ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খুনী আল আমিন গ্রেফতার

পায়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারল না বিভোর

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পায়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারল না বিভোর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ খুনীর পায়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চেয়ে গড়াগড়ি দিয়েও বাঁচতে পারেনি নারিন্দা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ক্ষুদে শিক্ষার্থী রেদোয়ান ইসলাম বিভোর। খেলার সাথীদের সামনেই বিভোরকে সোমবার বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানাধীন গোলাপবাগে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে স্থানীয় সন্ত্রাসী আল আমিন। অবশেষে আল আমিনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। স্থানীয়রা জানান, এত পরিমাণ ছুরিকাঘাত করেছে যে, মারা যাওয়ার পর রক্তে পুরো শরীর ভিজে যায়। রক্তে সারা শরীর ঢেকে যাওয়ায় বিভোরকে প্রথম প্রথম দেখে চেনাই যাচ্ছিল না। বিভোরের পিতার দাবি, চাহিদা মোতাবেক টাকা না দেয়ায় আল আমীন তার ছেলেকে হত্যা করেছে। পুলিশ বলছে, জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে থাকা ঝামেলার সূত্রধরে আল আমিন নির্মমভাবে বিভোরকে হত্যা করে। আজ আল আমিনকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করার কথা রয়েছে। সোমবার বিকেল চারটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন গোলাপবাগের ৬০/সি নম্বর নিজ বাসার সামনে স্থানীয় সন্ত্রাসী আল আমিন (২৪) ছুরিকাঘাতে রেদোয়ান ইসলাম বিভোরকে (১১) হত্যা করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, গোলাপবাগের বাড়ির সামনে ৮/১০ ফুট রাস্তা। তাতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শত শত মানুষ ভিড় করেছে বিভোরকে শেষবারের মতো দেখতে। সেখানে গগনবিদারী আর্তনাদ করছেন পিতামাতা, দুই বোন, আত্মীয় স্বজনসহ পাড়া প্রতিবেশীরা। ভিড় করেছেন স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা। তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও সেখানে হাজির হয়েছে। নারিন্দা সরকারী স্কুলটিতে মঙ্গলবার কোন ক্লাস হয়নি। স্কুল ড্রেস পরা শত শত শিক্ষার্থী সেখানে উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করছিল। তাদের সান্ত¡না দিচ্ছিলেন শিক্ষক শিক্ষিকারা। বিভোরের কয়েকজন খেলার সাথী বলছিল, প্রতিদিনের মতো সোমবার বিকেল চারটার দিকে বিভোরের সঙ্গে তারা খেলছিল। তারা মূলত টেনিস বল দিয়ে খেলছিল। বিভোর বাড়ির সামনে থাকা ল্যামপোস্টের কাছ থেকে বল ছুঁড়ছিল। এ সময় আল আমিন আচমকা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিভোরকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে। এরপর কোমর থেকে ছুরি বের করে পেটে আঘাত করে। চিৎকার দিয়ে বিভোর বসে পড়ে খুনীর দু’পা জড়িয়ে ধরে তাকে না মারতে কাকুতি মিনতি করতে থাকে। এমন অবস্থায়ই পিঠে ছুরিকাঘাতে করে খুনী। এরপর জামা ধরে টেনে তুলে বাড়ির কাছেই থাকা ম্যানহোলের উপর নিয়ে যায়। সেখানেই এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। খানিকটা দূরে থাকা খেলার সাথীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতেই বিভোরের সারা শরীরে ছুরিকাঘাত করে ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিছুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, আল আমিনকে টাঙ্গাইলের যমুনা সেতুর পূর্বপ্রান্ত থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। স্থানীয়রা জানান, আল আমিনরা সেখানকার স্থানীয়। জন্মসূত্রে তারা সেখানকার বাসিন্দা। আল আমিনের পিতা আব্দুল মান্নান মুন্সী। তার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর সন্তান আল আমিন। পড়ালেখা করেনি। মাদকাসক্ত। মাদক সেবন ও বেচাকেনার সঙ্গেও জড়িত। সেখানকার বাসিন্দা রাজু বলছিলেন, তিনি মূলত হকার। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর আল আমিন হঠাৎ করেই তাকে একটি সাইকেল কিনে দেয়ার জন্য ডাক দেয়। সাইকেলের দোকানে যাওয়ার আগে একটি গলিতে দাঁড় করিয়ে তার সঙ্গে সাইকেলের বিষয়ে আলাপ করছিল। আচমকা তার মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে তার সঙ্গে থাকা দুইটি দশ টাকার নোটের বান্ডিল ছিনিয়ে নেয় আল আমিন। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভোরদের বাড়ি থেকে আল আমিনদের বাড়ির দূরত্ব মাত্র চারশ থেকে পাঁচশ গজ। দুই পরিবারের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক ভাল। রাস্তায় দেখা সাক্ষাতে কথাবার্তাও হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুই পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। বিভোরদের বাড়ি মূল রাস্তার কাছেই। ফলে আল আমিনদের পরিবারের সবাই সেখান দিয়ে হরদম যাতায়াত করে। নিহত বিভোর দুই বোন বৃষ্টি ও বিন্দুর একমাত্র ভাই ছিল। বিভোরের পিতা জনকণ্ঠকে বলেন, আল আমীনরা স্থানীয়। তিনি মূলত ব্যবসায়ী। ৪২ বছর আগে আল আমিনের দাদার কাছ থেকে তিনি বাড়ির জায়গাটি কিনে নেন। বছর কয়েক আগে বাড়ি করেন। বাড়ি করার সময় আল আমিনের পিতা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ টাকা আল আমিনের পিতাকে দেয়া হয়। এরপর সবকিছুই স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। এরপর দ্বিতীয় দফায় তারা আবার টাকা দাবি করে। মাস তিনেক আগে আল আমিনে বাড়িতে ঢুকে এক ভাড়াটিয়াকে শাসিয়ে যায়। একদিন বাড়ির সামনে আল আমীন তাকে ঝামেলা মেটালেন না বলে জানায়। আল আমিনদের পরিবারের সঙ্গে তাদের কোন ঝামেলা নেই বলে সে জানায়। এ বিষয়ে আল আমীনকে তিনি তার পিতার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। বিভোরের এক বোন জামাই জানান, মূলত দ্বিতীয় দফায় আল আমিনরা টাকা দাবি করে। সেই টাকা না দেয়ায় ক্ষব্ধ হয়ে আল আমিন বিভোরকে হত্যা করে। তবে আল আমিনরা বিভোরদের পরিবারের কাছে কোন টাকা পয়সা পায় না বলেও দাবি করেন তিনি। ধলপুর কমিউনিটি সেন্টারে নামাজে জানাজা শেষে বিভোরকে মঙ্গলবার মাগরিবের নামাজের আগে স্থানীয় কাজীর দরগাহ করবস্থানে দাফন করা হয়। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিছুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আল আমিনকে গ্রেফতারের পর ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, দুই পরিবারের মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। তারই জের ধরে আল আমিন ক্ষিপ্ত হয়ে বিভোরকে হত্যা করে। বুধবার আল আমিনকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করার কথা রয়েছে।
×