ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় র‌্যালিতে উত্তাল রাজপথ ॥ শিখা চিরন্তনে দৃপ্ত শপথ

পহেলা ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস দাবি মুক্তিসেনাদের

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

পহেলা ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস দাবি মুক্তিসেনাদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ডিসেম্বরের প্রথম দিনই সারা দেশে শুরু হয়েছে বিজয়ের আনন্দ। রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেছে একাধিক বর্ণাঢ্য বিজয় র‌্যালি। সকাল থেকেই চারদিকে উৎসবের সুর। লাল-সবুজে সেজে তরুণ-তরুণীরা স্লোগানে স্লোগানে উত্তাপ ছড়িয়েছে। সবই একাত্তরের। রক্তে আগুন জ্বালানো উদ্দীপনাময় একাত্তরের স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল ছিল রাজপথ। শহরের রাস্তায় গর্জে উঠেছিল আবারও সেই মুক্তিযোদ্ধারা। তারা দৃঢ় প্রত্যয়ে নিয়েছেন শপথ। শিখা চিরন্তনে দাঁড়িয়ে এই শপথে শামিল হয়েছে এই সময়ের তরুণেরা, শিশুরাও। সুউচ্চে হাত তুলে বলেছে তারা- অপশক্তি রুখে দাঁড়াতে হব সোচ্চার। একই সঙ্গে সবার কণ্ঠে ছিল দাবি আদায়- ‘পহেলা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস চাই’। ডিসেম্বরের প্রথমদিনে চারদিকে বয়ে চলা জয়ের এ আনন্দের চিত্রপট ছিল ঠিক এমনটাই। উৎসবমুখর পরিবেশেই কেউ কেউ ছক আঁকছেন মাসব্যাপী মহা কর্মযজ্ঞের। সভা-সমাবেশ। বাতাসে ধ্বনিত স্লোগান, সারাদেশের ঘরে ঘরে চলছে এখন দেশের গান। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে বৃহস্পতিবার রাজধানীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণে এক বর্ণাঢ্য বিজয় র‌্যালি হয়েছে। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে র‌্যালির উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। র‌্যালিটি সচিবালয় লিংক রোড থেকে শুরু হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় প্রত্যয়ে শপথ বাক্য পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অক্ষুণœ রাখতে এ সময় তারা দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ করে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এক বর্ণাঢ্য বিজয় র‌্যালি হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দেন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা এই র‌্যালিতে অংশ নেয়। ওই র‌্যালিটিও শিখা চিরন্তনে গিয়ে শেষ হয়। পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দেশের তরে কাজ করার জন্য শপথ করেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে আরেকটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি হয়, র‌্যালিটি বিভিন্ন শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় র‌্যালি ॥ মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় র‌্যালি থেকে বিভিন্ন সেøাগান দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের পোশাক ছিল লাল-সবুজের। বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করার সময় তারা তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোচ্চার থাকার আহ্বান জানান। র‌্যালির শুরুতে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণার দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, যারা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যে কোন মূল্যে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যাতে কোনক্রমে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক থাকতে হবে। ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধী এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের মতো জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে খালেদা জিয়াকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মৃক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আজকে ধর্মের নামে মিথ্যাচার করে, পবিত্র ধর্মকে কলঙ্কিত করে ইসলামের নামে যারা মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাস কায়েম করছে, জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করছে, এর সবই জামায়াতে ইসলামীর অঘোষিত আমির খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে হচ্ছে। আমরা যদি ৪৪ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারি, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করতে পারি, জাতির কাছে এই প্রতিশ্রুতি দেবÑ এই জঙ্গীবাদের যারা পৃষ্ঠপোষক তাদের বিচারও এই বাংলার মাটিতে হবে। কেবল জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীতের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন দেশ স্বাধীন হলে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি হবে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পরিপূর্ণরূপে গড়ে তুলতে পারেননি। এর পূর্বেই ঘাতকেরা ১৫ আগস্ট তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তবে আওয়ামী লীগ থাকাকালে কখনও সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না বলেও জানান আ ক ম মোজাম্মেল হক। ভারতের মিত্রবাহিনী ও তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীকে স্মরণ করে মন্ত্রী বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য যদি সারা পৃথিবী না ঘুরতেন, তাহলে মাত্র নয় মাসে স্বাধীন করা সম্ভব ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের দাবি ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন। ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মমতাজউদ্দিন আহমেদ ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি। মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণার দাবি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চের ॥ বিজয়ের মাসের প্রথম দিনকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার দাবি জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চ নামের একটি সংগঠন। এই দাবির সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করেছেন একাধিক মন্ত্রী। একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, এটি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের দাবি। সরকারকে দ্রুত সময়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকা-ের জন্য বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বীরউত্তম খেতাব কেড়ে নেয়ার দাবি তুলেছেন খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চ আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এ দাবি জানান। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। অনুষ্ঠানে ১ ডিসেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুল মালেক মিয়াসহ অন্যরা। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। একাক্তরের ঘাতকদের ক্ষমতায় বসানো, গোলাম আযমকে ফিরিয়ে এনে নানা কর্মকা- প্রমাণ করে জিয়া পাকিস্তানের পরাজিত শক্তিকে পুনরায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করে বীরউত্তম খেতাব অর্জন করলেও পঁচাত্তর পরবর্তী এসব কর্মকা-ের কারণে মেজর জিয়ার এই রাষ্ট্রীয় খেতাব কেড়ে নেয়া হোক। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হবে আমাদের ঐক্যের ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু আমাদের আদর্শ, আর শেখ হাসিনা হবেন তার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র নয় মাসে। কিন্তু সেই যুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা এখনও রয়ে গেছে। তারা যতদিন থাকবে, এ যুদ্ধের শেষ হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জিয়াকে অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানী আখ্যা দিয়ে শাজাহান খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী গোষ্ঠীকে চিরতরে নির্মূল করা আমাদের লক্ষ্য। বিরোধী গোষ্ঠীকে নির্মূল না করা পর্যন্ত আমাদের এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান এখন আমাদের কাছে টাকা দাবি করে। এ যেন উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে, তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। আমরা যখন ১৯৫ জন পাকিস্তানীর বিচার দাবি করছি তখন আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তারা প্ররোচনামূলক বক্তব্য দিচ্ছে। মুক্তিযুুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় সরকার ক্ষমতায় ছিল না। এ সময় সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশ ঘটেছে। তারাই নানা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমানেই তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এজন্য ভবিষ্যত প্রজন্মকে এখন থেকেই তাদের রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। আলোকচিত্র প্রদর্শনী ॥ বিজয়ের মাসের প্রথমদিনে রাজধানীর সামরিক জাদুঘরে ‘বঙ্গবন্ধু ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত আলোকচিত্র প্রদর্শনী’ শিরোনামে স্থির ও ভিডিও চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এছাড়া তিন বাহিনীর প্রধান, সামরিক ও অসামরিক উচ্চ পদের কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীসহ আনুমানিক ৮০০ দর্শক উপস্থিত ছিলেন।
×