ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলকাঠি নাড়া হচ্ছে চাঁপাই থেকে

নয়া জঙ্গীগোষ্ঠী ‘কেতাল’

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১১ নভেম্বর ২০১৬

নয়া জঙ্গীগোষ্ঠী ‘কেতাল’

স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ এবার উত্তরাঞ্চলের নতুন জঙ্গী সংগঠন ‘কেতাল’। নব্য জেএমবির সদস্যরা এখন দলে দলে এই নতুন সংগঠনে যোগ দিয়ে দৃশ্যমান কাজ শুরু করেছে। নতুন এই দলের কেন্দ্রীয় কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সন্ত্রাসের অন্যতম জনপদ শিবগঞ্জের একাধিক এলাকা থেকে। শিবগঞ্জের সীমান্ত জুড়ে খুবই জোরেসোরে চলছে সদস্য সংগ্রহের কাজ। এই নব্য জঙ্গী সংগঠনটিকে মদদ দিচ্ছে ভারতীয় জঙ্গীরা। গত ২ নবেম্বর বুধবার রাতে কোচে ঢাকা পৌঁছে দারুস সালাম এলাকায় আটক চার জঙ্গীর কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছে নতুন দল গঠনের তথ্য। এরাই শুলশান ও শোলাকিয়ায় অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। মূলতঃ এই জঙ্গীরা প্রথম জীবনে একটি মৌলবাদী দলের সদস্য থাকাকালে তালেবানের অনুসারী হয়ে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে জেএমবির সদস্য হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তীতে ভারতীয় এলাকায় অবস্থানকারী জঙ্গীদের ইশারায় গড়ে তুলে নতুন জঙ্গী সংগঠন ‘কেতাল’। কেতাল শব্দটি এসেছে আরবী থেকে। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এদের সকলেই রহস্যজনকভাবে অনেক আগেই বাড়ি থেকে উধাও হয়েছে। পরে পরিবার থেকে জানানো হয়, মাস দুয়েক আগে কে বা কারা সাদা পোশাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় তাদের। উদ্দেশ্য একটাই যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে বা পাড়া পড়শীরা বুঝতে না পারে তারা জঙ্গী দীক্ষাধারী হয়ে অজানার উদ্দেশে সাংগঠনিক কাজ করতে চলে গেছে। এ মাসের দুই তারিখ ঢাকার দারুস সালামে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর পরিবারের সদস্যরা নড়েচড়ে বসে। তারা এখন নতুন ধরনের তথ্য দেয়া শুরু করেছে। যেমন আটক হাজারদিঘীর চাঁদপুর এলাকার আবু তাহেরের স্ত্রী শাবানা বেগম বলার চেষ্টা করছে গত ২ মাস ১০ দিন আগে স্বামীকে (তাহের) বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন। তার পর থেকেই তাহের নিখোঁজ। ধোবড়া কলেজপাড়া এলাকার মিজানের স্ত্রী আয়েশা বেগম, অপর জঙ্গী সেলিম মিঞার স্বজনেরা একই ধরনের কথা বলেছে। তবে সেলিম সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের শ্রমিক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। অভিযোগ রয়েছে আমদানিকারকদের মাধ্যমে বৈধ পণ্যের আড়ালে আসা অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদক জাতীয় দ্রব্য সরিয়ে অন্য ট্রাকে তুলে দেবার নিপুণ কারিগর ছিল। বন্দরে এখনও তার অনুসারীরা একই কাজ করে থাকে বলে জানা গেছে। বন্দরে একাধিক শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে গোপনে রয়েছে নাকি জঙ্গী সংগঠন। ঢাকায় ধরা পড়া অপর জঙ্গীর নাম তৌফিকুল ইসলাম। গ্রাম্য ডাক্তার হবার সুবাদে তাকে ডাঃ তৌফিক বলা হয়। সে মোবারকপুর ইউনিয়নের গোয়াবাড়ী চাঁদপুর এলাকার সেকান্দার আলীর ছেলে। মূলত গ্রাম্য ডাক্তার হলেও তৌফিক নাকি দাঁতের চিকিৎসায় খুবই দক্ষ ছিল। স্বজনেরা সকলেই বলার