মা জানান, স্কুলে পড়াতে গিয়ে ওমরের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়েছে। বয়সের তুলনায় সে ছিল খুবই রোগা। স্কুলে সে দর্শনীয় তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। মাঝে মাঝে স্কুলের ডেস্কের নিচে লুকিয়ে থেকে সময় পার করে দিত। পারিবারিক কারণে ইংরেজী ভাষা শিখে ক্রিস। ফরাসী স্কুলে পড়লেও সে কখনই ফরাসী ভাষা রপ্ত করতে পারেনি। এক বছর স্কুল জীবন নষ্ট হয় তার। এক সময় ক্রিস তার বাবা-মাকে জানান, পড়াশোনা আর ভাল লাগছে না। কিন্তু আগ্রহ না থাকলেও তাকে স্কুলে পড়তে হয়েছে। এডমন্টনে ইস্টউড কমিউনিটি স্কুলে গ্রেড-৬ থেকে গ্রেড-৮ শেষ করতে গেল। তারপর তাকে ভিক্টোরিয়া কম্পোজিট হাইস্কুলে ফাইনাল হাইস্কুল ডিপ্লোমার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও স্কুলের পরিবেশ তার ভাল লাগেনি। ক্রিস স্কুল ছেড়ে দেন। এতে বুনস্ট্রা পরিবার আশাহত হয়েছিলেন। বিয়ের কথা ॥ বইয়ের লেখকের কাছে যুদ্ধশিশু ক্রিস নিজেই জানান, পড়াশোনায় মন না বসায় টুকটাক কাজ শুরু করেন তিনি। প্রথমে কিছুদিনের জন্য এডমন্ড শহরে বুলউস্কল ফ্যামিলি ফুড, বনি ডুন শপিং সেন্টার সহ নানা রেস্তরাঁয় কাজ করেন। ১৯৮৮ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত এসব কাজ করেছেন তিনি। কাজ করতে গিয়ে এক সময় ব্যবসা ও চাকরি জীবনের কৌশল আয়ত্ত হয়ে যায় তার। ১৯৯৬ সালে তিনি সহকারী বাবুর্চি হিসেবে নিযুক্ত হন গ্রেসফিল্ড ক্যাম্প এবং কনফারেন্স সেন্টারে। যার পরিচালক ও মালিক ক্রিসকে বিশেষ পছন্দ করতেন। এ কাজটি তার জীবনের গতিপথ আরেকটু বদলে দেয়। দেয় নতুন জীবনের নতুন এক অভিজ্ঞতা। এ ক্যাম্পে ক্রিস, ক্যাম্প পরিচালকের কন্যা লিন্ডা হার্বারটের সঙ্গে পরিচিত হন। এখানেই তিনি হবু স্ত্রী লিন্ডার সঙ্গে রোমান্স ও ভালবাসার পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায় পার হয়। লিন্ডার মার বাড়ি আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে এবং বাবার বাড়ি ইংল্যান্ডে। বহুদিন তারা কানাডায়। ১৯৯৭ সালে ক্রিসের বাগদান হয়। ১৯৯৯ সালে বড় পার্টির পরিকল্পনা হয়। ক্রিস বিবাহিত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। পেছনের বছরগুলোর দিকে তাকিয়ে ক্রিসের দত্তক বাবা টনি বলেন, তার ছেলের বিয়ের দিনটি পরিবারের সবার জন্য উত্তেজনাকর ছিল। অল্পদিনের মধ্যে গ্রেসফিল্ড ক্যাম্পে ক্রিস হেড বাবুর্চির পদে পদোন্নতি পান। বেড়ে যায় দায়িত্ব। ১৯৯৭-৯৮ সালে খুব বেশি কর্মব্যস্ত থাকায় বাবা-মাকে দেখতে যাওয়া হয়নি। এমন ভাবনা চিন্তা করে ক্রিস তার পছন্দের চাকরি ছেড়ে দেন। এরমধ্যেই ১৯৯৯ সালের ক্রিসের বিয়ে হয় জাকজমকভাবেই। বাবা টনি নিজেই ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ক্রিসের কাছে কোন দিন মনে হয়নি সে দত্তক বাবা-মায়ের কাছে বেড়ে উঠছেন। তার কাছে ওই পরিবারটিই ছিল নিজের। আপনজন। স্নেহ-মায়া মমতায় বড় হয়েছে বাংলাদেশের ওমর। অনেক ভাই বোনের মধ্যে কখনও আদরে-যতেœ বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি তাকে। ভালবাসার কোন কমতিই ছিল না তার জীবনে। তাই পেছনের কষ্টের অতীত জানতে কখনই তাকে আগ্রহী করে তোলেনি। খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন ক্রিস। জীবন চলায় নানা প্রতিবন্ধকতা এসেছে। কখনই হতাশ হননি। তিনি বিশ্বাস করেন আলো আসবেই। তাই যখন মন খারাপ হতো তখন গান গাইতেন। ছোট বেলা থেকেই গানের প্রতি তার বাড়তি ঝোঁক ছিল। জীবনের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ নেই ক্রিসের ॥ ১৯৭২ থেকে ১৯৯৯ সাল। দীর্ঘ ২৮ বছর কানাডাতে ক্রিসের চলা। দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে নিজের জীবনবৃত্তান্ত ও পরিবার সম্পর্কে তিনি কোন আগ্রহ দেখাননি। কোন কুণ্ঠাবোধ না করে বলেন, অনুপস্থিত বাবা-মা সম্পর্কে তার কোন আগ্রহ নেই। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লেখকের কাছে বলেন, প্রাপ্ত বয়স হবার পর বাবা-মায়ের কাছে শুনেছিল তা জন্মদাত্রী মা এবং তার অনুমিত বাবা স্পর্কে কোন নথিপত্র বাংলাদেশে বা কানাডার কোথাও নেই। ক্রিস এ সত্যকে গ্রহণ করে মনে করেন জন্ম সংক্রান্ত সকল অনুসন্ধান তার বৃথা হবে। একারণে তিনি বিষয়টির প্রতি তেমন আর আগ্রহ দেখাননি। এক ধরনের চাপা অভিমান ছিল জন্মদাতা বাবা-মায়ের প্রতি। তাই তিনি মনে করেন, যে মা তাকে জন্মকালে পরিত্যাগ করেছিলেন তার সম্পর্কে কিছু জানতে চান না। জন্মস্থান বাংলাদেশ সম্পর্কেও ক্রিস আগ্রহের অভাব বিষয়ে কিছু বলেননি। কানাডাতে সবচেয়ে অশান্তির বিষয়টি ছিল তার প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে যা তার সাথের অন্য যুদ্ধশিশুদের বেলায় ঘটেনি। এখনও নাগরিকত্ব পাননি ক্রিস ॥ জন্ম সনদ নিয়ে বছরের পর বছর জটিলতায় ভুগতে হয়েছে ক্রিসকে। এজন্য তার বাবা-মাকে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে। ক্রিসের বেলায় কিছু অভিবাসন কর্মকর্তা জন্ম সনদপত্রে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ক্রিসের নাগরিকত্বের জন্য জমা দেয়া কাগজপত্র ফেরত দেয়া হয়েছিল। এ কারণে ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়ের কাছে তার বাংলাদেশী জন্ম সনদপত্র গ্রহণযোগ্য ছিল না, নাগরিকত্ব বিবেচনার জন্য। বুনস্ট্রা পরিবার অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন যখন কানাডার নাগরিকত্ব ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ক্রিসের কাগজপত্র ফিরিয়ে দিয়েছিল নথিপত্রের অভাবে। এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, আজও ক্রিস কানাডীয় নাগরিকত্ব পাননি। যদিও ৪০ বছরের বেশি সময় তিনি সে দেশে বসবাস করছেন। জীবনে এত কিছুর পরও আনন্দে থাকেন ক্রিস। বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি। তিনি মনে করেন, আজ যেখানে পৌঁছেছেন তিনি এর পেছনে পুরো অবদান পালক বাবা-মায়ের। তিনি কখনই অনুভব করেন না তার জন্মদাত্রী মাও জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে যা জানা আছে এরচেয়ে বেশি কিছু জানার প্রয়োজন আছে। নিজেকে একজন ভাগ্যবান মানুষ মনে করেন তিনি। একারণেই হয়ত এমন যতœশীল দত্তক গ্রহণকারী বাবা-মায়ের কাছে আশ্রয় হয়েছিল। ক্রিস ভাল করেই জানেন, জাতিগত বিচারে তিনি কানাডীয় শ্বেতকায় বাবা-মা থেকে আলাদা। বাংলাদেশে অচেনা বাবার ঔরসে বাঙালী মায়ের গর্ভে তার জন্ম। কিন্তু এ সত্য তাকে তার কানাডীয় বাবা-মা, ভাই-বোন থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজন এমনকি বাড়ি থেকে