অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য বিনিয়োগ ও উৎপাদন সহায়ক সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি সরকার প্রক্ষেপিত হারে ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, অর্থবছরের প্রথম ভাগের মতোই একই রকম ‘সতর্ক’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে জানুয়ারি-জুন মেয়াদের জন্য। রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গবর্নর ফজলে কবির। এ সময় ডেপুটি গভর্নর, চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, নির্বাহী পরিচালকসহ বিভিন্ন বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গবর্নর বলেন, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য প্রণীত মুদ্রানীতির ভঙ্গি প্রথমার্ধের উৎপাদন সহায়ক সতর্ক নীতিভঙ্গিতে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। গেল মুদ্রানীতিতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও বেসরকারী খাতে ঋণের যোগান নির্ধারণ করা ছিল যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণের এ লক্ষ্যমাত্রাগুলোও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। সঙ্গত কারণে সরকারী ঋণের যোগান এবং রিজার্ভ ও ব্যাপক মুদ্রা সররবাহের লক্ষ্যগুলোও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে গবর্নর বলেন, ঋণ প্রবৃদ্ধির এ যোগান চলতি অর্থবছরে সরকার প্রক্ষেপিত প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের, এমনকি এ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত হবে। বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ হ্রাস ব্যক্তি খাতের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের যোগান সুগমতর করেছে বলে জানান গবর্নর। তবে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণ বাড়ায় দেশে বন্ড বাজারের বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সরকার থেকে ইতোমধ্যেই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এবার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, এবার প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৭ শতাংশ। গবর্নর ফজলে কবিরও মনে করেন, এবার প্রক্ষেপিত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। তিনি বলেন, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের উৎপাদন কর্মকা-ের বিবিধ উপাত্ত, রফতানি খাতের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার তেজীভাব থেকে দেশের অর্থনীতি প্রক্ষেপিত ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথেই রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়অ শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে এ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রান্ত হতে পারে বলে অনেক মহল থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। গবর্নর জানান, উৎপাদনমুখী কর্মকা-ের জন্য মুদ্রানীতি কার্যক্রমে পর্যাপ্ত অর্থায়নের সংস্থান রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অর্থায়ন যাতে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ, অন্তর্ভুক্তি, পরিবেশবান্ধব ভিত্তিতে সমাজের সব স্তরের জনগোষ্ঠীর উৎপাদন কর্মকা-ে সমর্থন যোগায় সে বিষয়ে বিবিধমুখী উদ্যোগ অব্যবহত থাকবে।
গেল মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও বেসরকারী খাতে ঋণের যোগানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। নবেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ও বেসরকারী খাতের ঋণের যোগান বেড়েছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ। তা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির জোরালো ধারা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন গবর্নর। তিনি বলেন, মুদ্রা ও ঋণ প্রবাহের এ যৌক্তিক পরিমিতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে (উপশমে) অনুকূল অবদান রেখেছে। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানে তা লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচেই রয়েছে। ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশে। নতুন মুদ্রানীতির লক্ষ্যগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই থাকবে। এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে গবর্নর বলেন, বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির উর্ধসীমাটিই আমরা দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি কার্যক্রম প্রণয়নে ব্যবহার করেছি।
জ্বালানি তেলের দাম কমাসহ অন্যান্য কারণে রেমিটেন্সপ্রবাহ নিম্নমুখী রয়েছে বলে উল্লেখ করেন গবর্নর। তিনি বলেন, চলতি বছর জ্বালানি তেলের মূল্য স্থিতিশীল হয়ে উর্ধমুখী হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল প্রত্যাশা করছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন শ্রমবাজারে জনশক্তি রফতানির তথ্য থেকে প্রত্যাশা করা যায়, নিকট ভবিষ্যতে রেমিটেন্সে অন্তঃপ্রবাহ স্থিতিশীল হয়ে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে। হুন্ডির কারণে রেমিটেন্সপ্রবাহ কমছে কিনা- সংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গবর্নর বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে যেসব টাকা পাঠানো হয় সেগুলোর বিষয়ে আমাদের রিসার্চ গ্রুপ কাজ করছে। তারা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশে যাবে। পাশাপাশি ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ বেশি কি-না এবং ওয়েস্টার্ন মানিসহ যারা রেমিটেন্স আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত তাদের কমিশন বেশি দিতে হচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব কারণসহ সার্বিক বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি। আশা করি দুই-তিন মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে এবং রেমিটেন্সপ্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
শেয়ারবাজারে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ ॥ পুঁজিবাজারে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে গবর্নর বলেন, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মতো বাংলাদেশ ব্যাংকও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, মূলধন বাজারে (পঁজিবাজার) ২০১০ সাল থেকে বিরাজমান মন্দা প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি যাতে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণে সুস্থ ধারায় থাকে, সে বিষয়ে কার্যকরী নজরদারি অতিব গুরুত্বপূর্ণ; না হলে অতীতের মতো এবারও প্রলুব্ধ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তবে এ নিয়ে বিএসইসি ইতোমধ্যেই সতর্কতামূলক উপদেশ জারি ও বিনিয়োগকারীদের আর্থিক জ্ঞান উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি পুঁজিবাজারে উদ্যোক্তাদের শেয়ার ও অস্বাভাবিক উচ্চ পিই রেশিওধারী শেয়ারগুলোর বিপরীতে মার্জিন ঋণ যোগানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা বাঞ্ছনীয় হবে বলে উল্লেখ করেন। গবর্নর বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক রয়েছে। এর অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজার আইনে নির্দেশিত মাত্রায় সীমাবদ্ধ রাখার ব্যাপারে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকেও তাদের গ্রাহকদের নেয়া বিভিন্ন ঋণ সঠিক খাতে ব্যবহার না হয়ে অস্বাভাবিক লাভের আশায় মূলধন বাজারে বিনিয়োগে যাতে অপব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে নজরদারি জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্ট-আপ, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং প্রাইভেট ইক্যুইটি পুঁজিবাজারের বিকাশের জন্য নতুন প্রয়াস হিসেবে কাজ করছে। বিএসইসি এ প্রয়াসকে সমর্থন যোগাচ্ছে। সংস্থাটির ইস্যু করা অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট নীতিমালার আলোকে নতুন উৎপাদন উদ্যোগগুলোকে আর্থিক খাতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শেয়ারবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ডায়াগনস্টিক রিভিউ করা হবে কিনা- সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের অতীতের উত্থান-পতন এবং বর্তমান অবস্থার কারণ নির্ণয় নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। এটা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এখতিয়ারে। তারা এ বিষয়ে কাজ করছে।