ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেতৃত্বদানকারী কমোডর এডব্লিউ চৌধুরীর স্মৃতিচারণ

অপারেশন জ্যাকপট পাকিস্তানীদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

অপারেশন জ্যাকপট পাকিস্তানীদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের মেরুদ- ভেঙ্গে দিয়েছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। নৌ কমান্ডোদের সফল এই অপারেশনে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে ডুবেছিল রসদ এবং অস্ত্র বোঝাই ৯টি জাহাজ। অচল হয়ে পড়ে বন্দর। ফলে পাকিস্তানীদের জন্য জাহাজযোগে সরঞ্জাম পাঠানোর কাজটিও থমকে যায়। এই অপারেশন বড়ই গৌরবের। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনায় আপ্লুত হয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম বন্দরে পরিচালিত সেই অপারেশন জ্যাকপটের নেতৃত্বদানকারী কমোডর এডব্লিউ চৌধুরী বীর উত্তম, বীর বিক্রম। শুক্রবার তাঁকে অতিথি করা হয় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে। জীবনঝুঁকির ওই অপারেশন বর্ণনায় তিনি ফিরে যান সেই একাত্তরে। অকুতোভয় এই বীর যোদ্ধা প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছিলেন বিরাট এই অভিযান। জানালেন, জীবনকে তখন তুচ্ছ মনে হয়েছিল। কারণ মানুষের জীবনে এরকম যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ তো বার বার আসে না। অপারেশন জ্যাকপট সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তুলে ধরেন এর প্রস্তুতি পর্ব থেকে শুরু করে সফল সমাপ্তি পর্যন্ত। জানালেন, সুদূর ইউরোপ থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ, অপারেশনের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং গোপন কৌশলের সফল বাস্তবায়ন। শ্রোতারাও শুনে যাচ্ছিলেন মুগ্ধ চিত্তে। কমোডর এডব্লিউ চৌধুরী বীর উত্তমের আলোচনায় পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে ওঠে আসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। বললেন, এই মহান নেতার স্পিরিচুয়াল পাওয়ার ছিল। তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাকে ফ্রান্সে সাবমেরিনের মধ্যেই আকৃষ্ট করেছিল। পাকিস্তানী যে সাবমেরিনে আমি নিযুক্ত ছিলাম তা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় ছিল ফ্রান্সে। আমরা মাত্র ১০ জন দেশের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। এর মধ্যে একজন অজুহাত দেখিয়ে সরে পড়ল। দলে থাকলাম নয়জন। আবার সেখান থেকে সিলেটের একজন চলে গেল ইংল্যান্ডে। রইলাম আটজন। আমরা জেনেভা, বার্সিলোনা হয়ে রোমে ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রাবিরতি শেষে ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়ে বম্বেতে উড়ে এলাম। শ্বাসরুদ্ধকর এ অপারেশনের বর্ণনায় আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এই নৌ কমান্ডার। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মানুষের জীবনে বার বার আসে না। মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্যও অনেকের হয় না। অপারেশন জ্যাকপটের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ভারতের মাটিতে। মোট ৩০০ জনকে ট্রেনিং দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মূল অভিযানে অংশ নেই আমরা ৬০ জন। প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতিমূলক পরিকল্পনার সবই হতো ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে। তবে খুবই সিক্রেট। যমুনা নদীর তীরে, কুতুবমিনারে আমাদের আটজন