ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এবার অধিকাংশ শিক্ষকই সরকারী দলের অনুসারী

টিআইবির মতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ নেয়া হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

টিআইবির মতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ নেয়া হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে ৩ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ এনেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক নিয়োগে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হলো। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য দিতে না পারলেও সংস্থাটি বলেছে, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। যেখানে নিয়োগে তিন লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। বিভিন্ন খাতে অনিয়মের অভিযোগ তোলার ধারাবাহিকতায় রবিবার রাজধানীর ধানম-িতে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ অনিয়মের কথা তুলে ধরেন টিআইবির কর্মকর্তারা। ‘সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির দুই গবেষক দিপু রায় ও রেযাউল করিম। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোস্তফা কামাল প্রমুখ। ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের ঘটনা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেছেন, তবে গবেষণাটি করা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়োগের আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম শুরু হয়। নিয়োগ বোর্ড গঠন, সুবিধামতো যোগ্যতা পরিবর্তন বা শিথিল করা, জবাবদিহি না থাকার মাধ্যমে এই অনিয়মের শুরুটা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের সুযোগ বিদ্যমান ছিল। নিয়োগের আগেই আরও যেভাবে অনিয়ম শুরু হয় তারও কিছু চিত্র তুলে ধরা হয় এই প্রতিবেদনে। বলা হয়, কোন কোন শিক্ষক পছন্দের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করেন এবং পরবর্তী সময়ে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া বাজার করাসহ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে আগে থেকেই একাডেমিক পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে নারী শিক্ষার্থীর একাংশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে একাডেমিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্ন জানানো ও পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এসব অনিয়মের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর সুযোগ থাকলেও সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে সিন্ডিকেট নিয়োগ চূড়ান্ত করে। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২টিতেই কোন না কোন নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘নোট অব ডিসেন্ট’কে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়নি। এছাড়া ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিজ্ঞপ্তির চেয়েও বেশি শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দল ভারি করা এসব অনিয়মের একটি বড় প্রভাবক। প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরে প্রভাষক নিয়োগে সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ নিয়োগ বিধিমালা করার দাবি জানানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সার্বিক চিত্রটি হতাশাব্যঞ্জক ও উদ্বেগজনক। তিনি প্রভাষক নিয়োগে সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ নিয়োগ বিধিমালা করার দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের সুযোগ বিদ্যমান ছিল। কোন কোন শিক্ষক পছন্দের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করেন এবং পরবর্তীতে এদের নিয়োগ দেয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে তিন থেকে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের ঘটনা ঘটছে। অর্থ লেনদেনের সঙ্গে উপাচার্য, শিক্ষক নেতা, রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, ছাত্রনেতাসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য সংগ্রহ করে আটটিতে শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতা, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ লেনদেনের তথ্য পায়া গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থাৎ উপাচার্যের অভিপ্রায়ই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। শিক্ষাবিদ ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা বলছে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা বাস্তব। কত শতাংশ অনিয়ম-দুর্নীতি হলো, সেটা বিচার করছি না। কারণ নিম্ন মেধার একজন শিক্ষক নিয়োগ হলে প্রায় ৪০ বছর ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেয়া থেকে বঞ্চিত করবেন। তাই এ ধরনের একটি ঘটনা হলেও তা মানতে চাই না। এটি অশনিসংকেত। উল্লেখ্য, এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক আদেশে অনিয়ম বন্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার সঙ্গে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের কথা জানিয়েছিল। নিয়োগে স্বচ্ছতা আনা এবং রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত অপরাধীদের নিয়োগ বন্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করতেও নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন ও সুপারিশের পর এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করে। জানা গেছে, সরকারী সকল নিয়োগের আগে প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন করার বিধান থাকলেও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়ের নিয়োগে তা করা হয় না। যেখানে নিয়োগে নেই কোন লিখিত পরীক্ষাও। এমন অবস্থায় ফাঁকফোকর দিয়ে নানা উপায়ে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত উগ্রবাদী ব্যক্তি নিয়োগ পেয়ে যায় বলে সম্প্রতি সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নও করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। ইউজিসি সচিবকে পাঠানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ইদানিং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অনভিপ্রেত অবস্থার সমাধানকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে পাওয়া গোয়েন্দা বিভাগের গোপনীয় প্রতিবেদনে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার লক্ষে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয় এতে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলে প্রার্থীর মেধা যাচাই করা সহজ হবে এবং অনিয়মের সুযোগ হ্রাস পাবে। শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ॥ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ ও সব স্বীকৃতি পাওয়া প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি আউয়াল সিদ্দিকী বলেন, অবিলম্বে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত, শিক্ষক ও কর্মচারীদের মতো বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, চিকিৎসা ভাতা, বৈশাখী ভাতাসহ বিএড ডিগ্রিধারীদের উচ্চতর বেতন দিতে হবে। দাবি আদায়ে কর্মসূচী ঘোষণা করে সভাপতি বলেন, আগামী মাসের ৫ তারিখে সারাদেশের উপজেলা সদরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিলকিস জামান, সহসভাপতি অধ্যক্ষ সমরেন্দ্র নাথ, শিক্ষক আব্দুল খালেক প্রমুখ।
×