পৃথক করে দিতে পারেনি। তাই ফেলে আসা অতীত, এক নিষ্ঠুর জন্মের ইতিহাস ও বাস্তবতা তাকে কখনও কষ্ট দেয় না। স্কুল জীবনের কষ্টের ইতিহাস, নাগরিকত্বের হয়রানিও তিনি এখন ভুলে গেছেন। তাদের ১৪ বছরের মেয়ে ক্রিসচিয়ানকে নিয়ে ক্রিস ও লিন্ডা এখন সুখেই আছেন। ক্রিস এখন অটোয়ায় ব্রিজহেড-চকচকে উঁচুশ্রেণীয় কফি শপে কর্মরত। স্ত্রী লিন্ডা ডাউন টাউনে স্থানীয় একটি ব্যাংকে কাজ করেন। বাংলাদেশের ওমর এখন ক্রিস হয়ে সুখী দম্পতি এখন কানাডার। ওমরের বাবা-মায়ের পরিচয় ॥ ওমরের পালক বাবা টনি ছিলেন হল্যান্ডের অধিবাসী। আট বছর বয়সে তিনি কানাডায় পাড়ি জমান। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় বড় হন। তার স্ত্রী বনি আমেরিকার মিশিগানের গ্র্যান্ড র‌্যাপিড অঞ্চলের মেয়ে। টনি যখন গ্র্যান্ড র‌্যাপিডসের ক্যাভলিন কলেজে আন্ডারগ্রাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র, তখন বনির সঙ্গে পরিচয়। এরপর বিয়ে। ১৯৬৭ সালে টনি অন্টেরিও এলমার শহরে শিক্ষকতায় আসার সময় এ দম্পতির ঘরে ছিল একমাত্র শিশু সন্তান এন্টনি উইলিয়াম। এই দম্পতি আরও সন্তানের আশা করেন। তাদের দ্বিতীয় সন্তান সাত মাস বয়সে মারা যায়। সমাজকর্মে যুক্ত থাকায় এক সময়ে এই দম্পতি একটি মেয়েকে দত্তক নেন। এক পর্যায়ে এই দম্পতি তিন সন্তানকে দত্তক গ্রহণ করেন। এক সময়ে তাদের মাথায় বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশু দত্তক নেয়ার পরিকল্পনা আসে। এরপর ১৯৭২ সালে ওমরকে দত্তক গ্রহণের সময় এই দম্পতি অনেক স্বস্তি পেয়েছিলেন। নিজের ও দত্তক সন্তানসহ বুনস্ট্রা পরিবারে এখন ৯ নাতি-নাতনি। ২০১০ সালে বনি তার দত্তক নেয়া ছেলে ক্রিসকে নিয়ে বাংলাদেশে আয়োজিত একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সন্তানের জন্য লালায়িত ছিল বুনস্ট্রাদের পরিবার। এখন শ্যাশটনের বাড়িতে কেউ নেই। ফাঁকা। শুধু ওই দম্পতি থাকেন। ‘৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক মুস্তফা চৌধুরী জানান, পুরো বইটিতে রয়েছে আটটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : মুক্তিযুদ্ধ, বলাৎকার, ফলাফল এবং যুদ্ধশিশুর জন্ম। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে, ‘বাংলাদেশ ও কানাডাতে অনাথ শিশুর দত্তক নেয়ার প্রচলিত প্রথা। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে, ‘বাঙলাদেশ কানাডা দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ : বাগাড়ম্বর পেরিয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ’। চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে কানাডা : যুদ্ধশিশুর দুঃসাহসিক অভিযান’। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে, দত্তকগ্রাহী বাবা-মা এবং যুদ্ধশিশু : একটি আভরণচিত্র’। ষষ্ঠ অধ্যায়ে রয়েছে, দত্তগ্রাহী বাবা-মার আনন্দ-বেদনা। সপ্তম অধ্যায়ে রয়েছে, কানাডাতে বেড়ে ওঠা যুদ্ধশিশু। অষ্টম অধ্যায়ে রয়েছে, উপসংহার : উদযাপনযোগ্য উপলক্ষ। এছাড়াও রয়েছে প্রমাণাদি ও ফটো গ্যালারি। বইটি প্রকাশ করেছে, একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরী। লেখক জানান, একুশের বই মেলার ৪৭১/৭২ নম্বর স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
×