ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আইনমন্ত্রী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরাবে না;###;বিচার কাজ শেষে এটা জাদুঘর হবে

সরকার কঠোর অবস্থানে ॥ ট্রাইব্যুনাল সরছে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

সরকার কঠোর অবস্থানে ॥ ট্রাইব্যুনাল সরছে না

বিকাশ দত্ত ॥ যত কিছুই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরছে না। ট্রাইব্যুনাল সরানো নিয়ে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন ও আইন মন্ত্রণালয়ের পাল্টাপাল্টি চিঠির পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল সরানো ও না সরানোর জন্য প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন তথ্যসহকারে একাধিকবার এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত পুরাতন হাইকোর্ট ভবনেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থাকছে, বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। সেখানেই বিচার হবে সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীর। বিচার শেষে ভবনটি জাদুঘরে পরিণত করা হবে। জাদুঘর পরিদর্শন করে দেশী-বিদেশী পরিদর্শকবৃন্দ জানতে পারবেÑকিভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্যরা নিরীহ জনগণকে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিভাবে নয় মাসে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা, প্রায় সোয়া চার লাখ নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এক কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। যারা অপরাধ করেছিল সেই সমস্ত অভিযুক্তের বিচার এখানে হয়েছে। এটা ইতিহাসের অংশ হিসেবে থাকবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলবে। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর ট্রাইব্যুনাল সরানোর প্রশ্নই আসে না। যেমনটি হয়েছিল নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বেলায়। আইনমন্ত্রী কি বলেন ॥ বহু আন্দোলনের ফসল আজকের ট্রাইব্যুনাল সরকারের উচ্চ পর্যায় ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পুরাতন হ্ইাকোর্ট ভবন থেকে আর সরছে না। সর্বশেষ আইনমন্ত্রী জনকণ্ঠকে বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল সরছে না। এর আগে তিনি বলেছিলেন, জনতার দাবি যেটা সেটাই করব। তার কারণ হচ্ছে, জনগণের ইচ্ছা যে ট্রাইব্যুনাল ওখানেই থাক। ট্রাইব্যুনাল শেষ হওয়ার পরে সেটা একটা জাদুঘর হোক। সেই জনগণের ইচ্ছাকে কি করে রূপ দেয়া যায় সেই চেষ্টাই আমি করব। অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্য মানেই সরকারের বক্তব্য। সরকার বলে দিয়েছে বিচার কাজ শেষে এখানে জাদুঘর হবে। কাজেই এই স্থান থেকে ট্রাইব্যুনাল সরানোর কোন প্রশ্নই আসে না। বিচারের ইতিহাস ॥ ১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানের জন্য গঠন করা হয়েছিল জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রায় ৫ লাখ লোকের সমাগম ঘটেছিল। এরপর গণআদালতের কর্মসূচী বানচাল করতে ব্যর্থ হয়ে তদানীন্তন বিএনপি সরকার ২৪ বরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে। ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোলাম আযমের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এবং ২৪ বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তখন জাতীয় সংসদে এক অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। তখন সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের চাপে এবং জাহানারা ইমামের তুঙ্গস্পর্শী আন্দোলনে সরকার ২৯ জুন ’৯২ তারিখে বিরোধী দলের সঙ্গে চারদফা চুক্তিতে বাধ্য হয়। যে চুক্তির প্রথম দুই দফা ছিল, সরকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার করবে এবং গণআদালতের উদ্যোক্তা ২৪ বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করবে। বিরোধী দলকে সংসদে আনার জন্য খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার এ ধরনের চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেনি। গোলাম আযমের বিচার করার বদলে খালেদা জিয়া তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেন। শত হযরানি ও নির্যাতন সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটি ১০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল। শুরু থেকেই প্রপাগান্ডা ॥ সকল জল্পনাকল্পনা শেষে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে আজ অবধি এর বিরুদ্ধে নানামুখী প্রপাগান্ডা চলে আসছে। প্রথমে প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল মতিনের নিয়োগ থেকে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের (সাকা ) চৌধুরীর রায়ের আগের দিন পর্যন্ত নানামুখী প্রপাগান্ডা হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় আগেভাগে ফাঁস করার অভিযোগ তোলা হয়। যদিও সেটি ছিল রায়ের খসড়ার একটি অংশ; যা কোন রায় নয়। এদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের অভিযোগ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হওয়াতে জামায়াতের আইনজীবী ও তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত লবিস্টরা ট্রাইব্যুনালের আইন নিয়ে নানামুখী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পৃথিবীর মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতবিরোধী অপরাধে গ্রেফতারদের বিচার করতে আইন এবং পদ্ধতি অনুযায়ী ন্যায়বিচার করতে যতটুকু সময় প্রয়োজান ঠিক ততটুকুই সময় লাগতে পারে। বাস্তবগতভাবে এটা হলো পৃথিবীর মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক ট্রাইব্যুনাল। নুরেমবার্গ ছিল আর্মি ট্রায়াল। সেখানে কোন লিখিত আইন ছিল না। অভিযুক্তদের আপীল করার কোন সুযোগই ছিল না। ৮সংগঠনের প্রতিবাদ ॥ ট্রাইব্যুনাল সরানোর জন্য সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনে চিঠি দিলে আইন মন্ত্রণালয় তা না সরানোর জন্য চিঠি দেয়। পাশাপাশি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ৮ সংগঠনও ট্রাইব্যুনাল না সরানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন করেছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল, সাবেক বিচারপতি, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণও এ বিষয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন। গত বছরের ২৭ আগস্ট ৮ সংগঠনের পক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ট্রাইব্যুনাল সরানো যাবে না। ট্রাইব্যুনাল ওখানেই থাকবে এবং অবশিষ্ট যে সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধী আছে তাদের বিচার হবে। এর আগে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ আটটি সংগঠন সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালটি পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে না সরানোর অনুরোধ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। শুধু আট সংগঠনের পক্ষে ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি সামছুল হুদা,শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ফেরদৌসি প্রিয়ভাসিনী, উদীচীর সভাপতি কামাল লোহানী, প্রজন্ম ’৭১-এর তৌহিদ রেজা নুর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ওসমান গনি, মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হারুন হাবিব, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, সাংস্কৃতিক জোটের হাসান আরিফ, মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম ও কাজী মুকুল। পাশাপাশি সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমাযুন ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল বাসেত মজুমদার ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিরাপত্তা, প্রসিকিউটরদের নিরাপত্তার পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য ্ট্রাইব্যুনাল না সরানোর অনুরোধ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, আইনজীবীদের নিরাপত্তাসহ সকল বিষয় চিন্তাভাবনা করেই এখান থেকে ট্রাইব্যুনাল সরানো উচিত হবে না। দুই প্রতিষ্ঠানের চিঠি চালাচালি ॥ ট্রাইব্যুনাল সরানোর জন্য সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন দুই বার আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। অন্যদিকে আইন মন্ত্রণালয়ও না সরানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানের চিঠি চালাচালি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রথম চিঠি পাঠায় ১৮ আগস্ট। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত ঐ চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে বর্তমানে পর্যাপ্ত স্থানাভাবে বিচারপতিগণের প্রয়োজনীয় চেম্বার ও এজলাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে সুপ্রীমকোর্ট রেজিস্টার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক চেম্বার দফতরের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও প্রকট হবে বিধায় জরুরী ভিত্তিতে বিচারপতিগণের চেম্বার ও এজলাস এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস হিসেবে ব্যবহারের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় স্থানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। সে লক্ষ্যে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সুপ্রীমকোর্টকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটির (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে ব্যবহৃত অংশ) দখল হস্তান্তরের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এর ৭৪ দিনের মাথায় ৩০ অক্টোবর সুপ্রীমকোর্ট এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সুপ্রীমকোর্র্ট প্রশাসনের দেয়া চিঠির জবাব দেয় আইন মন্ত্রণালয় । ঐ চিঠিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটির দখল বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অনুকূলে হস্তান্তর করা হলে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বজনগ্রাহ্য হবে না বরং বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ ভবনটি পূর্ববাংলা ও অসম প্রদেশের গবর্নরের সরকারী বাসভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়। সবশেষে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে বিচার কাজ শুরু হয়। অনেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ সুসম্পন্ন হয়। সে কারণে এ ভবনটির ঐতিহ্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ চায় যে, ভবনটি ঐতিহাসিক ভবন, বিধায় সে মর্যাদাকে সমুন্নত রেখে ভবনটি সংরক্ষণ করা হোক। এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখান থেকে সরানো না হোক। আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবের পর পুনরায় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন দ্বিতীয় দফায় আবার চিঠি দিয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরিয়ে নিতে আবারও আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট। ৪ ডিসেম্বর সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দখল হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। এর জবাবে আইন মন্ত্রণালয় আবার ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় ট্রাইব্যুনাল না সরানোর অনুরোধ জানিয়ে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনকে চিঠি দেয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (প্রশাসন) কাজী মুশফিক মাহবুব রবিন স্বাক্ষরিত ঐ চিঠিতে বলা হয়, সকল বিষয় বিবেচনা করে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন হতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর করে ভবনটি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অনুকূলে দখল করা সমীচীন হবে না। এমতাবস্থায় সুত্রাক্ত পত্রের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য আপনাকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য ॥ চিঠি দেয়ার পাশাশাপি প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী ট্রাইব্যুনাল সরানো ও না সরানোর পক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে বলেন, পুরনো হাইকোর্ট ভবন হতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলেও এর কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেল হত্যা মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হত্যার মতো মর্মান্তিক মামলাগুলো যদি জেলা আদালতে হতে পারে তাহলে যুদ্ধাপরাধীর মামলার বিচার সুপ্রীমকোর্ট অঙ্গনের বাইরে হতে কোন অসুবিধা নাই। সুপ্রীমকোর্টে কোন প্রশাসনিক ভবন নাই। পুরনো হাইকোর্ট ভবন হতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হলে সুপ্রীম কোর্টের অবকাঠামোগত সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। এ বিষয়ে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আবারও অনুরোধ করছি। তিনি আরও বলেন, প্রায়শই সরকার নতুন আইন করে বিভিন্ন ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠন করছেন। এসব ট্রাইব্যুনালের জন্য পৃথক আদালত ভবন, পরিকাঠামো নির্মাণ এবং রেকর্ড রুম ও বসার জায়গা অপরিহার্য হলেও সরকার এ বিষয়ে সব সময় উদাসীন। আদালতের স্থান সংকুলানের তীব্র সঙ্কটের বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর নজরে এনেছি। তা সত্ত্বেও কোন আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়নি। যা হোক, হাইকোর্টে পর্যাপ্ত স্থান থাকা সত্ত্বেও কেন কর্মচারীদের বসার জায়গার নামে প্রধান বিচারপতি বার বার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরাতে চেয়েছিলেনÑ বিষয়টি দেশের সুশীল সমাজের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে তারা তাদের মতামত লেখালেখি ও টকশোতে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হকও ৪ জানুয়ারি বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট আয়োজিত স্পেশাল জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল জজ এবং সমপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ‘ওরিয়েন্টেশন ট্রেনিং কোর্সের’ উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে সরানোর জন্য সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন যত চিঠি দেবে ততই তা না সরানো জন্য পুনর্বিবেচনা করতে পাল্টা চিঠি দেয়া হবে। সর্বশেষ ১২ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের কোন টানাপোড়েন চলছে না। ট্রাইব্যুনাল সরানোর বিষয়ে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির দফতর থেকে এ বিষয়ে দুবার চিঠি পেয়েছিলাম। দুবারই তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, আপনাদের এটুকু জানাতে পারি আমাদের এ বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং আশা করি এখান (পুরনো হাইকোর্ট ভবন) থেকে ট্রাইব্যুনাল সরাতে হবে না। আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধীদেও বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একদিনে গঠিত হয়নি। এর পেছনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন চতুর্থাংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এই অবিস্মরণীয় বিজয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি মহাজোটের অঙ্গীকার, যা তরুণ প্রজন্মেও নির্বাচক ম-লীকে আকৃষ্ট করেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার বিষয়ে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার সংখ্যা বাড়া এবং দ্রুত নিষ্পত্তি করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গুরুত্বপূর্ণ মামলা বিচার শেষ হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল দুটির স্থলে একটিতে রাখা হয়েছে। ২৭টি রায় এসেছে ॥ এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে ২৭ মামলায় ৫৩ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জনের মৃত্যুদ-, একজনের যাবজ্জীবন, একজনের ৯০ বছরের কারাদ- এবং ২৫ জনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আরও প্রায় ২৫টি মামলা ১১৬ জনের বিরুদ্ধে বিচার কাজ চলছে। আপীল বিভাগে ৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর সাতটি রায়ের মধ্যে ৬টিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তা ছাড়া তদন্ত সংস্থায় ৫৮৫টি আবেদনের মধ্যে মোট ৩২২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। তদন্ত সংস্থা পর্যায়ক্রমে যাচাই বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে। দালাল আইনে যারা আটক ছিল সেই ১১ হাজার দালালদেরও (যার জীবিত আছেন) ও যুদ্ধাপরাধীর দায়ে ১৯৫ জন অভিযুক্ত পাকিস্তানী সৈন্যের বিচারের আওতায় আনার চিন্তা ভাবনা চলছে। তদন্ত সংস্থা ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দিয়েছেন। বর্তমান আইনে জামায়াতে বিচার সম্ভব নয় বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত আছে।
×