চেষ্টা করেছে তারা দৃশ্যমান কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিল না। গ্রামীণ জনপদে নানান পেশার মধ্যে থেকে সকলের চক্ষুর আড়ালে জঙ্গী সংগঠন করে বেড়াত এরা। যার কারণে প্রতিটি গ্রামের সাধারণ মানুষ বলার চেষ্টা করেছে, তারা ভাল মানুষ ছিল। এরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। তবে এলাকায় গিয়ে ঘুরার সময় অনুসন্ধানে জানা গেছে বেশ কয়েক বছর ধরেই শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের হাজারদীঘি, চাঁদপুর, আজমতপুর, ধোবড়া ও মোবারকপুর ইউনিয়নের গোয়াবাড়ী, চাঁদপুর এলাকায় তারা অর্থাৎ ধরা পড়া জঙ্গীরা সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে একদিন আগে রোজা রাখাসহ একদিন আগে দুটি ঈদ পালনে এতদিন উৎসাহ গ্রামবাসীকে যুগিয়ে আসছিল। তাদের পোশাক আশাক ও বেশভূষাতেও ভিন্নতা ছিল। মাথায় বড় চুল রাখা ও নানা রঙের পাগড়ি ব্যবহার করত। এসব নিয়ে স্থানীয় মুসল্লিদের সঙ্গে তাদের বচসাসহ দ্বন্দ্বও ছিল। এরা এলাকা জুড়ে কবরস্থান জিয়ারত না করা এবং নামাজ শেষে দোয়া না করে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মুসল্লিদের প্রভাবিত করে আসছিল। এ ছাড়াও ধর্মীয় ব্যাপারে সনাতন বিষয়গুলো নিয়ে সাংঘর্ষিক বক্তব্য দেবার চেষ্টাও করত। এসব কাজের আড়ালে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল জঙ্গীবাদকে আরও সম্প্রসারিত করা। একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে শিবগঞ্জের সীমান্ত জুড়ে যেসব বিচ্ছিন্ন গ্রামের অবস্থান সেখানে তালেবান মতাদর্শের লোকজনে ঠাসা। এইসব লোকজন আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের জনপদ শিবগঞ্জ এলাকায় ইতোপূর্বে বিএনপি জামায়াতের ডাকা আন্দোলন ও বিক্ষোভে প্রথম সারিতে অবস্থান করত। এসব গ্রামে প্রায় নিত্য নতুন লোকজনের সমাগম হয়ে থাকে। তারা নির্দিষ্ট বাড়িঘরে বৈঠক করে রাতের অন্ধকারে চলে যায়। শিবগঞ্জে এসব সীমান্ত দিয়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বড় চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের ইশারায় টাকার বিনিময়ে অস্ত্র, বিস্ফোরক, নানান ধরনের মাদক ও জাল টাকা বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে থাকে। শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) সারোয়ার জানান, সম্প্রতি ঢাকার দারুস সালাম এলাকায় আটক চার জঙ্গীর গ্রামের বাড়ী শিবগঞ্জ এলাকায় হলেও থানায় তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। এটাও এক ধরনের রহস্যজনক ব্যাপার। এমনকি পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে সরবরাহকৃত জেএমবির তালিকায় তাদের কোন নাম নেই। শিবগঞ্জ পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ইতোমধ্যে মাঠে নেমে খোঁজ নেবার চেষ্টা করছে। পুরো শিবগঞ্জ জুড়ে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সাংগঠনিক তৎপরতা বা সংখ্যা নিয়ে এখন পর্যন্ত গোয়েন্দারা কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে পুরো শিবগঞ্জ জুড়ে যে সব জঙ্গী সংগঠন রয়েছে তারা পুলিশের নজর এড়িয়ে বিভিন্ন এলাকায় সদস্য সংগ্রহসহ কাজ করার চেষ্টা করছে। যার কারণেই ধরাপাড়া জঙ্গী পরিবার নানান ধরনের মুখরোচক গালগল্প ও কাহিনী জুড়ে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে।
×