ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একে একে বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

একে একে বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল

অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে খুলনার সোসাইটি সিনেমা হল। এর পোশাকি নাম ‘করোনেশন হল’। আর এই হলের সঙ্গে ‘নাট্য নিকেতন’ নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন যুক্ত আছে। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে জেলা প্রশাসন। ১৯২৯-৩০ সাল থেকে করোনেশন হল ভাড়া নিয়ে ছায়াছবি প্রদর্শিত হয়ে আসছে। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে প্রথমে ‘মুক’, পরে ‘বাণী সিনেমা’ এবং শেষে ১৯৪৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ‘সোসাইটি সিনেমা’ নামে করোনেশন হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ব্যক্তি মালিকানায় স্থাপিত ‘উল্লাসিনী’ ও ‘নীলা’ (পরবর্তীতে পিকচার প্যালেস) সিনেমা হল অনেক আগে বন্ধ হয়ে গেছে। দর্শক হারিয়ে বন্ধ হয়েছে খুলনার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা আরও ১৪-১৫টি সিনেমা হল। বন্ধের পর অবকাঠামো বিলুপ্ত হয়েছে স্টার ও বৈকালী সিনেমা হলের। খুলনায় কোন মতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে পাঁচটি সিনেমা হল। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে খুলনা শহরের গোড়াপত্তন হয়। কলকাতা কাছাকাছি হওয়ায় খুলনায় কলকাতা কেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চা গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। ১৯০০ সালের দিকে বিমলানন্দ দাশগুপ্ত, কুঞ্জ বিহারী মুখার্জী, জানকি নাথ গুহ, প্রিয় নাথ দাশ, হরিমোহন সেন গিরিজা নাথ ঘোষ, জগদীশ চন্দ্র মিত্র প্রমুখের চেষ্টায় ‘খুলনা থিয়েটার’ তোলা হয়। ১৯০৫-১৯০৬ সালের দিকে খুলনা থিয়েটারের সংগঠকরা তহবিল সংগ্রহ করে বর্তমান করোনেশন হলের জায়গা অস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে ঘর তৈরি করে সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিচালনা করে। এর কিছুদিন পর খুলনা পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন বাংলার গবর্নর লে. উডবার্ন। তখনকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাডলে বার্ডের সহযোগিতায় খুলনা থিয়েটারের সংগঠকরা উডবার্নের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তখন তিনি বিনামূল্যে বর্তমান নগর ভবনের সীমানা থেকে করোনেশন হলের সীমানা পর্যন্ত জমি খুলনা থিয়েটারের নামে বন্দোবস্ত দেন। পরবর্তীতে নগর ভবন ও করোনেশন হলের মাঝামাঝি জমি ইউনাইটেড ক্লাবকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৯০৯ সালে ঘূর্ণিঝড়ে খুলনা থিয়েটারের ঘরসহ প্রেক্ষাগৃহ বিধ্বস্ত হয়। এরপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এফবি ব্রাডলে বার্ড থিয়েটারকে প্রস্তাব দেন যে, তিনি ওখানে পাকা ভবন ও রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে দেবেন। এজন্য জমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুকূলে লিখে দিতে হবে। যখন খুলনা থিয়েটারের নাট্যানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থাকবে, তখন হলের দায়িত্ব থাকবে থিয়েটার কমিটির হাতে। বাদ বাকি সময় হলটি প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় থাকবে। এই শর্ত মেনে নিয়ে সেদিন খুলনা থিয়েটার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুকূলে জমি লিখে দেয়। এরপর সেখানে পাকা ভবন ও সুসজ্জিত মঞ্চ তৈরি হয়। ভবন নির্মাণে লাহা স্টেট ও বাগেরহাটের নাগ বাবুদের (জমিদার) অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। আর মঞ্চ সাজানোর জন্য আর্থিক সহায়তা দেন রায় সাহেব বঙ্কিম মজুমদার ও প্রিয়নাথ দাশ। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ৫ম জজ দিল্লীর সম্রাটের রাজ্য অভিষেক হয়। তখন বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বিনোদনমূলক হলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘করোনেশন’ যুক্ত করা হয়। ওই সময়ে খুলনার এই হলটির নাম রাখা হয় ‘করোনেশন হল’। ১৯২৪ সালে খুলনা থিয়েটার তাদের সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে ‘খুলনা নাট্য মন্দির’ রাখে। ১৯২৬ সালে ফের নাম পরিবর্তন করে ‘নাট্য নিকেতন’ রাখা হয়। জানা যায়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যম-িত করোনেশন হল ভাড়া নিয়ে ১৯২৯-৩০ সালের দিকে সুরেন বোস জেনারেটরের সাহায্যে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের কাজ শুরু করেন। সিনেমা হলের নাম দেয়া হলো ‘মুক’। এক-দেড় বছর চালানোর পর ‘মুক’ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে অর্ধেন্দু চ্যাটার্জী করোনেশন হল ভাড়া নিয়ে ‘বাণী সিনেমা’ নাম রেখে চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করেন। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বাণী সিনেমা নামেই চলছিল। এরপরে একইভাবে ‘সোসাইটি সিনেমা’ নামে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এখন পর্যন্ত করোনেশন হলে সোসাইটি সিনেমা কোনমতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এদিকে করোনেশন হল ভাড়া নিয়ে প্রথম সিনেমা হলের যাত্রা শুরু হলেও ব্যক্তি মালিকানায় শহরের কালিবাড়ী এলাকায় প্রথম তৈরি হয় ‘উল্লাসিনী’ সিনেমা হল। তৈরি করেছিলেন বিশিষ্ট কাপড় ব্যবসায়ী প্রমথ নাথ দাশ (কুরি)। তাঁর অকাল প্রয়াত দ্বিতীয় স্ত্রী উল্লাসিনীর নামে হলের নাম রাখা হয়। ১৯৩৪ সালে ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে এই হলের যাত্রা শুরু। দ্বিতীয় সিনেমা হলটির নাম ‘নীলা’। জমিদার শৈলেন ঘোষ তাঁর মেয়ের নামে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই হল তৈরি করেন। ১৯৪৫ সালে ‘বিরাজ বৌ’ ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে এই সিনেমা হলের যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে মালিকানা বদল হলে এই হলের নাম রাখা হয় ‘পিকচার প্যালেস’। -অমল সাহা, খুলনা থেকে
×