ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বড় ঝুঁকিতে দেশ

ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি না হলেও তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৫ জানুয়ারি ২০১৭

ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি না হলেও তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক

শাহীন রহমান ॥ প্রতি বছর ছয় থেকে সাতটি মাঝারি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। এসব ভূমিকম্পের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। গত দুই বছরে সংগঠিত ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবগুলোর উৎপত্তি হয়েছে উত্তর পশ্চিম থেকে শুরু করে উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বদিকের সীমান্তবর্তী কোন এলাকা থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব এলাকা থেকে প্রায়ই বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। ২০১৫ সালের নেপাল ভূমিকম্প থেকে শুরু করে গত মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত ১৪টি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে দেশ। এর মধ্যে রিখটার স্কেলে পাঁচটি ভূমিকম্প ছিল শক্তিশালী। বাকিগুলো মাঝারি থেকে মৃদু ধরনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে এ বিষয়ে এখন আর কারও দ্বিমত নেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে ভূমিকম্পের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ভূমিকম্পের মধ্যে শক্তিশালী থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পই বেশি। যদিও এখন পর্যন্ত এসব ভূমিকম্পে বড় কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের চারদিক থেকেই যেভাবে ভূমিকম্প সৃষ্টি হচ্ছে তা দেশের জন্য অশানি সংকেত। বিশেষ করে উত্তর পশ্চিম, উত্তর পূর্ব ভারতে এবং দক্ষিণ পূর্বে মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য অশনি সংঙ্কেত হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব এলাকা থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পে আঘাত সরাসরি এসে পড়ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর। সৃষ্টি করছে আতঙ্ক। সাম্প্রতিককালে ভূমিকম্পের উৎপত্তি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ২০১৫ সালে নেপাল থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটি ছিল সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। ওই ভূমিকম্পে নেপালে প্রায় ১০ হাজার লোক নিহত হয়। বড় ধরনের ক্ষতি না হলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়ে। ঢাকা থেকে প্রায় ৭শ’ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে এবং নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ৮২ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিম থেকে এর উৎপত্তি হওয়ায় এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েনি। তবে দেশের উত্তর পশ্চিম এলাকাকে তারা ভূমিকম্পের জন্য অশানি সংকেতই মনে করছেন। একই বছরের ১২ মে নেপাল থেকে আরারও শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ায় ওই এলাকা তারা এখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই অভিহিত করছেন। ওই বছরের ২৬ অক্টোবর আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বত শ্রেণীর ভূ-পৃষ্ঠের ২১২ কিলোমিটার গভীর থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটি উপমহদেশ কাঁপিয়ে দেয়। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকাও কেঁপে ওঠে। গত বছর ৪ জানুয়ারি ভোর রাতে দেশের সবাই যখন ঘুমে তখন হঠাৎ ভূমিকম্পের প্রচ- ঝাঁকুনিতে আর ভবনের মটমট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় সবার। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রাস্তায় বেরিয়ে আসে অধিকাংশ মানুষ। রিখটার স্কেলে ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ভূমিকম্পটির উৎপত্তি স্থল ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে। যার দূরত্ব ঢাকা থেকে ৩৪৩ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এলাকাও বর্তমানে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছর ১৩ এপ্রিল শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে সারাদেশ। ৬.৯ মাত্রার ওই শক্তিশালী ভূমিকম্পটি ঢাকা থেকে ৪২০ কিলোমিটার পূর্বে মিয়ানমারে মাউলাইক শহরের ৭৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। স্থানটি বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা। গত মঙ্গলবার বেলায় তিনটা ৯ মিনিটে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের পর রাতে আবারও ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সারাদেশ। তবে প্রথমটি উৎপত্তির পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা এলাকা হলেও পরের ভূমিকম্পটি উৎপত্তি হয় মিয়ানমারের মাউলাইক এলাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের পর্যালোচলা করে দেখা গেছে দেশের চারদিকেই ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। এর বাইরের দেশের অভ্যন্তরেও রয়েছে একাধিক ঝুঁকি। সাম্প্রতিককালে যেসব এলাকা থেকে ভূমিকম্প সৃষ্টি হচ্ছে অতীতে সেসব এলাকা থেকে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার নজির রয়েছে। সম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বড় ধরনের ভূমিকম্প সংগঠিত হওয়ার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে ভূ অভ্যন্তরে অধিক শক্তি জমা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তের ভূমিকম্পের মাধ্যমে তা বের হয়ে আসবে। দেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প সংগঠিত হওয়ার কারণ হিসেবে তারা আরও বলছেন দেশের অভ্যন্তরে যেমন ভূ-তাত্ত্বিক গ্যাপ রয়েছে। দেশের বাইরে রয়েছে সংযোগ প্লেটের অবস্থান। বিশেষজ্ঞদের মতে অভ্যন্তরীণ গ্যাপ থেকে যেমন ভূমিকম্প হতে পারে। আবার বাউন্ডারি প্লেটের সংঘর্ষের কারণেও বড় ধরনের ভূমিকম্প সংগঠিত হয়ে থাকে। কারণ ভারত ও বর্মা প্লেটের সংযোগ স্থলে রয়েছে বাংলাদেশে অবস্থান। দেশের অভ্যন্তর থেকে গত ১ থেকে ৪শ’ বছরের মধ্যে একাধিক বড় ভূমিকম্প হয়েছে। আবার বাউন্ডারি প্লেটের সংঘর্ষের কারণেও প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছে। দেশের বাইরে থেকেও সংগঠিত হওয়া ভূমিকম্পের আঘাত বাংলাদেশের ওপর এসে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের ভেতরে এবং বাইরে যেসব গ্যাপ রয়েছে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এসব গ্যাপে নতুন করে আবার শক্তি সঞ্চয় হয়েছে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে সম্প্রতিকালে ভূমিকম্পের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি গবেষণায় দেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের একদল বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি তাদের গবেষণায় এ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন এ ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টি হলে দরিদ্র এ দেশের ১৪ কোটি মানুষের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তারা উল্লেখ করেছে ভারত প্লেটের পূর্বের এই অংশে বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হওয়ার যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক এ সব বিশেষজ্ঞদের এই গবেষণায় উঠে এসেছে ২০০৪ সালে যে ফ্রন্ট লাইন থেকে ভূমিকম্প সৃষ্ট সুনামি হয়েছিল সেই একই ফ্রন্ট লাইন থেকেই নতুন ভূমিকম্প সৃষ্টি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০০৪ সলে ওই সুনামিতে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। বিশেষজ্ঞরা এই সাবডাকশন জোনটির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটের ওপর গবেষণা চালিয়ে এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়েছিল সেটিও এই বিচ্যুতিরই ফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্লেটগুলোর গতি নির্ণয় করে দেখা গেছে ভারত প্লেট বছরে ৬ সেন্টিমিটার করে উত্তর পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। আর বর্মা প্লেট বছরে ২ সেন্টিমিটার করে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে আসছে। ভারত প্লেট যে পরিমাণ উত্তর পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই পরিমাণ ইউরেশিয়া ও বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে না। ফলে ভারত প্লেট ইউরেশিয়া বার্মা প্লেট বাউন্ডারিতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের ভেতরের ভূত্ত্বকে প্রচুর পরিমাণ শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন প্লেটের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ার কারণেই বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পন প্রবণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। তিনি বলেন দেশের বাইরে থেকেও উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প দেশের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
×