ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী

হুজুগে না মেতে জেনে বুঝে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করুন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

হুজুগে না মেতে জেনে বুঝে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করুন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান সরকার পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। পুঁজিবাজার হবে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের এক নির্ভরযোগ্য উৎস। আর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশে পুঁজিবাজারের অবদান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে শিল্প ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের অন্যতম উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের সুদৃঢ় অবস্থা আমাদের একান্ত কাম্য। হুজুগে না মেতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালী হুজুগে মাতে। হুজুগে মেতে সব শেষ করে, তারপর হায় হায় করে। জনগণের সঞ্চয় অভ্যাস গড়ে তোলা, সঞ্চিত অর্থের সঠিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারার সক্ষমতা অর্জনে বিনিয়োগ শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’ তিনি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, যেখানে বিনিয়োগ করবেন সে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানুন, ভালভাবে খোঁজখবর নিন। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ও আর্থিক বিবরণী জেনে নিন। কিছু না জেনে বিনিয়োগ করে সব হারাবেন, তারপর সব দোষ অর্থমন্ত্রী আর সরকারের, এটা যেন না হয়। ঝুঁকিটা বিনিয়োগকারীদের নিতে হবে। জেনে-বুঝে সঠিক জায়গায় সঠিক বিনিয়োগ করতে হবে। রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দেশের পুঁজিবাজারে সরকারের অব্যাহত সহযোগিতার অংশ হিসেবে ‘দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমে’র (ফিনান্সিয়াল লিটারেসি প্রোগ্রাম) আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন করেন। ২০১৩ সালের ২৪ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এক লাখ বর্গফুট আয়তনের ১০তলা এই ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। বিএসইসি চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ‘ফিনান্সিয়াললিটারেসীবিডি.কম’ সাইটেরও উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে পুঁজিবাজারের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র এবং ফিনান্সিয়াল লিটারেসী কার্যক্রমের আওতায় টেলিভিশনে প্রচারের জন্য তৈরি করা দুটি বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বস্তরের বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং যৌক্তিক বিানিয়োগের কলাকৌশল সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে বিএসইসি’র দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। এতে বিনিয়োগকারী উপকৃত হবার পাশাপাশি জ্ঞাননির্ভর বিনিয়োগ গোষ্ঠীর উপস্থিতির ফলে দেশের পুঁজিবাজার আরও গতিশীল হবে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, স্টক এক্সচেঞ্জ ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহ সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাজারের কর্মকা-ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে তুলবে বলে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, যা সেবা আর অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের পদক্ষেপের ফলে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে এবং দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। কাজেই পুঁজিবাজারও অব্যাহত বিকাশমান এবং সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে আজ বিশ্বসভায়ও আমরা ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হচ্ছি। তিনি বলেন, তাঁর সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ, অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা সমুন্নত রাখা। সেই লক্ষ্য অর্জনেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাজার বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদী পুঁজি সরবরাহের ব্যবস্থা করে থাকে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীগণ তাদের সঞ্চয় সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের সুযোগ পান। এরফলে শিল্প ও কলকারখানা বিকাশের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার উন্নত অর্থনীতি গড়ে তোলার অন্যতম শর্ত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে শিল্প ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের অন্যতম উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের সুদৃঢ় অবস্থান আমাদের একান্ত কাম্য। অনুষ্ঠানে তিন বছর আগে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন জানান। নিজস্ব ভবন নির্মাণে কাজ করতে পারায় কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিকাশের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে। একটি স্থিতিশীল, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বিএসইসি’র আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের কর্মকা-ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আইনী বিধান রাখা হয়েছে এবং দেশে বিদেশে উন্নততর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা ও বেতন-ভাতাদিসহ অন্যান্য সুবিধা বাংলাদেশ ব্যাংকের সমমানের করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেয়ারবাজারে লেনদেন কারচুপি ও অনিয়ম শনাক্ত করতে যথাযথ নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রয়েছে এবং পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ঢাকায় একটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সহায়তা তহবিল’ নামে ৯০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিও-তে ২০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং এ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, ভারতে কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত না হলে সেখানে ব্যবসা করার কোন সুযোগ নেই। জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিষয়টির দিকে বিশেষ নজর দেয়ার কথা জানিয়ে বলেন, আমাদের অর্থনীতি যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে তাদের (বহুজাতিক কোম্পানি) এদেশে বিনিয়োগের জন্য একটু চাপ সৃষ্টি করতে পারি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নিজস্ব ভবনে যাচ্ছে বিএসইসি ॥ অর্থনৈতিক রিপোর্টার জানান, দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর নিজস্ব ভবনে যাচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বর্তমানে সংস্থাটি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মতিঝিলের দিলকুশায় জীবন বীমা ভবনে ভাড়া করা কার্যালয়ে রয়েছে। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে শূন্য দশমিক ৩৩ একর জমির ওপর ‘সিকিউরিটিজ কমিশন ভবন’ নির্মাণে ব্যহয়েছে ৬০ কোটি টাকা। নকশা অনুযায়ী দশ তলা এ ভবনের মোট আয়তন ৮৯ হাজার ২৫০ বর্গফুট। বিএসইসির নিজস্ব অফিস ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স হল, বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারের এজলাস, লাইব্রেরি, ডে-কেয়ার সেন্টার ও ক্যান্টিন থাকবে এ ভবনে। মতিঝিলের পুরনো অফিস থেকে ধাপে ধাপে কমিশনের সব কার্যক্রমই নতুন ভবনে নিয়ে আসা হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর আগে গত ২০০৪ সালের জুন মাসে কমিশনকে জমি বরাদ্দ দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। বরাদ্দপত্রের শর্তানুযায়ী কমিশন জমির মূল্য বাবদ ৬০ লাখ টাকা পরিশোধ করলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিএসইসির অনুকূলে জমির ইজারা দলিল নিবন্ধন করে দেয় ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি। ২০১৩ সালের ২৪ নবেম্বর শেখ হাসিনাই এ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবিবার বেলা পৌনে ১১টায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে নবনির্মিত এই ভবনের ফলক উন্মোচন করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও বিএসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
×