ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ বাগেরহাটের ১৪ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট প্রসিকিউশনে দাখিল

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ বাগেরহাটের ১৪ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট প্রসিকিউশনে দাখিল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাগেরহাটের ১৪ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। রবিবার ধানম-িতে তদন্ত সংস্থা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অবৈধ আটক, নির্যাতন, অপহরণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৪৫তম তদন্ত প্রতিবেদন। বিকেলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ হেলালউদ্দিন প্রতিবেদনটি প্রসিকিউশনে দাখিল করেছেন। প্রসিকিউশন কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাসুদ রানা প্রতিবেদন গ্রহণ করেন। এটি যাচাই-বাছাই শেষে প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করবে। এদিকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের পাগলা থানাধীন পাঁচ রাজাকারের বিরুদ্ধে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। অপরদিকে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক হান্নান খান বলেছেন, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকায় এবার তদন্ত শুরু হয়েছে তৎকালীন পাকবাহিনীর বাঙালী কর্মকর্তাদের। তিনি বলেন, আইসিটিতে এটাই বাঙালী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রথম তদন্ত শুরু। আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা-গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অবৈধ আটক, নির্যাতন, অপহরণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ২২ জনকে হত্যা, ৪৫/৫০ বাড়ির মালামাল লুণ্ঠনের পর আগুনে পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা, ২ জনকে অমানুষিক নির্যাতনে গুরুতর জখম এবং ৪ নারীকে দীর্ঘদিন রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা। কুখ্যাত রাজাকার হিসেবে মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাগেরহাটের কচুয়া ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় তারা এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। বাগেরহাটের এই ১৪ রাজাকার হলো বাগেরহাটের খান আশরাফ আলী (৬৫), খান আকরাম হোসেন (৬০), সুলতান আলী খান (৬৮), রুস্তম আলী মোল্লা (৭০), ইদ্রিস আলী মোল্লা (৬৪), মকছেদ আলী দিদার (৮৩), শেখ মোঃ উকিল উদ্দিন (৬২), শেখ ইদ্রিস আলী (৬১), শেখ রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুল (৬৪), মোঃ মনিরুজ্জামান হাওলাদার (৬৯), মোঃ হাশেম আলী শেখ (৭৯), মোঃ আজাহার আলী শিকদার (৬৪), মোঃ মকবুল মোল্লা (৭৯), মোঃ আব্দুল আলী মোল্লা (৬৫)। আসামিদের মধ্যে আজহার আলী শিকদার শুধু বিএনপি সমর্থক। বাকি সবাই জামায়াত সমর্থক। আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে একই বছর ২৬ খান আকরাম হোসেন, ইদ্রিস আলী মোল্লা, শেখ মোঃ উকিল উদ্দিন এবং মকবুল মোল্লাকে গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। এই চার আসামি জেলহাজতে আছে। বাকি ১০ আসামি পলাতক। আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ৪ জুন তদন্ত শুরু হয়। দুই বছরের বেশি সময় ধরে ৫৭ জন ঘটনার সাক্ষী, একজন তদন্ত কর্মকর্তা এবং ৩ জন জব্দ তালিকার সাক্ষীর জবানবন্দীর প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে বাগেরহাট জেলার কচুয়া ও মোরেলগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ আটক, নির্যাতন, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করা, ধর্ষণ ও হত্যার মতো সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছে। অপরাধ তদন্ত করেন তদন্ত সংস্থার সদস্য হেলাল উদ্দিন। আসামিদের বিরুদ্ধে ৭ অভিযোগ : (ক) বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ থানাধীন চাপড়ী ও তেলিগাতীতে নিরীহ নিরস্ত্র মুক্তিকামী মানুষের ওপর অবৈধভাবে হামলা চালিয়ে ৪০/৫০ বাড়ির সমস্ত মালামাল লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং ১০ নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা। (খ) কচুয়া