ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ দারুণ কিছু হয়ে যাবে এবারের মেলায়। খুব গোছালো আর পরিপাটি মেলা উপহার দেবে বাংলা একাডেমি। এমন কথা প্রতিবারই শোনানো হয়। এবারও শোনানো হয়েছিল। আর তার পর শুরু হলো মেলা। বৃহস্পতিবার ছিল দ্বিতীয় দিন। কিন্তু সব দেখে চোখ তো কপালে! দ্বিতীয় দিনের এই হচ্ছে চেহারা? ভেতরে-বাইরে সবখানেই প্রস্তুতি পর্ব। যেন মেলা শুরুর এখনও কয়েক দিন বাকি আছে। হ্যাঁ, অমর একুশে গ্রন্থমেলার কথাই হোক। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা ব্যস্ত এখন এই আয়োজন নিয়ে। বৃহস্পতিবার মেলা ঘুরে অবাকই হতে হয়। দ্বিতীয় দিন। অথচ মেলা শুরুর আগের চেহারা! প্রতিবছর টিএসসি ও দোয়েল চত্বর অংশে দুটি বিশাল তোরণ নির্মাণ করা হয়। দূর থেকে সেগুলো দেখা যায়। উৎসবের বার্তা দেয় তোরণ দুটি। যেন হাত ধরে মেলায় নিয়ে যায়। এবার সেই তোরণের দেখা মেলে না কোথাও। টিএসসি দিয়ে প্রবেশের সময় দেখা গেল, রাস্তার দু’পাশে এবং মাঝখানের সড়কদ্বীপে কিম্ভূতকিমাকার তিনটি স্থাপনা। বাজার থেকে কয়েকটি প্লাইউড কিনে পেরেক মেরে দেয়া হয়েছে যেন। এগুলো শিল্পবোধ ও রুচির পরিচয় বহন করে না। এ জায়গাটি অতিক্রম করে কিছু সময় হাঁটলে হাতের বাঁ পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সে কী! উদ্যানে প্রবেশের মূল যে পথ, সেখানে একদল নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছেন। প্রবেশপথের একটি অংশ কাঠ-বাঁশ-বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। দাঁড়িয়ে আছে অগণিত পুলিশ সদস্য। এদের জটলা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করছিলেন পাঠক। ভেতরের অবস্থা আরও খারাপ। মেলা শুরুর আগের চেহারা যেন। এখনও চলছে ঠুকাঠুকির কাজ। হাতুড়ি-করাত বের হয়নি মেলা থেকে। কিছুক্ষণ পর পরই চোখে পড়ে ময়লার স্তূপ। যে নিরাপত্তা নিয়ে এত কথা, সেটিও ঢিলেঢালা বলেই মনে হয়েছে। সিসিটিভির তার টানার কাজ এখনও শেষ হয়নি। বিকেলে কাজ করছিল একটি দল। মেলায় গাড়ি প্রবেশও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ছয়টি গাড়ি প্রবেশ করতে দেখা যায়। মেলার ভূমি উন্নয়নের কাজটিও কোথাও হয়েছে। কোথাও হয়নি। সতর্ক হয়ে পা না ফেললে বিপদ হতে পারে। সৌন্দর্য বর্ধনের কথাটিও জোর দিয়ে বলছিলেন আয়োজকরা। অথচ তেমন কোন কিছুই দেখা গেল না। এমনকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করা একটি ফোয়ারা জলহীন পড়ে আছে। একটি সূত্র জানাল, এই ফোয়ারা থেকে জল কবে বের হবে, বলা মুশকিল। কেন? কেন? জানতে চাইলে মজার কথা শোনালেন তিনি। বললেন, ফোয়ারা বসানো হয়েছে। কিন্তু যারা বসিয়েছেন তাদের টাকাপয়সা কিছু দেয়া হয়নি! সব মিলিয়ে যথেষ্ট অগোছালো। দ্বিতীয় দিনে এসে এমন শ্রীহীন হয় না মেলা। এবার হয়েছে। অবশ্য এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্টল বিন্যাস ভাল হয়েছে। গল্প- আড্ডা জমানোর মতো ফাঁকা জায়গা আছে। আবার একটি স্টলের সঙ্গে অন্যটির আছে যৌক্তিক দূরত্ব। ফলে ঘিঞ্জি মনে হয় না। স্টল মালিকরা নিজেদের কাজ সুন্দর শেষ করেছেন। প্রত্যেকটা স্টল যতটা সম্ভব সাজানো। প্যাভিলিয়নগুলো বিশেষ দৃশ্যমান। মেলার অভ্যন্তরে অনেক প্রশস্ত পথ। ইট বিছানো পথ ধরে হাঁটলে সহজেই পছন্দের স্টলের সামনে পৌঁছে যাওয়া যায়। কমবেশি নতুন বই দিয়ে শুরু ॥ পুরনো বই আছে সব স্টলেই। নতুন বইও চলে এসেছে। নতুন বলতে, গত বছরের মেলার পর প্রকাশিত বই। এবারের মেলায় প্রথম দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু স্টল ঘুরে দেখা যায়, এমন ১০ থেকে ৩০ টি বই বিশেষভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। আগামী প্রকাশনীর স্টলে পাওয়া গেল মিতিয়া ওসমানকে। হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠানের কর্ণাধার ওসমান গনির কন্যা। প্রতিষ্ঠানের বড় একটি দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানালেন, ১২টির মতো নতুন এরই মাঝে স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। তালিকাও বের করে দিলেন একটি। সেখানে প্রথমেই সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ।’ প্রয়াত লেখক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফের লেখাগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে প্রকাশ করছে আগামী। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে ‘স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব’, ‘আলাপচারী’ ও ‘সাক্ষাৎকারের সময়কাল।’ অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছেÑ মনজুরে মাওলার কবিতার বই ‘হাউই’, ড. চিত্তর রঞ্জন দাসের উপন্যাস ‘বিজয়িনী’, সুধাংশু শেখর বিশ্বাসের ভ্রমণ কাহিনী ‘সাগিনো ভ্যালি’, মাহবুব সিদ্দিকীর প্রকৃতি পরিবেশ বিষয়ক ‘আমাদের নদ নদী’। গত মেলার পর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য প্রকাশ করেছিল রবীন্দ্র রচনাবলী। সৈয়দ আকরাম হোসেন সম্পাদিত রচনাবলীর ৩০ খ- পাওয়া যাচ্ছে স্টলে। আছে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি ‘ওঙ্কারসমগ্র।’ অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘স্তালিন : মিথ্যাচার এবং প্রাসঙ্গিকতা’, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কালো সূর্যের নিচে বহ্ন্যুৎসব।’ মোড়ক উন্মোচন ॥ দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয়েছে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আনুষ্ঠানিকতা। মেলার দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার বিকেলে রম্য লেখক সত্যজিৎ বিশ্বাসের ‘জোকে জোঁকারণ্য’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন কার্টুনিস্ট ও লেখক আহসান হাবীব। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন পরিষদের সহসভাপতি বুলবুল ইসলাম, ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. রবীন্দ্রনাথ শীল, ডাঃ পূরবী আহমেদ, শেখ তানভীর আহমেদ প্রমুখ। বইটি প্রকাশ করেছে নওরোজ কিতাবিস্তান। পাঠকের কথা ॥ বাংলা একাডেমি অংশে এশিয়াটিক সোসাইটির স্টলের সামনে কথা হলো আরিনের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী। বললেন, আমরা প্রথম দিনই আসতে চেয়েছিলাম। পারিনি। তাই আজ এসেছি। মূলত মেলা কেমন হয়েছে, দেখতে আসা। তবে মেলা ঘুরে কিছু দৃশ্য দেখে মেলা শুরু হয়নি বলে মনে হয়েছে আইরিনের। একটি ব্যাংকে কাজ করেন। বললেন, একটু আগেভাগে অফিস থেকে বের হয়েছি। মেলায় আসার জন্যই আগে বের হওয়া। বই দেখেছি। ভাল লেগেছে। কিন্তু পরিবেশটা এখনও অগোছালো। অপরিচ্ছন্ন। মেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পর এমন দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রকাশকের কথা ॥ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের মূল গেট থেকে বেশ কিছুটা হাঁটলে ‘নালন্দা’র স্টল। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সামনের দিকটা বেশ খোলামেলা। পাশে ইট বিছানো পথ। বেশ প্রশস্ত। দুদিকে খোলা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রকাশক রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল। মেলায় তার সঙ্গে প্রথম দেখা। সৌজন্য বিনিময়ের পর বললেন, লটারিতেই স্টল পাওয়া। ভাল জায়গায় পেয়েছি। তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্টল বিন্যাস এবার সুন্দর হয়েছে। কোন স্টল দৃষ্টিকটুভাবে সামনে আসেনি। ভবিষ্যতের জন্য এই ম্যাপটি চূড়ান্ত ধরে বাকি সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে একাডেমি। পরিচালনা কমিটির বক্তব্য ॥ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ ঘুরে বের হয়ে আসার মুহূর্তে দেখা হয়ে গেল মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য নতুন মঞ্চ হবে। সেই কাজ দেখছিলেন তিনি। অন্যান্য বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছিলেন। মেলার দ্বিতীয় দিনে কেন এসব কাজ? জানতে চাইলে তিনি বিশেষ যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন না। উল্টো স্বীকার করে নিয়েই বললেন, সমস্যা থাকবে। সমাধান ধারাবাহিক প্রক্রিয়া! কথা বলতে বলতেই তিনি একপাশে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, এখানে মেলায় আগতদের বসার, বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এটিও তো আগেই হয়ে যাওয়ার কথা। হলো না কেন? এবারও উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেন না তিনি। বললেন, ঠিক হয়ে যাবে সব। এর পর অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া উপায় কী! শিশুপ্রহর আজ ॥ শুক্রবার মেলায় শিশু প্রহর ঘোষণা করা হয়েছে। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গ্রন্থমেলায় শিশুপ্রহর চলবে।
×