সাবমেরিনারের আলাদা ট্রেনিং হতো। মিত্রবাহিনীর টার্গেট ছিল আগস্টের মাঝামাঝি সময়েও জাহাজে আক্রমণ করা। একটি জাহাজে তিনটি করে ম্যাগনেটিক মাইন লাগানো হবে ছয় ফুট পানির নিচে। জাহাজগুলোকে টার্গেট করা হয় এগুলোতে পাকিস্তানীদের জন্য রসদ ও অস্ত্র বোঝাই রয়েছে বলে। তাছাড়া পাকিস্তানের জাহাজ আগমন ঠেকাতে বন্দর চ্যানেল অচল করাও ছিল লক্ষ্য। কমোডর এডব্লিউ চৌধুরী বলেন, অপারেশন জ্যাকপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল চট্টগ্রামের ডাঃ শাহ আলম। সে ছিল আমাদের ডেপুটি লিডার। শাহ আলম সাঁতার জানত না। আমি ভাগিরথী নদীতে তার পেটের তলে হাত রেখে তাঁকে সাঁতার শিখিয়েছি। আমরা চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হই ৬০ জন কমান্ডো নিয়ে। প্রথমে ট্রাকে চড়ে কলকাতা। সেখান থেকে বিমানে আগরতলা। তারপর হরিণা ক্যাম্প হয়ে বাংলাদেশে। বিমানে ওঠার পর জেনারেল অরোরা আমার কাঁধে হাত দিয়ে জানতে চান অপারেশন কোন্্ দিন হবে জানি কি না। এতে আমি বিস্ময় প্রকাশ করি। তখন তিনি বললেন ‘মে বি ফিফটিন’। এর আগে আমাকে দুটি গান নিয়মিত শোনানো হতো। গান দুটো হলোÑ ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম’ এবং ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’। ওই গান দুটিই ছিল আমাদের অপারেশনের প্রস্তুতি এবং শুরুর সংকেত। অপারেশন জ্যাকপট এখনও শিহরণ জাগায় নৌ কমান্ডোদের। তিনি বলেন, আমাদের ৬০ জনের কাছে ছিল একটি করে ডেটোনেটর ও লিমপেট মাইন্ড। কিছু স্টেনগান আর গ্রেনেড। অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় সফল হয়েছিল বিরাট এই অপারেশন। এ সফলতার পেছনে সহায়তা পেয়েছি চট্টগ্রামের রাজনীতিকদেরও। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ, হারিছ, মঈনুদ্দিন খান বাদল, ইঞ্জিনিয়ার আজিজ ও মতিনের নাম। এ অপারেশনের জন্য যারা গোলাবারুদ বয়ে এনেছিলেন তাদেরও অপারেশনাল কৃতিত্ব দেন তিনি। বললেন, আমার বডিগার্ড ছিল খুরশীদ। অপারেশন শুরুর আগে তাকে নিজের পিস্তলটি দিয়ে বলেছিলাম, ধরা পড়লে সে যেন শ্যুট করে দেয়। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা কর্ণফুলীর প্রবল স্রোত উপেক্ষা করেও ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় ঝাঁপিয়ে পড়ে গন্তব্যে যেতে পেরেছিলাম। আমরা ৩৩ জন মোট ১১টি জাহাজে মাইন লাগিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসি। কমোডর এডব্লিউ চৌধুরী যখন অপারেশন জ্যাকপটের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন উপস্থিত ছিলেন সেই অপারেশনে অংশ নেয়া আরও ৩ নৌ কমান্ডো। তারা হলেন নুরুল হক, জিলানী এবং আনোয়ার। তিনি বলেন, আমাদের কেউ আশ্বস্ত করেনি যে, আমরা আবার ফিরে আসব। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের নাম খরচের খাতায় রেখেই নেমেছিলাম এ অপারেশনে। অনেকটা বলির পাঁঠার মতো আরকি! সফল এই অপারেশন পাকিস্তানীদের মেরুদ- এবং মনোবল ভেঙ্গে দেয়। চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ায় ত্বরান্বিত হয় মুক্তিযুদ্ধের সফলতা। স্মৃতিচারণে এই বীর যোদ্ধা বলেন, বাঙালীদের ওপর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রতারণা করেছিল পাকিস্তানীরা। পরাক্রমশালী দাবিদার ওই বাহিনী ইউনিফর্ম পরেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এটি তাদের কলঙ্ক, এই কলঙ্ক তাদের পাওনা ছিল। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপট একটি মাইলফলক। এ অপারেশনকে প্রজন্মের জন্য ধরে রাখতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের।
×