থানাধীন হাজরাখালী ও বৈখালী রামনগরে হামলা চালিয়ে অবৈধভাবে ৪ জনকে আটক ও অপহরণ করে আবাদের খালের ব্রিজে হত্যার পর লাশ খালে ফেলে দেয়া হয়। (গ) মোরেলগঞ্জ থানাধীন ঢুলিগাতী গ্রামে হামলা চালিয়ে দুজনকে আটক, নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা। (ঘ) কচুয়া থানাধীন বিলকুল ও বিছট গ্রামে হামলা চালিয়ে ৪ জনকে আটক ও অপহরণ করে কাঁঠালতলা ব্রিজে এনে নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। (ঙ) কচুয়া থানাধীন বিলকুল গ্রাম হতে নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আলী নকীবকে অন্যায় আটক ও অপহরণ করে মোরেলগঞ্জ থানার দৈবজ্ঞহাটির গরুর হাটির ব্রিজের ওপরে নিয়ে নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা। (চ) কচুয়া থানাধীন উদানখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ নিরস্ত্র উকিল উদ্দিন মাঝিকে অবৈধভাবে আটক করে হত্যা করে এবং তার মেয়ে তাসলিমাকে অবৈধভাবে আটক ও অপহরণ করে কচুয়া রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তাসলিমাসহ ৪ জনকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে আসামিরা। পরে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প তল্লাশি করে তাসলিমাকে উদ্ধার করে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন। (ছ) কচুয়া থানাধীন গজালিয়া বাজারে হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ নিরস্ত্র শ্রীধাম কর্মকার ও তার স্ত্রী কমলা রানী কর্মকারকে অবৈধভাবে আটক করে নির্যাতন করা হয়। আসামিরা শ্রীধাম কর্মকারকে হত্যা করে কমলা রানী কর্মকারকে জোরপূর্বক অপহরণ করে কচুয়া রাজাকার ক্যাম্পে এনে আটকে রাখে। আসামিরা কচুয়া রাজাকার ক্যাম্প ও আশপাশের কমলা রানী কর্মকারসহ আটককৃত অন্য চারজনকে দীর্ঘদিন রাজাকার ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। প্রায় এক মাস শারীরিক নির্যাতনের পর কমলা রানী কর্মকার অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। ময়মনসিংহের ৫ রাজাকার ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের পাগলা থানাধীন পাঁচ রাজাকারের বিরুদ্ধে ২৩ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে এই সময় দেয়া হয়েছে। রবিবার বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছেন। প্রসিকিউশনের পক্ষে সময়ের আবেদন করেন প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন। এ মামলার পাঁচ আসামি হলোÑ শামছুজ্জামান কালাম, মোঃ আবদুল্লাহ, আব্দুল মালেক, খলিলুর রহমান মীর ও বাগেরহাটের উকিল মোল্লা। মামলায় তিন আসামি অন্য মামলায় গ্রেফতার থাকায় তাদের বিরুদ্ধে শ্যোন এ্যারেস্ট দেখানো হয়। বাকি দুই জনকে আদালতের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়। পাকবাহিনীর বাঙালী অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্ত ॥ একাত্তরে বেসামরিক রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর পাশাপাশি বাঙালী সেনা সদস্যদের কেউ কেউ পাকবাহিনীর হয়ে স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তাদের মধ্যে রংপুরে দুজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, একাত্তরে পাকবাহিনীতে কর্মরত কয়েক বাঙালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একটি ঘটনা আমরা জেনেছি- ওই সময় রংপুরে একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল...সেখানে কয়েক বাঙালী অফিসারের সম্পৃক্ততা ছিল।”এ বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ হয়েছে জানিয়ে হান্নান খান বলেন, “দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন গ্রেফতার হয়েছেন। আরেকজন পলাতক।”বিষয়টি তদন্তাধীন বলে এনিয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিষ্পত্তির পর এই পর্যন্ত ছয়জনের ফাঁসির দ- কার্যকর করা হয়েছে। এরা সবাই রাজনীতিক; তাদের পাঁচজনই জামায়াতে ইসলামীর নেতা, একজন বিএনপি নেতা। এছাড়া আর যারা দ-িত, তারাও জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতা। জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে জানিয়ে হান্নান খান বলেন, “আশা করছি, এ বিষয়ে উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত আমরা পাব।”
×