ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী চাকুরেদের পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও ভবিষ্যতে এই সুবিধা পাবেন

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সমন্বিত কাঠামোর আওতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই কাঠামোর আওতায় সরকারী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি যারা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন তাদেরও ভবিষ্যতে পেনশন সুবিধার আওতায় আনা হবে। দেশের সকল চাকরিজীবীকে পেনশন সুবিধা প্রদানে আগ্রহী বর্তমান সরকার। প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির খসড়া কাঠামো তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। শীঘ্রই তা মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। আগামী ২০১৮ সাল থেকে একটি স্বতন্ত্র অধিদফতরের মাধ্যমে সরকারী চাকরিজীবীদের পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এতে জাতীয় বাজেটে পেনশনের জন্য আর পৃথক বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন হবে না। সর্বজনীন পেনশন ফান্ডে অর্থায়ন করতে সম্পৃক্ত হবে ব্যাংক ও বীমা খাত। পেনশন ফান্ডের তহবিল বড় করতে এই টাকা বড় বড় অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হবে। একই সঙ্গে বেসরকারী খাতে পেনশন সুবিধা চালু করতে একটি আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওই আইনের আওতায় বেসরকারী খাতের চাকরিজীবীরাও পেনশন সুবিধা পাবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। এদিকে, সরকারী চাকরিজীবীদের পেনশন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পেনশন তহবিল ও ‘পেনশন ফান্ড ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রাথমিকভাবে এ কর্তৃপক্ষকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফান্ড প্রদান করা হবে। এ ফান্ড হতে পেনশন প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে পেনশনভোগীদের জন্য কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এই বাস্তবতায়ও বাজেট পেনশন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পেনশন তহবিল হবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। অর্থাৎ চাকরিজীবি ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এ তহবিলে অর্থ দেবে। এর পরিমাণ হতে পারে চাকরিজীবীর মূল বেতনের শতকরা ১০ ভাগ। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও সমপরিমাণ টাকা দেবে। সরকার ও বেসরকারী খাতে একই নিয়মে তহবিল গঠন করা হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমের আওতায় সরকারী চাকরিজীবীদের বয়স হবে ৬০ বছর। আর বেসরকারী খাতের জন্য ৬৫ বছর। নির্ধারিত সময়ে চাকরি শেষে অর্ধেক পেনশনের টাকা এককালীন তুলতে পারবেন। বাকি টাকা তহবিলে থাকবে। এ তহবিল পরিচালনার জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। তারা লাভজনক খাতে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগ সুরক্ষাও দেয়া হবে। এ থেকে যে মুনাফা আসবে, তার অংশ মাসে মাসে পাবেন সুবিধাভোগীরা। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সুবিধা থাকবে। এ প্রসঙ্গে চলতি বাজেটে ঘোষণায়ও অর্থমন্ত্রী জানান, দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ সরকারী চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্রাচ্যুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমার পাশাপাশি গড় আয়ু বাড়ার কারণে জনমিতিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। এতে প্রবীণদের সংখ্যা এবং মোট জনগোষ্ঠীতে তাদের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে নগরায়নের কারণে একক পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সরকারের একার পক্ষে এই ঝুঁকি মোকাবেলা সম্ভব নয়, এজন্য সকল শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীসহ প্রবীণদের জন্য একটি সর্বজনীন ও টেকসই পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যোগদানকারী সকল সরকারী চাকরিজীবীর জন্য বিদ্যমান পেনশন পদ্ধতি পরিবর্তন করে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পেনশন পদ্ধতি চালু করব। শুধু তাই নয়, পর্যায়ক্রমে আধা-সরকারী ও ব্যক্তিখাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এবং অনানুষ্ঠানিক বা স্ব-কর্মসংস্থানে নিযুক্ত কর্মজীবীসহ সকল স্তরের জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সমন্বিত কাঠামোর আওতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে, পেনশন তহবিলের টাকা যোগান দিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে অর্থবিভাগ। দাতাদের পাশাপাশি সরকার তার নিজস্ব তহবিল থেকে টাকার যোগান দেবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সকল চাকরির জন্য পেনশন সুবিধা সৃষ্টি করতে অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। পেনশন ফান্ড সংক্রান্ত প্রস্তাবিত খসড়া শীঘ্রই মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। তিনি বলেন, প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে সরকারী চাকরিজীবীদের পেনশনের জন্য বড় অঙ্কের টাকা বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। এতে করে বাজেট বাড়তি চাপ তৈরি হয়। পেনশন নিয়ে দুর্ভোগও কম নয়। তাই এ সংক্রান্ত সব ধরনের ঝামেলা নিরসনে একটি পৃথক অধিদফতর গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই অধিদফতর পেনশন ফান্ড দেখভালসহ পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবে। শুধু তাই নয়, বেসরকারী খাতের চাকরিজীবীদের জন্য আলাদা আইন করে দেয়া হবে। ওই আইনের আওতায় তাঁরাও পেনশন সুবিধা পাবেন। বেসরকারী খাতে পেনশন বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করবে সরকার। পেনশনের টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এজন্য ব্যাংক-বীমা খাতকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে পেনশন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৬ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। প্রতিবছরই এ খাত বাজেটের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াও সামাজিক ঝুঁকি হ্রাসও বিবেচনায় রয়েছে সরকারের। বর্তমানে সরকারী চাকরিজীবী প্রায় ১৫ লাখ, যা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ। এরা পেনশন সুবিধা পান। অন্যদিকে, বেসরকারী খাতের ৯৫ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কোন পেনশন সুবিধা নেই। এ কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় প্রথম এ উদ্যোগের কথা জানান অর্থমন্ত্রী। ইতোমধ্যে ভারত, শ্রীলংকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় এ ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, ভারতের সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির আদলে বাংলাদেশে এটি প্রবর্তন করা হচ্ছে। ২০০৪ সালে সীমিত আকারে চালুর পর এ ব্যবস্থা কার্যকর করতে সাত থেকে আট বছর সময় লেগেছে ভারতের। বর্তমানে কলকাতা ও অসম ছাড়া বাকি সব রাজ্যে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জাপানের পুঁজিবাজারে মোট বিনিয়োগের ৫ দশমিক ৮ শতাংশই পেনশন ফান্ডের দখলে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ‘আইসিবি এএমসিএল পেনশন হোল্ডার ইউনিট ফান্ড’ নামে একটি পেনশন ফান্ড কর্মকা- চালাচ্ছে। এই ফান্ডের আকার ১৮ কোটি ৯৫ লাখ ৭৯ হাজার ২০০ টাকা। ১৮ লাখ ৯৫ হাজার ইউনিটের ফান্ডটি ইউনিট প্রতি ১০০ টাকা ফেসভ্যালু নির্ধারণ করে। ফান্ডটির এ্যাসেট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছে আইসিবি এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। গত বছরে ইউনিটপ্রতি ১৪ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে ফান্ডটি। তবে লাভজনক হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছে না এই পেনশন ফান্ড। তবে সরকারের নয়া উদ্যোগে এ ফান্ডের ইউনিট বিক্রিতে শীঘ্রই সাফল্য আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
×