ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সবাই জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে- বিষয়টি এমনও নয়

সাম্প্রতিক দু’শ’র বেশি নিখোঁজ তরুণের কেউ কেউ ফিরছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬

সাম্প্রতিক দু’শ’র বেশি নিখোঁজ তরুণের কেউ কেউ ফিরছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর কদমতলী থেকে নিখোঁজ যুবক রেদোয়ান করিম পরিবারের কাছে ফিরেছে। এর আগে পাবনা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র জাকির হোসেনও নিখোঁজের পর পরিবারের কাছে ফেরার ঘটনা ঘটেছে। পর্যায়ক্রমে অনেকেই এভাবে পরিবারে ফিরে আসতে পারে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা। নিখোঁজের প্রকৃত কোন সংখ্যা জানা যায়নি। তবে পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান মোতাবেক পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী শিক্ষিত তরুণদের নিখোঁজের সংখ্যা দু’শর বেশি। এদের মধ্যে প্রায় শ’খানেক নিখোঁজ তরুণ জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছে। যাদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। বাকিরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, নিরাপত্তাজনিত কারণে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ রয়েছে। অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে রয়েছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি রাজধানী থেকে কয়েক তরুণ আচমকা নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই নিখোঁজদেরই একজন রেদোয়ান করিম। রেদোয়ানও অন্যদের মতো নিখোঁজ হয়েছিল। তবে গত ১৩ ডিসেম্বর পরিবারের কাছে ফিরে আসে রেদোয়ান করিম। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে রেদোয়ান মাদকাসক্ত। বান্ধবীকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলেন। পরিবারের কাছে বিষয়টি লুকাতে তিনি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হন। তবে রেদোয়ান কতদিন নিখোঁজ ছিল তা প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি। জানার চেষ্টা চলছে। বান্ধবীকে নিয়ে কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া ছাড়াও রেদোয়ানের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে অন্য কোন রহস্য আছে কি-না সে বিষয়টি জানতে কাজ করছে সিটিটিসি। রেদোয়ান কতদিন নিখোঁজ ছিল, তা জানা যায়নি। নিখোঁজের বিষয়ে কোন জিডি হয়নি। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, একইভাবে ইতোপূর্বে নিখোঁজ পাবনা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেনও ফিরে এসেছে। তার পিতা থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। জাকির হোসেন প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছায় নাকি অন্যকোন কারণে নিখোঁজ হয়েছিল তা জানা যায়নি। যদিও জাকির হোসেন, তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের দাবি, টাকার জন্য প্রায়ই জাকির হোসেন এভাবে নিখোঁজ হয়ে যেত। এক উর্ধতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, জাকির হোসেন নিখোঁজের পর একটি রেলস্টেশনের কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। ফুটেজে দেখা যায়, জাকির বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে রেলস্টেশনে যায়। সেখানে এক মোটরসাইকেলযোগে আসে। হেঁটে আসে আরেকজন। এরপর একটি মাইক্রোবাসে চড়ে তারা তিনজনই চলে যায়। মাইক্রোবাসে আরও লোকজন ছিল। যে মাইক্রোবাসে চড়ে জাকির নিখোঁজ হয়েছিল, ওই ধরনের মাইক্রোবাস আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও অপরাধী চক্রের মধ্যেও ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। জাকির স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছিল বলে প্রাথমিক পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসে। পরবর্তীতে নানা তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে, তাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে থাকতে পারে। আবার তাকে সুনির্দিষ্ট কোন কাজ দিয়ে আবার ফেরত পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। এর সঙ্গে অপরাধী চক্রও জড়িত থাকতে পারে। তবে কে বা কারা তাকে নিয়ে গিয়েছিল বা কাদের সঙ্গে গিয়েছিল তা জানার চেষ্টা চলছে। পরবর্তীতে জাকির মূলত ঢাকা থেকে উদ্ধার হয়। আর জাকিরকে কারা- কিভাবে ঢাকার কোথা থেকে উদ্ধার করল, সে বিষয়টিও রহস্যের জন্ম দিয়েছে। উদ্ধারের পর তাকে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। যদিও জাকির হোসেন স্বেচ্ছায় বাড়ি গেছেন এবং স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছিলেন বলে প্রকাশ পেয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, এর আগে ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে একসঙ্গে চার তরুণ সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসেন খান পাভেল, সুজন ও মেহেদী নিখোঁজ হয়। সাফায়েত ও পাভেল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। গত ৫ ডিসেম্বর বনানী থেকে নিখোঁজ হয় সাঈদ আনোয়ার খান নামে আরেক তরুণ। এছাড়া গত ৩০ নবেম্বর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটার বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ রয়েছে ইমরান ফরহাদ নামের আরেক তরুণ। ইমরান মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী। সূত্র বলছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে এবং কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের পর নিহত জঙ্গীরা ঘটনার অনেক আগ থেকেই নিখোঁজ ছিল। এরপর থেকেই নিখোঁজ তরুণরা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ছে বলে ধারণার জন্ম হয়। এমন ঘটনার পর সারাদেশের প্রতিটি থানাকে পুলিশ সদর দফতর থেকে বিশেষ নোটিস পাঠিয়ে নিখোঁজের তালিকা চাওয়া হয়। নোটিস মোতাবেক পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী তরুণ ও তরুণীদের নিখোঁজের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। নিখোঁজদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত এবং ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিতদের বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। সেই হিসেব মোতাবেক সারাদেশে নিখোঁজ তরুণ ও তরুণীর সংখ্যা দু’শর বেশি। পুলিশ সদর দফতরের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিখোঁজদের মধ্যে শ’খানেক তরুণ-তরুণী জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যাদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন বিদেশে চলে গেছে। বনানী থেকে নিখোঁজ সাফায়েতের ফেসবুক পর্যালোচনা করে সে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মূলত কারা তাদের কি উদ্দেশে নিখোঁজ হতে উদ্বুদ্ধ করছে, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে গুরুত্বের সঙ্গে। যদিও এখন পযন্ত এমন কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যে কিনা শিক্ষিত তরুণদের বিশেষ মন্ত্রে দীক্ষিত করে নিখোঁজ হয়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহী করছে।
×