ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কমিশনে সাক্ষ্য দেয়ায় ৩০ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে আটক

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটাতে আরএসওর মায়াকান্না, নানা ফন্দিফিকির

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটাতে আরএসওর মায়াকান্না, নানা ফন্দিফিকির

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমারে সফরকালে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে বিশেষ কমিশনকে সেখানে যেসব রোহিঙ্গা সাক্ষ্য দিয়েছে, দেশটির সেনা সদস্যরা তাদের ৩০ জনকে ধরে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তার সঠিক তথ্য পাচ্ছে না তাদের স্বজনরা। শনিবার উত্তর মংডুর কিয়ারিপ্রাং এলাকার ৪০ রোহিঙ্গা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের সামনে উপস্থিত হয়ে দেশটির সেনা ও পুলিশের বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দেয়। মিয়ানমারে শান্তি ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঐ ঘটনার পর আবারও উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। এদিকে বিজিবি-কোস্টগার্ডের কড়াকড়িতে সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটাতে না পেরে প্রশাসনের নজর কাড়তে নাফ নদে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌ-ডুবিসহ নানা ফন্দি আঁটছে আরএসও এবং দালাল চক্র। ওসব ভুয়া তথ্যে স্থানীয়দের কান ভারি করার অপচেষ্টা চললেও তবে সীমান্তরক্ষী বিজিবি ও পুলিশ কথিত সংবাদের সঙ্গে বাস্তবে মিল নেই বলে জানিয়েছে। সূত্র জানায়, মিয়ানমারে প্রায় দেড়মাস ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর নানা নির্যাতনের পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটাতে আরএসও’র মায়াকান্না চলছে। তারা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটাতে নানা ফন্দি-ফিকির করে চলছে। রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ (আরএসও) অতীতেও বিভিন্ন কা- ঘটিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সেবার নামে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা এনেছে। তন্মধ্যে কিছু অংশ রোহিঙ্গাদের বিলিবন্টনের ফটো সেশন করে বিদেশে পাঠিয়ে সিংহভাগ টাকা আত্মসাত করেছে আরএসও ক্যাডাররা। ওসব ত্রাণ ও নগদ টাকা বিলি করার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন বহু রোহিঙ্গা ও আরএসও নেতাকে আটক করেছে। বর্তমানে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকারের কঠোর মনোভাব এবং সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কড়াকড়ি অবস্থা দেখে আরএসও ক্যাডাররা নাফ নদে নৌ-ডুবির নাটকসহ বিভিন্ন কল্পকাহিনী সাজিয়ে চলছে। যাতে মানবিক কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটানো সহজ হয়। বিজিবি জওয়ানরা সোমবার ভোরে রোহিঙ্গা বোঝাই চারটি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে মিয়ানমারে। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে রোহিঙ্গাদের পুঁজি করার সুযোগ নিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ সক্রিয় বলে গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও রিপোর্ট রয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। চার নৌকা বোঝাই রোহিঙ্গা ফেরত ॥ টেকনাফ উপজেলার তিনটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে মিয়ানমার নাগরিক বোঝাই চারটি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। সোমবার ভোরে টেকনাফের নাফ নদীর তিনটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ওসব নৌকায় করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, ভোরে নাফ নদীর জাদিমুরা সীমান্তের তিনটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে মিয়ানমার নাগরিক বোঝাই চারটি নৌকা ফেরত পাঠানো হয়। প্রতি নৌকায় ১০ থেকে ১২ জন করে রোহিঙ্গা ছিল বলে জানান বিজিবির এ কর্মকর্তা। নৌ-ডুবির নাটক ॥ সোমবার ভোরে নাফনদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির খবরে গোটা কক্সবাজার জেলার সর্বত্র ঝড় বয়ে যায়। টেকনাফের বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশ ছাড়াও সংবাদকর্মী, জেলে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উৎসুক লোকজন ভিড় করে টেকনাফের জাদিমুরা এলাকায়। কথিত ওই ঘটনায় ২০-২২ বছরের এক নারীকে উদ্ধার ও ৩৪ জন রোহিঙ্গা নিখোঁজ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া নারী রেহেনা বেগম জানায়, ৩৫ জনের একটি দল বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মিয়ানমার থেকে একটি নৌকায় করে রওনা দেয়। নাফ নদীর মাঝপথে এসে ডুবে যায়। সে সাঁতরিয়ে জেলেদের নৌকায় উঠে টেকনাফের জাদিমুরায় আসে। এরপর তিনি আর কিছুই জানেন না। বিজিবি তাকে উদ্ধার করে ব্যাটালিয়ন হেফাজতে রেখে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ৩৫ জনের নৌকাটি নদীতে ডুবে গেলে শুধু একজন নারী কেন সাঁতরিয়ে কূল ধরতে পেরেছে? ওই নৌকায় থাকা পুরুষরা গেল কোথায়? ধেয়ে আসা দলের মধ্যে নিশ্চয় শিশুরাও থাকবে, তারাতো সাঁতার জানে না। ওইসব শিশু বা কারও জীবিত বা মৃতদেহ নাফ নদীতে টহলে থাকা বিজিবি কোস্টগার্ডের সদস্যরা খুঁজে পাচ্ছে না কেন? তথাকথিত ঘটনা সৃষ্টি করে আরএসও ক্যাডাররা স্থানীয় বাসিন্দা এবং প্রশাসনের নমনীয়তার সুযোগ খুঁজছিল বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও অভিজ্ঞজনরা। তারা আরও জানান, জাদিমুরা ঘাট থেকে উদ্ধার রোহিঙ্গা নারী রেহেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়ত অসল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার ওসি মোঃ আবদুল মজিদ সোমবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, লোকেমুখে ঘটনার খবর শুনে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছি। তারা সত্যতা পায়নি। এছাড়া বিজিবি-কোস্টগার্ড কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে দেখেছি, তারাও কথিত ঘটনার সত্যতা খুঁজে পাননি বলে জানিয়েছেন। স্থানীয় ইউপি মেম্বার মোহাম্মদ আলী লোকজনের কাছ থেকে নৌকা ডুবির খবর শুনেছেন তবে সত্যতা পাননি। কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লে. নাফিউর রহমান নৌ-ডুবির ঘটনা শুনে তাদের টহল বোট নিখোঁজদের সন্ধান চালিয়েছে। কিন্তু কোন জীবিত বা মৃত রোহিঙ্গা নাফ নদীতে ভাসমান অবস্থায় দেখা মিলেনি। ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে অব্যাহত সহিংসতায় ২ মাস ধরে টেকনাফ-মংডু বর্ডার পাস এবং ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে টেকনাফ স্থলবন্দরের কার্যক্রম শিথিল হয়ে পড়েছে। কমে গেছে আমদানি রফতানি। সরকার প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি মিয়ানমারের সহিংস ঘটনায় টেকনাফ স্থলবন্দর ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের কাছে আটকা পড়েছে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে আকিয়াব থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে ব্যবসায়ীরা। টেকনাফ স্থল বন্দরের দায়িত্বে থাকা অভিবাসন ট্রানজিট কর্মকর্তা মোঃ হোসেন জানান, মিয়ানমারে সহিংস ঘটনার পর দুই মাস ধরে টেকনাফ টু মংডু বর্ডার পাস ও ট্রানজিট যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে মিয়ানমারের অভিবাসন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। সেই দেশের সহিংস ঘটনা ও সংঘাত কমে আসলে পুনরায় বর্ডার পাস এবং ট্রানজিট যাতায়াত চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন মিয়ানমারে দায়িত্বে থাকা দেশটির কর্মকর্তারা।
×